Thursday, September 17, 2015

মালিক আশতারের নিকট আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর পত্র

মালিক আশতারের নিকট আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর পত্র
(প্রশাসনিক নির্দেশমালা)
কুফা, ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ, ৩৭ হিজরি।
একজন আল্লাহর বান্দা আলী ইবনে আবু তালিবের পক্ষ থেকে মিশরের ভাবী গভর্নর মালিক ইবনে হারিস আশতারের প্রতি-
নেতৃত্বের করণীয়
মালিক, আমি তোমাকে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ প্রদান করছি, জীবনের সর্ববিধ কাজে আল্লাহ এবং তাঁর প্রদত্ত ব্যবস্থাকে সবার ওপরে স্থান দেবে। তাঁর স্মরণ ও ইবাদতকে অগ্রাধিকার দান কর। কুরআনের নির্দেশ ও নবীর শিক্ষাকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অনুসরণ করবে। এ সমস্ত নির্দেশ প্রতিপালনের ওপরই দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নির্ভরশীল। যারা এটা অমান্য করে তাদের জন্য রয়েছে চিরকালীন অভিশাপ। আল্লাহর নির্দেশ পালনে অপারগতার পরিণতি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনেই চরম ব্যর্থতা বয়ে আনবে। সুতরাং তোমাকে অবশ্যই আল্লাহ প্রদত্ত মূলনীতিগুলোকে মেনে চলতে হবে, আল্লাহর উদ্দেশ্যকে সমর্থন দিতে হবে এবং তাঁর নির্দেশগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে, কেবল এভাবেই তুমি আল্লাহর সাহায্য, অনুগ্রহ ও রহমতের যোগ্য হতে পার।
আমি তোমাকে আদেশ করছি মালিক, তোমার মন-মগজ, হাত ও কণ্ঠ এবং তোমার সমগ্র সত্তা দিয়ে আল্লাহর সৃষ্টির সহায়তা করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন তোমাদের কামনা ও বাসনা নিয়ন্ত্রিত করতে, তোমার আত্ম ও অহংবোধের লাগাম টেনে ধরতে, বিশেষ করে যখন কামনার পাগলা ঘোড়া তোমাদের শঠতা ও পাপের দিকে তাড়িয়ে নিতে উদ্যত হয়। তোমার আত্মবোধ ও তার আকাঙ্ক্ষা তোমাকে প্রতিনিয়ত অধঃপতন ও অবমাননার দিকে প্ররোচিত, উতসাহিত ও জোর করে ঠেলে নিয়ে যেতে চায়।
মালিক, আমি তোমাকে এমন একটি দেশের প্রশাসক করে পাঠাচ্ছি যা অতীতে নীতিহীন ও ন্যায়পরায়ণ, নিপীড়ক ও প্রজাতিতেষী, নিষ্ঠুর ও হৃদয়বান, অত্যাচারী ও দয়ার্দ্র এ সব ধরনের সরকারই প্রত্যক্ষ করেছে।
জনগণ পূর্ববর্তী শাসনগুলোকে যেভাবে নিরীক্ষণ করেছে ঠিক একই রকম সূক্ষ্মভাবে তারা তোমার প্রশাসনকেও বিচার করবে। তুমি পূর্ববর্তী শাসকদের সমালোচনা করছ, যদি তুমি আত্মসচেতন না হও তবে তুমি তাদের সম্পর্কে যা বলছ তারাও তোমার সম্পর্কে একই কথা বলবে।
একজন সৎ ও ভালো মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় তার সম্পর্কে ভালো কথা যা বলা হয় এবং অপরের কাছ থেকে যে প্রশংসাগুলো আল্লাহ তার জন্য নসীব করেন (তা থেকে)। মনে রেখ যে, ক্ষমতাসীন লোকদের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিচার তাদের বংশধরদের দ্বারা তার কৃতকর্মের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
সৎকর্ম
অতএব, তুমি তোমার মনকে মহৎ চিন্তা, সদুদ্দেশ্য, সদিচ্ছা ও সৎকর্মের ঝরনাধারার উতসমূল করে তোল। সৎকাজের হিসাব বাড়িয়ে তোলাই যেন হয় তোমার সবচেয়ে বড় চিন্তা। এতে তুমি সফল হতে পার তোমার কামনা-বাসনাকে লাগামছাড়া হতে না দিয়ে এবং নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থেকে।
মনে রেখ যে, নিজের প্রতি সুবিচার করার এবং ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে পাপকাজ থেকে বিরত থাকা এবং অসৎ বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করা।
জনগণের প্রতি দায়িত্ব
মালিক, তোমাকে অবশ্যই পছন্দ এবং অপছন্দের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং তোমার মনে জনগণের প্রতি ভালোবাসা, দয়া ও সহৃদয়তা লালন করতে হবে। হিংস্র পশুর মতো জনগণকে নির্যাতন ও নিষ্পেষণ করার নেশা যেন তোমাকে পেয়ে না বসে।
মনে রাখবে, জনগণের মধ্যে দু’ধরনের লোক রয়েছে, এক হচ্ছে তোমার ঈমানী ভাই এবং অন্যরা হচ্ছে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী, কিন্তু তারা তোমারই মতো মানুষ। উভয় মানুষই সাধারণ মানবীয় অক্ষমতা ও দুর্বলতার শিকার।
জেনে কিংবা না জেনে তারা অপরাধ করে থাকে এবং তাদের কাজের পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে তারা পাপ কাজে লিপ্ত হয়।
তোমার প্রতি আল্লাহর যে রকম দয়া ও সহানুভূতি আশা কর তাদের প্রতিও তুমি তেমন দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হও।
তোমাকে তাদের ওপর কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। তোমার ভুলে গেলে চলবে না যে, তোমার ওপর তোমার খলিফা রয়েছেন, আর তোমার খলিফার ওপর রয়েছেন আল্লাহ।
আল্লাহ তোমাকে গভর্নর বানিয়েছেন, তোমার ওপর জনগণের দেখাশোনার ভার দিয়েছেন এবং তিনি তাদের মাধ্যমে তোমাকে পরীক্ষা করতে চান।
নিজেকে কখনো এমন পর্যায়ে উন্নীত করার কথা ভেব না যাতে আল্লাহর সাথে দ্বন্দ্বের আশঙ্কা রয়েছে। তাঁর শাস্তি থেকে রেহাই পাবার শক্তি তোমার নেই, আর তাঁর ক্ষমা, দয়া, অনুগ্রহ ও সহানুভূতি ছাড়া তোমার চলাও সম্ভব নয়।
ক্ষমা ও অনুকম্পা প্রদর্শন করতে কখনো লজ্জা কিংবা বেদনাবোধ কর না। কাউকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা আছে বলে কখনো পুলকিত বা গর্ববোধ কর না।
অধীনস্তদের ব্যর্থতায় ক্রোধান্বিত হয়ো না। অধঃস্তন কর্মচারী ভুল করলে রাগান্বিত কিংবা অধৈর্য হয়ো না। তাদের প্রতি সহনশীল ও সহানুভূতিসম্পন্ন হও।
মানুষকে এ কথা মনে করিয়ে দিতে যেও না যে, তুমি গভর্নর, অশেষ ক্ষমতাধর এবং প্রত্যেককে অবশ্যই তোমার প্রতি বিনীত আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে এবং তোমাকে মেনে চলতে হবে। এ ধরনের আত্মম্ভরিতা তোমার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করবে, (তোমাকে) দাম্ভিক করে তুলবে, (তোমার) বিশ্বাসকে দুর্বল করবে এবং তোমাকে আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির সাহায্য কামনা করতে বাধ্য করবে।
যদি তোমার মনে কখনো অহমিকা স্থান পায় সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ কর তোমার ওপর আল্লাহর মহান শক্তি, ক্ষমতা ও প্রভাবের কথা, তাঁর সৃষ্টির বিশালত্ব, এমনকি তোমার একান্ত ঘনিষ্ঠ ব্যাপারেও তাঁর নিয়ন্ত্রণ এবং যেখানে তোমার শক্তি একেবারেই ক্ষীণ সেখানেও যে তাঁর কর্তৃত্ব ক্রিয়াশীল, সে বিষয়ের প্রতি মনোযোগ রাখবে। এ ধরনের ধ্যান তোমার অহংবোধে আঘাত হানবে, তোমাকে আত্মম্ভরিতা ও বিদ্রোহ থেকে দূরে রাখবে, তোমার ঔদ্ধত্যকে বিনাশ করবে এবং তোমার হারানো সুস্থতা ফিরিয়ে আনবে।
সাবধান! কখনো ক্ষমতার দিক থেকে খোদার সমকক্ষতা দাবি কিংবা গৌরব, মহত্ত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে তাঁর সাথে প্রতিযোগিতা করার কথা চিন্তাও কর না। আল্লাহ পাপী ও নিপীড়কদের নত করে দেন এবং যারা তাঁর মতো ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী হবার ভান করে তাদের অপদস্থ করেন।
তোমার ওপর আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব প্রতিপালনের জন্য কষ্ট স্বীকার কর। মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নিও না এবং অন্যপক্ষে তোমার আপন আত্মীয়, বন্ধু ও প্রিয়জন যেন আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে চলে এবং সাধারণ জনগণের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণে সচেষ্ট হয়।
মনে রেখ, যদি তুমি সাম্য ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে কাজ করতে ব্যর্থ হও তাহলে অত্যাচারী ও নিপীড়ক বলে পরিগণিত হবে, যে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি অবিচার করে সে আল্লাহকে নিজের বৈরী করে ফেলে এবং মযলুমের ঘৃণা অর্জন করে। আল্লাহ যার বিরুদ্ধে চলে যান এবং যার প্রতি অসন্তুষ্ট হন তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না সে অনুতপ্ত হয়, আল্লাহ তার প্রতি বৈরী থেকে যান।
মনে রাখবে মালিক, এ বিশ্বে আল্লাহর রহমত থেকে কাউকে বঞ্চিত রেখে আল্লাহর রোষ আমন্ত্রণ করার মতো অপরাধ আর কিছু নেই। তাঁর সৃষ্টির ওপর যুলুম ও নিপীড়নের চেয়ে আর কিছুতেই আল্লাহ তাআলা এত বেশি ক্রোধান্বিত হন না। তিনি সব সময় মযলুমের দোয়া শুনে থাকেন এবং সর্বক্ষণ শাস্তি দেয়ার জন্য যালিমদের খোঁজ করেন।
খুব মিঠেও নয় খুব কড়াও নয় বরং সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক একটি নীতি তোমার গ্রহণ করা উচিত, এমন এক নীতি যা বহুল প্রশংসিত হবে।
সুবিধাভোগী শ্রেণি
গুটিকয় সুবিধাভোগী লোকের সমর্থন ও সন্তুষ্টির চেয়ে তুমি সাধারণ ও নিপীড়িত জনগণের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি অধিকতর মনোযোগী হবে।
যদি সাধারণ জনগণ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে তবে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর অসন্তোষ তোমার প্রভুর কাছে গুরুত্ব লাভ করবে না।
আসলে একটি সরকারের স্থায়িত্বটাই জনগণের সুখ ও সমৃদ্ধির ওপর।
তুমি মনে রাখবে মালিক, এ মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণি হচ্ছে মানব সমাজের আবর্জনা। তারা হচ্ছে এমন সব লোক যারা (১) সমৃদ্ধির সময় রাষ্ট্রের উপর সবচেয়ে বড় বোঝা, (২) অভাব ও সংকটের সময় তারা সবচেয়ে কম উপকারী, (৩) তারা সাম্য-ন্যায়কে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়, (৪) রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের দাবির ব্যাপারে তারা সবচেয়ে নাছোড়াবান্দা, (৫) তারা কখনই প্রদত্ত অনুগ্রহে তৃপ্ত নয়, (৬) সমস্ত অনুগ্রহের ব্যাপারেই তারা সবচেয়ে অকৃতজ্ঞ, (৭) যখন তাদের দাবিগুলো যথার্থভাবেই গ্রাহ্য করা হয় তখন তারা এর পেছনে যুক্তিগুলো নিতে সবচেয়ে নিষ্পৃহ ও অনাগ্রহী, (৮) আর যখন সময় ও ভাগ্য পরিবর্তিত হয় তখন তাদেরকে তাদের বিশ্বাসের উপর মোটেও স্থির থাকতে দেখা যায় না, (৯) সমাজের সম্পদগুলোর জন্য তারা হচ্ছে সবচেয়ে বড় নর্দমা।
সাধারণ মানুষ
এ সমস্ত লোকের বিপরীতে সাধারণ মানুষ, দরিদ্র ও কম সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি হচ্ছে ইসলামের খুঁটি। তারা হচ্ছে মুসলিম সমাজের আসল শক্তি। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে তারা সদা সতর্ক সৈনিক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং তাদের প্রতি তোমার মনের দুয়ার খুলে দাও, তাদের সাথে আরো বন্ধুভাবাপন্ন হও এবং তাদের সহানুভূতি ও আস্থা অর্জন কর।
মানুষের ত্রুটি ও দুর্বলতার প্রতি নেতার আচরণ
গুরুত্বপূর্ণ বা সাধারণ যেই হোক, তার সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর।
ধামাধরা ও খয়ের খাঁদের থেকে দূরে থাকবে, যারা অপরের খুঁত খোঁজে আর কুতসা রটনাতে নিয়োজিত; তাদেরকে শত্রু বলে মনে করবে।
এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, মানুষের মধ্যে দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা থাকবে। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। এসবকে ক্ষমা করে দেয়ার অধিকার একজন শাসকের চেয়ে আর কার বেশি থাকতে পারে?
অতএব, তুমি অবশ্যই কারো গোপন ভুলত্রুটিগুলো অনুসন্ধান করতে যাবে না। এগুলো আল্লাহর জন্য রেখে দাও। যেসব ত্রুটি ও ব্যর্থতা তোমার নজরে আসে সেগুলোর ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব হচ্ছে কী করে সেগুলো সংশোধন করতে হয় সে ব্যাপারে মানুষকে শিক্ষা দেয়া।
অপরের দুর্বলতা জনসমক্ষে ফাঁস না করে দেবার চেষ্টা কর। প্রতিদানে তুমি তোমার যে দুর্বলতা মানুষের কাছে গোপন রাখতে চাও আল্লাহও তা ঢেকে রাখতে পারেন।
জনগণের মধ্য থেকে হিংসা দূর করার চেষ্টা কর। মানুষের মধ্যে হিংসা ও শত্রুতার কারণ হয়ে দাঁড়িও না। গুরুত্বহীন বিষয়কে উপেক্ষা করে যাও। তোমার অনুগ্রহ বণ্টন ও আস্থা স্থাপন যেন মানুষের মধ্যে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি না করে। প্রত্যেকের ব্যাপারেই সৎ ও নিরপেক্ষ হও। তোমার ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা ও অনুগ্রহ যেন হিংসা ও বিদ্বেষ উদ্রেককারী উতস না হয়ে ওঠে। যে ব্যক্তি তোমার নৈকট্য ও আনুকূল্য পাবার যোগ্য নয় সে যেন তোমার কাছে আসতে না পারে। কখনো তোমার সম্মান ও মর্যাদা নিচু করবে না।
স্মরণ রেখ যে, একজন নিন্দুক অত্যন্ত হীন প্রকৃতির ও বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন লোক, যদিও সে তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী ও একনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে নিজেকে দেখাতে চায়, আসলে সে কিন্তু অত্যন্ত নীচ ও শঠ। তাদের উপদেশ গ্রহণ করার আগে ধীরে সুস্থে ভেবে নিতে হবে।
মন্ত্রী ও উপদেষ্টা
কৃপণদের থেকে কখনো উপদেশ গ্রহণ করবে না। তারা তোমাকে ঔদার্যপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং তোমার মধ্যে দারিদ্র্যের ভীতি সৃষ্টি করবে।
একইভাবে ভীতু-কাপুরুষদেরও উপদেষ্টা বানিও না। যেহেতু তারা সব সময়ই তোমার দায়িত্ব পালনে নিরুৎসাহী করবে এবং আদেশ-নির্দেশ প্রদান ও কার্যকরকরণের ব্যাপারেও দুর্বল করে তুলবে।
তারা তোমার ব্যক্তিত্বকে দুর্বল করবে, তোমাকে দুর্বলচিত্ত করে দেবে এবং যে সমস্ত বিষয়ে সাহসের প্রয়োজন সেসব বিষয়ে তোমাকে ভীরু করে তুলবে। লোভী ও অর্থগৃধনুদেরও তোমার উপদেশদাতা বানিও না, কেননা, তারা তোমাকে শোষণের পরামর্শ দেবে, তোমাকে লোভী করে তুলবে, দুর্নীতিতে খাঁটি অপরাধী বানিয়ে দেবে এবং অত্যাচার ও নির্যাতন চালানোর জন্য তোমাকে প্রভাবিত করবে।
তুমি ভুলে যাবে না যে, কৃপণতা, কাপুরুষতা ও লোভ ভিন্ন প্রকৃতির বলে মনে হতে পারে, যদিও এগুলো সব সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি মানুষের বিশ্বাসহীনতার কুপ্রবৃত্তি থেকে উদ্ভূত।
তোমার নিকৃষ্টতম মন্ত্রণাদাতা হবে তারা যারা তোমার পূর্ববর্তী শোষক ও নিপীড়কদের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা বা মন্ত্রণাদাতা থেকে তাদের অন্যায়, অপরাধ ও নৃশংসতার সহযোগী ছিল।
প্রজ্ঞা, জ্ঞান, প্রশাসনিক দক্ষতার দিক থেকে তাদের সমমানের ব্যক্তি তুমি সহজেই পেতে পার। কিন্তু তাদের বিপরীতক্রমে তাদের ঘাড়ে সেই পাপের বোঝা নেই। যারা কোন নিপীড়ককে সাহায্য-সহযোগিতা করেনি তাদের মধ্য থেকেই তাদেরকে আসতে হবে।
এ সমস্ত লোকই সবচেয়ে কম ক্ষতিকর এবং সবচেয়ে বড় সহযোগী প্রমাণিত হবে।
যদি তুমি তাদেরকে কাছে টেনে নাও তবে তারা তাদের সাথে যদি শত্রুপক্ষের কোন সম্পর্ক থাকে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এ সমস্ত লোককে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় কাজে তোমার সাথি বানাও।
শুধু ঐ সমস্ত ব্যক্তির ওপর তোমার আস্থা স্থাপন কর, যারা তোমার সমালোচনায় সবচেয়ে স্পষ্ট এবং যারা তোমার পদমর্যাদা ও ক্ষমতার প্রতি যে কোন ধরনের ভীতি ছাড়াই যে কোন অপ্রিয় সত্য কথা বলবে। যে সমস্ত কাজ তোমার পছন্দসই হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় তারা সে সমস্ত কাজে তোমাদেরকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানাবে।
রাষ্ট্রীয় কাজে সত্যনিষ্ঠ, ধর্মপ্রাণ ও সৎলোকদের সংগ্রহ করে তাদেরকে তুমি যে সমস্ত কাজ করনি সে সমস্ত কাজের কৃতিত্ব তোমার ওপর চাপিয়ে তোষামোদ করার প্রবণতা বন্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ দাও।
যারা মিথ্যা প্রশংসা করে, আনুকূল্য চায় তাদেরকে ত্যাগ কর। তোষামোদ ও মিথ্যা প্রশংসা তোমাকে নিজের সত্যিকারের সত্তা সম্পর্কে বিস্মৃত করে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলবে এবং গর্ব ও ঔদ্ধত্যের কাছে টেনে নিয়ে আসবে।
জনগণের অধিকার
ক. সাধারণ নীতিমালা
ভালো আর খারাপের সাথে তুমি একই রকম আচরণ করবে না। যদি তুমি এটি কর তাহলে তুমি ভালো মানুষকে ভালো কাজ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলবে এবং দুষ্কৃতকারীদেরকে কুকর্মে উতসাহ দেয়া হয়ে যাবে। সুতরাং যে যেরকম কাজ করে তোমার কাছ থেকে তার সে রকম আচরণই লাভ করা উচিত।
তোমার মনে রাখা প্রয়োজন যে, একজন শাসক জনগণের মধ্যে আনুগত্য ও সুনাম সৃষ্টি করতে পারে, শুধু যদি সে তাদের প্রতি দয়ালু ও সহানুভূতিসম্পন্ন হয়, ক্রমাগত তাদের বোঝা হালকা করে দেয়, তাদের ক্ষমতার বাইরে কর বসানো পরিহার করে, তাদের উপর যুলুম ও নিষ্পেষণ না চালায়, তাদের শক্তির বাইরে কোন দায়িত্ব না চাপিয়ে দেয়।
সুতরাং তোমার কাজ ও আচরণ এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে তুমি তাদের আস্থা অর্জন করতে পার। এমন কিছু করবে না যাতে তুমি তাদের অবিশ্বাসের কারণ হয়ে ওঠ। তোমার ওপর তাদের আস্থা তোমার অনেকগুলো উদ্বেগ ও আশঙ্কা কমিয়ে দেবে।
এমন সব লোকের ওপর তোমার আস্থা স্থাপন করা উচিত যাদেরকে তুমি বিচার ও পরীক্ষা করার পর বন্ধু বানিয়েছ এবং আস্থা স্থাপন করেছ।
কল্যাণকর ঐতিহ্য, রীতি ও আচার-ব্যবহার এবং পূর্ববর্তী প্রশাসন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আইন-কানুন ও রীতি যার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ঐক্য, সংহতি ও সৌহার্দবোধ দৃঢ় হতো সেগুলো তুমি ভেঙে দিও না বা পরিবর্তন কর না।
মনে রেখ যে, এ সমস্ত মহৎ ঐতিহ্য ও রীতির ওপরই জনগণের মধ্যে শান্তি ও সুনাম নির্ভর করবে।
এমন কোন অভিনব কিছুর প্রচলন কর না যা কোন কল্যাণকর প্রাচীন ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। (ফলে) যারা এ সমস্ত (কল্যাণকর) রীতি চালু করেছে তারা তার জন্য প্রতিদান লাভ করবে, কিন্তু পূর্বতন কল্যাণকর ঐতিহ্য ভঙের জন্য (তুমি) শাস্তি লাভ করবে।
খ. সামাজিক শ্রেণিসমূহ
মালিক, তোমার জানতে হবে, তোমাকে যে জনগণের ওপর শাসক নিযুক্ত করা হয়েছে তারা বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রত্যেক শ্রেণির সমৃদ্ধিই ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতাবে এতখানি পরস্পর নির্ভরশীল যে, গোটা সমাজ কাঠামোটাই যেন একটি ঘনভাবে বোনা জাল। অপর অংশের কার্যকর সহযোগিতা ও সদিচ্ছা ছাড়া কোন দলই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে না।
তাদের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর উদ্দেশ্য প্রতিপালনের জন্য আল্লাহর সেনাবাহিনী, পরবর্তী শ্রেণি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সচিবরা, তৃতীয় দলটি হচ্ছে বিচার কাজ নিশ্চিতকরণের কাজে নিয়োজিত কাজী ও ম্যাজিস্ট্রেটবৃন্দ। চতুর্থ দলটি হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে যারা দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেন। তারপর আসছে সাধারণ মানুষ, মুসলমান- যারা সরকারি কর প্রদান করে এবং অমুসলিম- যারা করের বদলে জিজিয়া কর দেয়। তারপর আসছে সমাজের দোকানদার, শিল্পী ও কারিগর- যাদেরকে তুমি দরিদ্র ও নির্যাতিত দেখতে পাবে।
এসব শ্রেণির অধিকার ও কর্তব্য রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাঁর কালামে পাকে বিধৃত করেছেন এবং রাসূলের হাদিসের মাধ্যমে বিশ্লেষিত করেছেন। এর সম্পূর্ণ নমুনা আমাদের কাছে মওজুদ রয়েছে।
গ. ইসলামী বাহিনীর মর্যাদা
আল্লাহর আদেশে সেনাবাহিনী ও পুলিশ রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় একটি দুর্জয় দুর্গের ভূমিকা পালন করছে; তারা একজন শাসকের জন্য অলংকার, তারা একটি শক্তির উৎস, ঈমানদারদের মর্যাদা ও শান্তি।
তারা মানুষের মধ্যে শান্তি নিশ্চিত করে, তারা হচ্ছে নিরাপত্তার অভিভাবক যাদের মাধ্যমে দক্ষ অভ্যন্তরীণ প্রশাসন সুনিশ্চিত হতে পারে।
জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা তাদেরকে ছাড়া রক্ষা করা অসম্ভব।
সেনাবাহিনী সংরক্ষণ তাদের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত করের ওপর নির্ভরশীল। এই কর দিয়ে তারা নিজেদের ভরণপোষণ, অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো এবং ঈমান ও ন্যায়ের পথে সংগ্রামে শত্রুদের পরাভূত করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সদা প্রস্তুত থাকে।
ঘ. বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও সচিবালয়
যদিও জনগণ ও সেনাবাহিনী দুটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি, কিন্তু তাদের স্বাচ্ছন্দ্য অন্যান্য শ্রেণির, যথা বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও সচিবালয়ের সহযোগিতা ছাড়া অসম্ভব। প্রথমটি বিচার চালায়, দ্বিতীয়টি রাজস্ব সংগ্রহ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে এবং তৃতীয় দলটি তাদের সাধারণ কল্যাণ ও বিশেষ বিষয়াবলি, বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সৌহার্দ ও সম্প্রীতি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অধিকার ও দায়িত্বের ট্রাস্টি হিসেবে কাজ করে।
ঙ. ব্যবসায়ী ও কারিগর
উপরিউক্ত কাঠামোর সুফল নির্ভর করে আবার ব্যবসায়ী, শিল্পী ও কারিগরদের ওপর। তারা সরবরাহকারী ও ভোক্তাদের মধ্যে মধ্যস্থ হিসেবে কাজ করে, তারা লাভের আশায় দোকান, রাজার ও ব্যবসাকেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন করে। কারিগররা তাদের নির্মাণকর্ম দিয়ে সমাজকে এমনভাবে সাহায্য করে যা অদক্ষ শ্রম দিয়ে সম্ভব নয়।
চ. দরিদ্র পঙ্গু
দরিদ্রদের মধ্যে প্রধানতম শ্রেণি হচ্ছে পঙ্গু দরিদ্র ও ছিন্নমূল গোষ্ঠী। তারা অন্যান্য মানুষের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাবার যোগ্য।
এই সমস্ত প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জীবন নির্বাহের জন্য আল্লাহ বহু কিছু দিয়েছেন। প্রত্যেক গোষ্ঠীরই অধিকার রয়েছে একটি সুখী জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বস্তু রাষ্ট্র থেকে পাবার।
মনে রাখবে, আল্লাহ কোন শাসককেই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে অব্যাহতি দেবেন না, যদি সে তার দায়িত্ব পালনে সর্বশক্তি নিয়োগ না করে এবং ন্যায় ও সত্যের পথ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে না থাকে এবং মানুষের অনুকূল বা প্রতিকূল যা-ই হোক না কেন, সবই সে ধীরস্থিরভাবে মেনে না নেয়।
ইসলামী বাহিনী
ক. ইসলামী বাহিনীর সেনাপতি নিয়োগ
এমন কাউকে সেনাপতি নিয়োগ করবে যে তোমার মতে সবচেয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ, নবীজি ও তোমার ইমামের প্রতি নিবেদিত, যার একটি স্বচ্ছ বিবেক রয়েছে, যার ধার্মিকতা, জ্ঞান ও ভদ্র আচরণের জন্য খ্যাতি রয়েছে, যে হঠাত রেগে যায় না, অজুহাতকে সহৃদয়তার সাথে বিবেচনা করে থাকে, যে সবলদের প্রতি শক্তি প্রয়োগে কঠোরতা ও দুর্বলদের প্রতি দয়ার্দ্র্যচিত্ত ও মহানুভবতা প্রদর্শন করে থাকে, যে হবে প্রতিশোধপরায়ণতা ও জিঘাংসার মনোভাব হতে মুক্ত- যা মানুষকে শক্তি প্রয়োগে বাধ্য করে। হীনমন্যতা হতে তাকে মুক্ত হতে হবে যা তার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে মানুষকে অসহায় করে তোলে।
ভালো সেনাধ্যক্ষ বাছাই ও যোগ্য অফিসার নিয়োগের জন্য তোমাকে এমন সব লোকের সঙ্গে মিশতে হবে ও সম্পর্ক রাখতে হবে যারা বংশ মর্যাদার দিক দিয়ে উন্নত এবং যারা ধার্মিকতা, সাহসিকতা ও প্রশংসনীয় বীরত্বপূর্ণ কাজের সুমহান ঐতিহ্যের অধিকারী। সাধারণত এসব লোকই সর্বোত্তম চরিত্র, ধার্মিকতার আদর্শ ও মহান কার্যাবলির প্রেরণা দানকারী উতস হিসেবে পরিগণিত হতে থাকবে।
খ. সেনানায়কদের প্রতি নেতার দায়িত্ব
এভাবে বাছাইকৃত লোকদের কাজকর্মের প্রতি পিতামাতার মতো দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে যাতে তাদের যেকোন দোষত্রুটি অতি সহজে তোমার নিকট ধরা পড়ে। তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে এবং এতে তোমার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও আস্থাশীলতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
যেসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদেরকে শক্তিশালী করা হয়েছে সুবিবেচনার যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তা অতিরঞ্জিত কর না। তাদের ছোটখাট অভাব পূরণে উদাসীনতা প্রদর্শন কর না। যদিও প্রধান প্রয়োজনাদি পূরণ করাটা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ, তথাপি অনেক সময় ছোটখাটো প্রয়োজনের প্রতি নজর প্রদান ও অনুগ্রহ অত্যধিক ফলপ্রসূ হয়ে থাকে। তাদের বড় বড় বিষয়াদির প্রতি যথাযথ নজর প্রদান করা হয়েছে- একমাত্র এ অজুহাতে ক্ষুদ্র ব্যাপারগুলোকে খাটো কর না।
গ. শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদের বৈশিষ্ট্য
যেসব সামরিক কর্মকর্তা তাদের শত্রুসৈন্য ছাড়া অন্যসব অধীনস্থ সৈনিকের সর্বপ্রকারের দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণে অত্যধিক মনোযোগী ও ততপরতা প্রদর্শন করে থাকে তারাই সামরিক সম্মান ও বিবেচনার যোগ্য বিবেচিত হবে। এসব অফিসার তাদের সৈনিকদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখ-শান্তির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য তার ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদ দিয়ে সাহায্য করে থাকে যেন পরিবার ও সন্তান-সন্ততির চিন্তামুক্ত হয়ে সন্তুষ্টচিত্তে জীবন যাপন করতে পারে। এমনিভাবে তুমি তাদের অন্তরকে জয় করে নেবে। তারা সর্ববিধ চিন্তাভাবনামুক্ত মন নিয়ে সাহসিকতাপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে যুদ্ধ করে যাবে। তোমার অফিসার ও সৈনিকদের প্রতি সদা যত্নবান থাকার কারণে তারাও তোমাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসতে থাকবে।
নেতা ও জনগণের পারস্পরিক দায়িত্ব
একজন শাসকের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দ ও তৃপ্তি যে, দেশ ন্যায়নীতি, সুবিচার ও ইনসাফের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে এবং শাসকের প্রতি নাগরিকদের মনে আস্থা ও ভালোবাসার মনোভাব বিরাজ করছে।
তোমার লোকেরা তোমাকে কিছুতেই ভালোবাসতে পারে না যদি তারা অসুখী থাকে এবং তুমি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হও। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমার শাসনকে অবাঞ্ছিত ও বোকা মনে করতে থাকবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য এগিয়ে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার কিছুতেই মনে করা উচিত হবে না যে, তারা তোমার শাসনের সমর্থক। যদি জনগণ তোমার সরকারের অবমাননাকামী না হয় একমাত্র তখনই এটি অসহনীয় বোঝা হিসেবে পরিগণিত হবে না।
সুতরাং তাদেরকে তোমার কাছ থেকে সমস্ত সংগত আশা করার এবং সে আশাগুলো বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার অধিকার দাও।
যারা প্রশংসাযোগ্য তাদের প্রশংসার ব্যাপারে উদার হও, তাদের ভালো কাজকে উতসাহ দাও, আর সাহসী লোকদের মহত সাফল্যের ব্যাপক প্রচার কর।
ভালো কাজের ব্যাপক প্রচার সাহসীদের মধ্যে জাগাবে আরো বেশি উতসাহ আর ভীরু ও কাপুরুষদের করে তুলবে সাহসী।
আবার কে কী করেছে সে বিষয়ে তোমার ভালোভাবে জানা থাকতে হবে, যাতে একজনের কর্ম আরেকজনের কাঁধে চাপানো না হয়।
যে তার ভালো কাজের জন্য যথার্থভাবেই যোগ্য তার অবমূল্যায়ন কিংবা পুরস্কার দেয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য কর না।
এভাবেই একটি কাজকে তোমার অধিক মূল্যায়ন করাও উচিত নয় শুধু এ কারণে যে, সেটা করেছেন একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাঁর অবস্থান ও মর্যাদা যেন তাঁর কাজের গুরুত্বকে বাড়িয়ে তোলার জন্য তোমাকে প্রভাবিত না করে। একই সাথে একজন সাধারণ মানুষের করা মহত কাজকে উপেক্ষা কর না। সাম্য, ন্যায় ও সততা যেন তোমার মূল উদ্দেশ্য হয়।
বিরোধ নিষ্পত্তির চূড়ান্ত কর্তৃত্ব
যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, অনিশ্চয়তা তোমার মনের একাগ্রতাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, তুমি তখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আশ্রয় নেবে।
যাদেরকে আল্লাহ সঠিক পথ দেখাতে চান তাদেরকে এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন : ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বশীল তাদের আনুগত্য কর আর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে বিবাদ উপস্থিত হয়, তা আল্লাহ ও রাসূলের হাতে ছেড়ে দাও।’
আল্লাহর হাতে কোনো বিষয় ছেড়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁর কালাম থেকে নির্দেশনা ও উপদেশ খোঁজা আর নবীর হাতে ছেড়ে দেয়া অর্থ হচ্ছে তাঁর এমন সব হাদীস অনুসরণ করা যেগুলো সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
বিচারক
ক. গুণাবলি
জনগণের বিচার কাজ চালানোর জন্য তোমাকে অত্যন্ত বিবেচনানির্ভর হতে হবে। এ উদ্দেশ্যে চমতকার চরিত্র, উত্তম মেধা, উল্লেখযোগ্য যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্বাচন করা উচিত।
তাদের অবশ্যই নিম্নরূপ গুণাবলিসম্পন্ন হতে হবে :
১. সমস্যার জটিলতা কিংবা সংখ্যার আধিক্যের কারণে তাদের কখনোই মেজাজের ভারসাম্য হারানো উচিত নয়।
২. যখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবে যে, তার প্রদত্ত রায় ভুল হয়েছে তা সংশোধন করা কিংবা সে রায় বদলে দেয়া তাদের পক্ষে মোটেও মর্যাদাহানিকর ভাবা উচিত নয়।
৩. তারা লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ ও চরিত্রহীন হতে পারবে না।
৪. যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি অভিযোগের এদিক ও সেদিক আগাগোড়া যাচাই করে না দেখা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিশ্চিত হওয়া অনুচিত, যখন অস্পষ্টতা ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তখন আরো বিস্তৃত অনুসন্ধান চালিয়ে বিষয়গুলো স্পষ্ট করে নিয়ে তারপর রায় দিতে হবে।
৫. তাদের অবশ্যই যুক্তি-প্রমাণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং তাদের কখনই মামলাকারীর দীর্ঘ কৈফিয়ত শুনবার ব্যাপারে অধৈর্য হলে চলবে না, বিশদ বিবরণ নিরীক্ষণে এবং বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিথ্যা থেকে সত্যে উপনীত হবার কাজে অবশ্যই ধীরস্থির এবং অধ্যবসায়ী হতে হবে। আর এভাবে যখন সত্য আবিষ্কৃত হবে তখন তাদের নির্ভয়ে রায় প্রকাশ করে বিবাদের ইতি টানতে হবে।
৬. যাদের প্রশংসা করা হলে আত্মদর্পী হয়ে ওঠে এবং যারা তোষামোদে গলে যায় আর চাটুকারিতা ও প্ররোচনায় বিপথগামী হয় তাদের মধ্যে যেন কেউ বিচারক না হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ সমস্ত গুণসম্পন্ন লোকের খুব কমই দেখা পাবে। যখন তুমি বিচারক নিয়োগ করবে তাদের কিছু কিছু বিচারের রায় ও ধারা বিবরণী তুমি আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবে।
খ. বিচারকদের প্রতি নেতার কর্তব্য
এভাবে বিচারক নিয়োগের পর তমি তাদের জন্য একটি মোটা ভাতা নির্ধারণ করে দিও যাতে তাদের সমস্ত বৈধ প্রয়োজনগুলো মিটে যায় আর তারা যেন অপরের থেকে চাইতে কিংবা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে বাধ্য না হয়।
তোমার সরকারের মধ্যে তাদেরকে এমন একটি মর্যাদা ও সম্মান এবং তোমার ঘনিষ্ঠতা নিশ্চিত করবে যেন তোমার কোনো অফিসার বা সভাসদ কেউই তাদেরকে ভীত কিংবা তাদের ওপর কর্তৃত্ব না করতে পারে।
বিচার বিভাগকে অবশ্যই সব ধরনের প্রশাসনিক চাপ ও প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে, ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। একে অবশ্যই ভীতিহীন ও পক্ষপাতহীন হয়ে কাজ করে যেতে হবে।
বিষয়টি ভালো করে ভেবে দেখ আর বিশেষত এই দিকটির ওপর গুরুত্ব দাও, কারণ, তোমার নিযুক্তির আগে এ রাষ্ট্রটা দুর্নীতিপরায়ণ ও দাগাবাজদের অধীনে ছিল। এসব লোভী ও জঘন্য ব্যক্তি ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাষ্ট্রকে শোষণ করেছে এবং সম্পদ অর্জন ও অন্যান্য পার্থিব বস্তু অর্জনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসক ও কর্মকর্তাবৃন্দ
ক. যোগ্যতা
রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা বা প্রশাসকবৃন্দের কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্ব তোমার। তাদের চরিত্র, যোগ্যতা ও আচরণ ভালো করে পরীক্ষা করার পর তাদেরকে নিযুক্ত করা উচিত। পরীক্ষার ভিত্তিতে এবং কোনো ধরনের পক্ষপাত ও অপরের প্রভাবমুক্ত থেকে তাদের নিয়োগ হওয়া উচিত।
যদি তুমি অফিসারদের নিছক প্রতিপালন ও সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই নিয়োগ করে থাক তাহলে তা অবিচার, অত্যাচার এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার ও দুর্নীতির রূপ পরিগ্রহ করবে। অভিজাত বংশীয়, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও প্রাথমিক যুগে যারা ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ করেছে তাদের মধ্য থেকে তোমার কর্মকর্তা নিয়োগ কর। উন্নত চরিত্র ও অত্যন্ত ভদ্র ও শরীফ হলে তারা সহজেই লালসা ও দুর্নীতির শিকার হয়ে পড়বে না। যেহেতু তারা তাদের কাজের পরিণতি সম্পর্কে অসচেতন নয়।
খ. বিচারকদের প্রতি নেতার কর্তব্য
তাদেরকে ভালো বেতন দিও, যেন তারা নৈতিক অধঃপতনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে, এটা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং তারা যে তহবিলের জিম্মাদার তার ওপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ করবে। মোটা ভাতা পাবার পরও যদি তারা তহবিল তসরুফ করে আর নিজেদের অসাধু প্রমাণ করে তাহলে তুমি তাদেরকে শাস্তি দেবার জন্য একটি সংযত কারণ পাবে। সুতরাং তাদের কাজের পদ্ধতি ও খুঁটিনাটি দিকের ওপর দৃষ্টি রাখবে এবং তাদের নিযুক্তির পর স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়ে রাখবে না।
তদারকি
এ সমস্ত কর্মকর্তার কাজ পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য তোমার সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা উচিত, যদি তারা জানে যে, তাদের কার্যাবলি গোপনে দেখা হচ্ছে তাহলে তারা অসাধুতা ও অসৎকর্ম থেকে বিরত থাকবে।
জনগণের প্রতি আন্তরিকতাপূর্ণভাবে নিবেদিত হও এবং তোমার সরকারকে অসাধু কর্মকর্তাদের অনুপ্রবেশ থেকে রক্ষা কর। এরপরও যদি কোনো অফিসারকে অসৎ দেখতে পাও এবং গুপ্তচররাও যদি তার সমর্থন দেয় তাহলে তুমি অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ করবে।
শাস্তিটা হতে পারে শারীরিক, চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান; তাকে এমনভাবে অপদস্থ করতে হবে যেন সে তার কৃত অপরাধের পরিণতি অনুধাবন করতে পারে। তার অপমান ও শাস্তির ব্যাপক প্রচারণা দেয়া প্রয়োজন, যেন তার জীবনটা হয়ে পড়ে গ্লানিময় ও কালিমালিপ্ত। আর তা অপরের জন্য যেন শিক্ষা হতে পারে।
রাজস্ব, রাজস্বদাতা ও কোষাগার
কর ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তোমার খেয়াল রাখতে হবে যে, রাজস্বের চেয়ে রাজস্বদাতাদের কল্যাণের গুরুত্ব বেশি। রাজস্বদাতাদের কল্যাণের ওপরই বাদবাকি জনসংখ্যার কল্যাণ নির্ভরশীল। মনে রাখতে হবে যে, পুরো জাতিই রাজস্ব আদায়ের ওপর নির্ভরশীল।
সুতরাং তুমি রাজস্ব সংগ্রহের চেয়ে জমির উর্বরতার ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করবে, যেহেতু রাজস্ব দেয়ার ক্ষমতা ভূমির উর্বরতার ওপর নির্ভরশীল। যে শাসক জমির উর্বরতা ও জনগণের সমৃদ্ধির ওপর নজর না দিয়ে কেবল কর আদায়ের জন্য ব্যগ্র থাকে সে অবশ্যম্ভাবীরূপে ভূমি, রাষ্ট্র ও জনগণের ধ্বংস ডেকে আনে। তার শাসন বেশি দিন স্থায়ী হতে পারে না।
যদি তোমার জনগণ বেশি কর আরোপের অভিযোগ আনে, কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন অনাবৃষ্টি, সেচ ব্যবস্থার বিপর্যয়, পোকার আক্রমণ, বন্যা ইত্যাদির শিকার হয়ে পড়ে তাহলে তুমি তাদের কষ্ট অশেষ সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করবে এবং তাদের অবস্থার উন্নতির স্বার্থে তাদের কর যথাযথ অনুপাতে কমিয়ে আনবে।
কর কমিয়ে দেয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় তহবিলের সংকোচন যেন তোমাকে বিচলিত না করে, কেননা, একজন শাসকের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে জনগণকে তাদের সংকটের সময় সাহায্য করা।
বস্তুত করদাতাগণ হচ্ছে প্রকৃত সম্পদ এবং যে কোনো বিনিয়োগই তোমার নগরী তথা সমগ্র জনগণের সুখ ও সমৃদ্ধি আনয়নের মাধ্যমে তারা ফিরিয়ে দেবে। তাদের রাজস্বের সাথে সাথে তুমি তাদের ভালোবাসা, সম্মান ও প্রশংসা লাভ করবে। ন্যায় ও সততা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রকৃত তৃপ্তি ও স্বাদ লাভ করবে। এটাই কি স্থায়ী সুখ নয়?
এদেরকে স্বস্তি উপহার দিয়ে তুমি তাদের সমৃদ্ধির সময় তোমার বিনিয়োগটা উদ্বৃত্ত হিসেবে ফেরত পেতে পার এবং প্রয়োজনের সময় তা কাজে লাগাতে পার। তোমার সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ, বদান্যতা, মহানুভবতা ও ন্যায় বিচার এক ধরনের নৈতিক প্রশিক্ষণ হিসেবে কাজ করবে এবং তাদেরকে সভ্যতা ও ন্যায়ের সাথে অভ্যস্ত করে তুলবে। একটি সুখী ও সমৃদ্ধ জনসমষ্টি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে এবং তোমাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা প্রদান করবে।
আসলে এ ধরনের জনগণ হবে তোমার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ। যখন তুমি কোনো অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের মুখোমুখি হবে এবং তাদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে তারা আনন্দের সাথে তোমার বোঝার অংশীদার হবে। একটি সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী যে কোনে বোঝা বইতে পারে। কিন্তু দরিদ্র জনগণ হচ্ছে একটি দেশের অধঃপতন ও ধ্বংসের মূল কারণ।
গভর্নর ও কর্মকর্তাদের অর্থোপার্জনের প্রতি মোহ, সৎ বা অসৎ যেকোনো পন্থায়ই হোক, দারিদ্র্যের একটি কারণ হতে পারে। যদি তারা কেবল তাদের পদ হারাবার ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে তাহলে তারা স্বল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু বাগিয়ে নেয়া সম্ভব তার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করে দেবে। তারা কখনোই বিভিন্ন জাতির উত্থান পতনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না আর আল্লাহর বাণী নিয়ে মাথা ঘামায় না।
অমাত্যবর্গ ও সচিব
অমাত্যবর্গ ও সচিব নিয়োগের ব্যাপারে তোমাকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত ও অন্যান্য গোপনীয় ব্যাপারে তাদের মধ্য থেকে যোগ্যতমদেরই বাছাই করে ঐ দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে।
এ সমস্ত ব্যক্তির নির্বাচনের পর তাদের হাতে তোমার চিঠিপত্র, গোপনীয় দলিলপত্র ও পরিকল্পনার কাজ করিয়ে নাও। তাদেরকে অবশ্যই সৎ, চরিত্রবান, নীতিবান হতে হবে যেন ক্ষমতা ও পদমর্যাদা তাদেরকে জনসমক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে বলতে, তোমার আদেশ উপেক্ষা করতে, মিথ্যা প্রচারণা চালাতে ও প্রয়োজনীয় বিষয়াদি তোমার কাছে হাজির করতে বিলম্ব করবার সাহস তাদের না দেয়।
তারা যেন কিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র ও বিষয়বস্তু নিয়ে অহেতুক বিলম্ব না ঘটায়। যখন কর্মকর্তাবৃন্দ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চুক্তি করতে যায় তুমি লক্ষ্য রাখবে যেন ঐ সমস্ত চুক্তি ত্রুটিহীন হয় এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী না হয়।
রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কোনো চুক্তি বা আলোচনায় যেন তারা না যায়। চুক্তির কাঠামো কিংবা কোনো ষড়যন্ত্রের কারণে যদি রাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হয়ে ওঠে তাহলে এ সমস্ত চুক্তি ও আলোচনাকে বাতিল করে দেবার মতো শক্তি যেন তাদের থাকে।
তোমার সচিবদের অবশ্যই আপন পদমর্যাদার, প্রশাসনে তাদের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত থাকতে হবে, কেননা, যদি কেউ তার আপন অবস্থান ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না থাকে তাহলে সে কখনো অন্যদের সম্পর্কে ধারণা করতে পারবে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নির্বাচনের জন্য তুমি শুধু তোমার আপন বিচারক্ষমতা ও ভালো ধারণার ওপর নির্ভর করলে চলবে না, কারণ, তুমি সামান্য কটি ক্ষেত্রে শুধু তাদেরকে সৎ, বুদ্ধিমান, যোগ্য ও বিশ্বস্ত দেখতে পেয়েছ।
তোমার ভুলে গেলে চলবে না যে, কিছুসংখ্যক লোককে যদিও সৎ ও বিশ্বস্ত মনে হয়, আসলে তারা ধার্মিকতার পোশাকে শাসক ও উচ্চ পদস্থদের হৃদয় জয় করে নেয়। তারা তাঁদের প্রশংসা এবং স্বীকৃতিও লাভ করে যদিও তারা বিচক্ষণ কিংবা বিজ্ঞ কোনোটাই নয়, আর তাদের অন্তরে বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার লেশমাত্র নেই।
কর্মকর্তা বাছাইটা নির্ভর করা উচিত পূর্ববর্তী শাসনামলের সার্ভিস রেকর্ডের ওপর। যোগ্যতা ও সততার সুনামের ওপরেই তোমাদের অধিকতর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
তোমার সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানরূপে নিযুক্ত করবে এমন সব লোককে জটিল সব সমস্যার সমাধানের জন্য যাদের যথেষ্ট জ্ঞান ও প্রজ্ঞা রয়েছে এবং যারা কঠোর পরিশ্রম করতে সক্ষম। সমাজে অবশ্যই তার সততার সুনাম থাকতে হবে।
এমন কাজগুলো আল্লাহ ও যিনি তোমাকে নিযুক্ত করেছেন তাঁর প্রতি তোমার আনুগত্যের নিদর্শন হয়ে দাঁড়াবে। তোমার প্রধান কার্যালয় সচিবালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগে নিয়োজিত ব্যক্তিদের অধিক ক্ষমতাবান করা যাবে না এবং তারা যেন আপন দায়িত্বের চাপেই ন্যুব্জ থাকে।
যদি তোমার কর্মকর্তাদের কোনো ভুলত্রুটি থাকে আর তুমি যদি তার সংশোধনে উপেক্ষা প্রদর্শন করতে থাক তাহলে তাদের সমস্ত ত্রুটি ও অপকর্ম তোমার ওপর বর্তাবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের যাবতীয় কাজের জন্য তোমাকে দায়ী করা হবে।
ব্যবসায়ী ও কারিগর
ক. অর্থনৈতিক প্রশাসক
আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি ব্যবসায়ী, কারিগর ও শিল্পপতিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবার, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার এবং তোমার অফিসারদেরও একই আচরণ করবার নির্দেশ দেয়ার।
তারা হতে পারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা দেশের মধ্যেই ব্যবসা চালায় আর বাকিরা দেশ-বিদেশে আমদানি রপ্তানির কাজে নিয়োজিত থাকতে পারে।
একইভাবে রয়েছে কারিগর, নির্মাণকর্মী ও শিল্পপতিরা। তাদের সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা উচিত এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
তারা সবাই তোমার সহানুভূতি, নিরাপত্তা ও সদাচরণের দাবিদার। তারা হচ্ছে একটি দেশের সম্পদের উতস। তারা যে দ্রব্য সরবরাহ করে, সেটাই জনগণ তাদের অভাব মোচনের কাজে ব্যবহার করে।
এই সমস্ত লোক বহু দূরদেশ হতে দুস্তর-মরু, দুর্লঙ্ঘ গিরি আর দুর্গম পথ- যেখানে সাধারণ মানুষ যেতে সাহস পায় না সেখান থেকে পণ্যসামগ্রী বয়ে নিয়ে আসে।
সাধারণভাবে তারা একটি শান্তিপ্রিয় ও আইনানুগত সম্প্রদায়, তারা সাধারণত দুষ্কৃতি ও ধ্বংসকর কাজে লিপ্ত হয় না।
সুতরাং তারা দেশের অভ্যন্তরের হোক কিংবা বাইরের হোক তুমি তাদের সুবিধার দিকে নজর দেবে।
খ. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তদারক
ব্যবসায়ী ও কারিগরদের সম্পর্কে আরেকটা দিক তোমাকে আমার স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। তাদের প্রতি সম্পূর্ণ সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করার সাথে সাথে তুমি তাদের প্রতি একটি সজাগ দৃষ্টি রাখবে, যেহেতু তারা প্রায়শ চরম স্বার্থপর ও সাংঘাতিক কৃপণ, সম্পদলিপ্সু এবং মজুতদারির প্রবণতাসম্পন্ন।
তাদের মধ্যে রয়েছে মজুতদাররা। মজুতদারি ও কালোবাজারির মাধ্যমে এসব মজুতদার জনগণের জন্য দারিদ্র্য ডেকে আনে এবং প্রশাসক ও কর্মকর্তাদের দুর্নাম সৃষ্টি করে।
সুতরাং তুমি অবশ্যই মজুতদারি ও কালোবাজারির সমাপ্তি আনবে যা মহানবী (সা.) ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের দ্বারা নিন্দিত ও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।
কোনো রকমের বিঘ্ন ছাড়া ক্রয়-বিক্রয়ের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। সমগ্র দেশের জন্য তোমার ওজন ও মাপের একক থাকতে হবে। এমন কোনো আইন বা শর্ত থাকা উচিত নয় যাতে ভোক্তা বা সরবরাহকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাদের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার এবং পর্যাপ্ত সুবিধা দেয়ার পরও যদি তোমার আদেশ লঙ্ঘন করে ব্যবসায়ী, কারিগর ও নির্মাতারা মজুতদারি ও কালোবাজারির আশ্রয় নেয় তাদের বিচার ও সাজা হওয়া আবশ্যক। কিন্তু সেখানে শাস্তিটা হবে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে এবং কোনোক্রমেই যেন তা সভ্যতা ও ন্যায়ের সীমা না ছাড়িয়ে যায়।
সমাজের বঞ্চিত ও মুস্তাযআফিনদের অধিকার
বঞ্চিত ও দরিদ্রদের ব্যাপারে আমি তোমাকে সাবধান করে দিতে চাই। আল্লাহকে ভয় কর এবং দরিদ্রদের অবস্থা ও তাদের প্রতি তোমার মনোভাবের ব্যাপারে যত্নবান হও। এই সমস্ত লোকের কোনো সম্পদ নেই, সুযোগের অবারিত দ্বার নেই, তাদের কোনো সহায়ও নেই।
এই শ্রেণিটা হচ্ছে দুস্থ, দরিদ্র, ভিক্ষুক, অসুস্থ ও সহায়হীন যারা হয় ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়েছে কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু আছেন যাঁরা আত্মসম্মানবোধের খাতিরে ভিক্ষার আশ্রয় নেন না, কিন্তু তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা আরো করুণ।
মালিক, কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে একজন শাসকের জন্য তুমি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্ব হিসেবে তাদের নিরাপত্তা দেবে এবং তাদের অধিকার রক্ষা করবে।
রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তুমি তাদের জন্য একটি অংশ নির্ধারণ করে দাও। এই অর্থ সাহায্য ছাড়াও রাষ্ট্রীয় জমিতে উতপন্ন ফসলের একাংশ তুমি তাদের জন্য নির্ধারণ করে দেবে।
মনে রাখবে যে, এই সমস্ত উদ্বৃত্ত ভাণ্ডারে দূরত্ব নির্বিশেষে সকল বাসিন্দার অংশ সমান।
আমি আবারো তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, দরিদ্রদের অধিকার সংরক্ষণ এবং তাদের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব তোমার। খেয়াল রাখবে যে, পদমর্যাদা ও সম্পদের জিম্মাদারিত্ব তোমাকে তোমার গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র দায়িত্বগুলো সম্পর্কে অন্ধ করে না দেয়।
তোমার পদটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, তুমি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলি নিয়ে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও এবং তাতে সফল হবার পরও সামান্য ভুলত্রুটির জন্য তোমাকে ক্ষমা করা হবে না।
অতএব, দরিদ্রের কল্যাণের ব্যাপারে তোমার সতর্ক থাকতে হবে আর কখনোই অহংকার ও ঔদ্ধত্যের বশে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না।
যারা সহজেই তোমার কাছে আসতে পারে না তাদের বিষয়ে অবশ্যই তুমি যত্নবান হবে। তারা হচ্ছে এমন সব ব্যক্তি সমাজ যাদেরকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দেখে, যাদের দারিদ্র্য ও অসুস্থতা তোমার চোখে বিস্বাদ ঠেকতে পারে। এসব দুর্ভাগা লোকের জন্য তোমাকে হওয়া উচিত ভালোবাসা, স্বস্তি ও শ্রদ্ধার উতস।
কেবল তাদের ওপরে আস্থা স্থাপন করবে যারা ধর্মপ্রাণ, মুত্তাকী এবং শোষিতের স্বার্থে আন্তরিকতাপূর্ণভাবে নিবেদিত এবং যারা তোমাকে তাদের সম্পর্কে অবগত রাখবে।
এ সমস্ত দুর্ভাগার প্রতি অবশ্যই তোমাকে ভালো ব্যবহার করতে হবে যেন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য যখন তুমি লাভ করবে তখন তোমার আচরণ সম্পর্কে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পার।
মনে রাখবে যে, মানবতার এ শ্রেণিটিই তোমার নাগরিকদের মধ্যে সর্বাধিক সহানুভূতি লাভের উপযুক্ত। সুতরাং তাদের প্রতি বিশ্বস্ত ও সম্পূর্ণভাবে কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে তুমি তোমার স্রষ্টার সম্মুখে মুখ উজ্জ্বল করে দাঁড়াতে পারবে।
অধিকাংশ শাসকের কাছেই এসব দায়িত্ব প্রতিপালন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। যারা আল্লাহর পথে চলে এবং তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করে আল্লাহ তাদের কাজকে সহজ করে দেন।
তারা একটি দায়িত্ববোধ ও আনন্দ নিয়ে তাদের কর্তব্য সমাধা করে। তারা তাদের কাজে আনন্দ পায় এবং আল্লাহর প্রতিজ্ঞায় তাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
ন্যায় বিচারক হিসেবে নেতার ভূমিকা
অন্যান্য কাজের ফাঁকে কিছুটা সময় তুমি দরিদ্র ও মজলুমদের জন্য বরাদ্দ করে রাখ এবং তোমার সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ শুনবার ব্যবস্থা কর।
এই শ্রুতির সময় আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি তাদের সাথে দয়া, সৌজন্য ও সম্মানের সাথে ব্যবহার কর। তোমার সরকার ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তারা যেন খোলাখুলিভাবে নিংসঙ্কোচে তাদের বক্তব্য পেশ করতে পারে তার স্বার্থে তোমার কর্মচারী, সৈনিক বা প্রহরীকে ঐ সময় সেখানে উপস্থিত থাকতে দিও না।
এটা তোমার প্রশাসনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আমি মহানবীকে বলতে শুনেছি, ‘ঐ সব সরকার ও ব্যক্তি মুক্তি অর্জন করতে পারে না যাদের মাধ্যমে দরিদ্র ও দুঃস্থদের অধিকার শক্তিমানদের হাত থেকে রক্ষিত হয় না।’
এসব আসরে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ও দুঃস্থরা মিলিত হবে। তাদের মধ্যে ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের কমতি থাকলে তাদের প্রতি কড়া বাক্য কিংবা বিব্রতকর উক্তি প্রয়োগ কর না। তাদের প্রতি রুক্ষ ব্যবহার করে তোমার দম্ভ বা সংকীর্ণ মানসিকতা প্রদর্শন কর না।
তুমি যদি তাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হও তাহলে দয়াময় আল্লাহ তোমাকে তোমার আনুগত্যের জন্য বিরাট পুরস্কার প্রদান করবেন। তাদের অভিযোগ মনোযোগের সাথে শোন এবং তাদের প্রতি সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার কর।
যদি তুমি তাদের প্রতি ‘না’ বলতে বাধ্য হও তাহলে তুমি তোমার অক্ষমতা এমন মধুরভাবে বলবে এবং এতটা সৌজন্য প্রকাশ করবে যে, তোমার ‘না’ বলাটা তাদের কাছে ‘হ্যাঁ’ বলার মতোই সুখকর ঠেকবে। তোমার প্রত্যেকটি সাহায্য ও উপহারই আন্তরিকতাপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন।
এমন কিছু বিষয় থাকবে যেগুলো তোমার কোনো অফিসারই করতে সক্ষম হবে না, এগুলো তুমি নিজেই সম্পন্ন করবে। তোমার প্রতিনিধি ও প্রশাসকদের প্রতি উত্তর দেয়াটা, যেগুলো তোমার সচিবদের ক্ষমতার বাইরে, সেগুলো এর অন্তর্ভুক্ত।
যখন তুমি অনুভব করবে যে, তোমার অফিসাররা জনগণের অভাব-অভিযোগের প্রতি ততটা সচেতন বা আগ্রহী নয়, তখন তুমি নিজেই এতে আপন মনোযোগ নিবদ্ধ করবে।
প্রতিটি দিনের জন্যই তোমার কিছু আবশ্যকীয় দায়িত্ব থাকবে, সুতরাং দিনের কাজ দিনেই করবে।
প্রতিটি দিনই তোমার জন্য কিছু বিশেষ দায়িত্ব থাকবে। সময়ের শ্রেষ্ঠতম অংশটি তোমার স্রষ্টা ও তোমার নিজের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যয় কর।
খেয়াল রাখবে যেন রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। যদি তোমার কাজের মধ্যে তোমার স্বচ্ছ বিবেক কাজ করে তবেই তোমার জনগণ সুখী জীবন যাপন করবে।
নিয়মিত ইবাদত
তোমার নামায যেন তোমার এসব আবশ্যকীয় কাজের তালিকায় থাকে যেগুলো তুমি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে থাক। দিবারাত্রিকালীন ইবাদতের জন্য তোমার অবশ্যই একটি সময় নির্দিষ্ট থাকতে হবে।
তুমি অবশ্যই একনিষ্ঠ ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে তোমার শরীর থেকে ট্যাক্স আদায় করে নেবে। আন্তরিকতাপূর্ণ ও একনিষ্ঠ ইবাদত তোমাকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে।
শরীরের ওপর দিয়ে যত ধকলই যাক না কেন তুমি তোমার কর্তব্যগুলোকে অসম্পূর্ণ ও অবিন্যস্ত থাকতে দেবে না।
যখন তুমি ইমামতি করতে যাবে তখন লক্ষ্য রাখবে যেন তোমার নামায এতটা দীর্ঘ না হয় যাতে তোমার মুক্তাদিরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে কিংবা এতটা সংক্ষিপ্ত না হয় তাতে ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা থেকে যায়।
যখন নবীজী আমাকে ইয়েমেনে পাঠালেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে, কীভাবে ইমামতি করতে হয়। তিনি বলেছিলেন : ‘একজন বয়োবৃদ্ধ ও দুর্বল লোকের মতো নামায পড় এবং ঈমানদারের প্রতি হৃদয়বান হও।’ (যাতে দুর্বল ও বৃদ্ধ লোকেরা তোমার পেছনে সহজভাবে নামায পড়তে পারে।)
জনগণের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ
তুমি কোনোক্রমেই নিজেকে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে না। তুমি ও তোমার জনগণের মধ্যে একটি মর্যাদার পার্থক্য সৃষ্টিকারী ব্যূহ রচনা কর না।
এ ধরনের অহংকার হচ্ছে আসলে অন্তঃসারশূন্যতা, দুর্বলতা ও হীনমন্যতাবোধের বহিঃপ্রকাশ যা তোমাকে নাগরিকদের অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ রাখবে এবং এ ছাড়াও তোমাকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার পটভূমি সম্পর্কে অন্ধ করে তুলবে।
ফলে তুমি বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনাবলির আপেক্ষিক গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হবে এবং ছোট বিষয়কে বড় ও বড় বিষয়কে ছোট করে দেখা আরম্ভ করবে। এ ছাড়াও তুমি মাঝারি যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করে গুরুত্বপূর্ণ লোকদের উপেক্ষা করতে পার।
সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে তুমি দোষ ও গুণের মধ্যকার পার্থক্যবোধ বিস্মৃত হতে পার, খারাপকে ভালো আর ভালোকে খারাপ মনে করতে পার কিংবা দুটি গুলিয়ে ফেলতে পার, ফলে সত্যটা দ্ব্যর্থবোধক হয়ে গিয়ে একটির স্থলে সহজেই অপরটি প্রতিস্থাপিত করা হতে পারে।
আসলে অন্য যে কোনো মানুষের মতোই সে একজন মানুষ আর তাই সে সাধারণ জনগণ যে জিনিসকে তুলে ধরতে চায়, কিন্তু অফিসাররা যেটা গোপন রাখতে চেষ্টারত সে বিষয়টি সম্পর্কে অসচেতন থেকে যেতে পারে।
এভাবে সত্য মিথ্যার সাথে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারে। আর যেহেতু সত্যের কোনো আলাদা রং নেই তাই একে মিথ্যা থেকে কিছুতেই আলাদা করা না-ও সম্ভব হতে পারে।
সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য সত্যকে খুঁজতে হবে এবং কাহিনীর স্তূপ থেকে বাস্তবকে খুঁজে বের করতে হবে। কেবল এভাবেই সত্যকে পাওয়া সম্ভব।
নিজের সম্পর্কে গভীর চিন্তায় মগ্ন হও। তুমি কেবল দু’ধরনের শাসকের শ্রেণিতে পড়তে পার। সৎ, পরিশ্রমী, খোদাভীরু, সাম্য ও ন্যায়ের নীতির ওপর দৃঢ়, সঠিক সময়ে সঠিক কাজ সম্পাদনকারী, অপরের অধিকারের সংরক্ষক এবং তোমার ওপর অর্পিত সমস্ত দায়িত্ব পালনকারী।
তাই যদি হয়, তাহলে কেন তুমি নিজেকে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে আর নিজের চারপাশে বাধার প্রাচীর গড়ে তুলবে?
অপর শ্রেণির প্রশাসক কৃপণদের শ্রেণি, যারা অপরের অধিকার স্বীকারে অনিচ্ছুক, তাদের অন্তর্ভুক্ত হলেই কেবল তা তুমি করতে পার। তুমি কি নীচতার শিকার?
যদি তাই হয়ে থাকে তোমার মনে রাখা উচিত যে, জনগণ তোমার আচরণ ও মনোবৃত্তি জানতে সক্ষম হবে, তারা শুধু প্রথম কয়েক দিনের জন্যই তোমার কাছে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে কোনো আবেদন বা অনুরোধ নিয়ে আসবে না।
এ কথা ভুলে যাবে না যে, তোমার বিবেচনার জন্য পেশ করা অধিকাংশ আবেদন তাদের স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত নয়। এগুলো হবে জনগণের অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কিত এবং জুলুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও সততা, ন্যায়নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আবেদন। তাহলে কেন তুমি তাদের অভিযোগ শোনা এড়িয়ে চলবে?
নেতার আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধব
এটা ভুললে চলবে না যে, মাঝে মাঝে শাসকদেরও আপন আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জন থাকে যারা তাঁকে ঘিরে তাদের সম্পর্কের সুবিধা আদায় করতে চায়। তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা চক্রান্ত, ধোঁকাবাজি, দুর্নীতি ও জুলুমের আশ্রয় নিতে পারে।
তাদের কাউকে যদি তুমি কাছে দেখতে পাও তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবেই তারা তোমার সাথে সম্পর্কিত হোক না কেন তাদের তাড়িয়ে দাও।
দুষ্কৃতির গোড়া এবং আগা দুটিই তোমাকে সমূলে উতপাটন করে ফেলতে হবে। কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করে তোমার আশেপাশের এসব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আবর্জনা সাফ করে ফেলতে হবে।
তোমার সমর্থক ও আত্মীয়দেরকে কখনো ভূমির স্থায়ী ইজারা বা মালিকানা প্রদান করবে না। পানির উতসগুলো এবং সমাজের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় জমিগুলোকে কিছুতেই তাদের জন্য বন্দোবস্ত করে দেবে না।
যদি তারা এ ধরনের সম্পদের অধিকার পেয়ে বসে স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের প্রতিবেশীদের বা তাদের অংশীদারদের সেচ সুবিধায় হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে তা থেকে সমস্ত অবৈধ মুনাফা লাভ করে তোমার জন্য এ দুনিয়ার জীবনে দুর্নাম ও অপমান এবং পরবর্তী জীবনের জন্য শাস্তি বয়ে নিয়ে আসবে।
যথাযোগ্য ন্যায়বিচার কর। যারা শাস্তির উপযুক্ত তাদের শাস্তি দাও, তারা তোমার আত্মীয়ই হোক বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুই হোক, তোমাকে অবশ্যই দৃঢ় ও সতর্ক থাকতে হবে। অন্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি তোমার আপন লোকজনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতে ভ্রুক্ষেপ কর না। এ ধরনের কাজ তোমার জন্য বেদনাদায়ক হতে পারে। এ ধরনের দুঃখ ও বেদনা সহ্য কর এবং পরবর্তী জগতে যে কল্যাণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে তার প্রত্যাশা করতে থাক। এগুলো কষ্টকর মনে হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই তোমার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে নেতার করণীয়
যদি তোমার কয়েকটি কড়া পদক্ষেপের কারণে তোমার নাগরিকরা ভুল করে তোমার ওপর ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনে তাহলে তুমি কালবিলম্ব না করে তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করার জন্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহকারে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করবে, যেন তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এটা একদিকে তোমার মানসিক প্রশান্তি অপরদিকে জনগণের প্রতি আন্তরিক দরদ ও সহানুভূতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হবে। তোমার প্রতি তাদের এ আস্থাবোধই তাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করবে আর এভাবেই তুমি সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের সমর্থন লাভের লক্ষ্যে উপনীত হতে পারবে এবং কল্যাণের পথে তাদেরকে পরিচালিত করার জন্য সন্তুষ্টি ও পরিতৃপ্তি লাভ করবে।
শান্তি ও সন্ধি
তোমার শত্রুদের পক্ষ থেকে আসা কোনো শান্তির আহ্বানই তুমি প্রত্যাখ্যান করবে না, যদি তা আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তোষের পরিপন্থী না হয়।
এ ধরনের শান্তি ও সন্ধি তোমার সেনাবাহিনীর জন্য বিশ্রাম ও স্বস্তি এনে দেবে, এটা তোমাকে উদ্বেগ ও আশঙ্কা থেকে মুক্ত করবে এবং দেশ ও জনগণের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি আনয়ন করবে।
কিন্তু একই সাথে এ ধরনের চুক্তির পর তুমি সবসময় সতর্ক থাকবে এবং তোমার শত্রুদের প্রতিশ্রুতির ওপর খুব বেশি আস্থা স্থাপন করবে না। তারা তোমাকে ধোঁকা দিয়ে তাদের প্রতি তোমার অতিরিক্ত আস্থাশীলতার ফায়দা লুটে নেয়ার চক্রান্তও এঁটে রাখতে পারে।
অতএব, তোমার সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত এবং অতিরিক্ত বিশ্বাস স্থাপন এড়িয়ে চলা উচিত।
তা সত্ত্বেও তুমি কখনই তোমার কথা থেকে ফিরে যাবে না এবং তোমার প্রস্তাবিত সহযোগিতা ও নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে। সন্ধির শর্ত তোমার ভঙ্গ করা উচিত নয়। জীবনের যে কোনো হুমকির বিনিময়েও প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন কর না, যত কঠিন ঝুঁকিই নিতে হোক না কেন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে প্রতিশ্রুতি মেনে চল।
মনে রাখবে যে, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সমস্ত দায়িত্বের মধ্যে আমাদের প্রতিজ্ঞা পালনের মতো আর কোনোটাই এত গুরুত্বপূর্ণ ও তাঁর নিকট তাৎক্ষণিক গ্রহণযোগ্য নয়।
মানুষের মধ্যে আদর্শের পার্থক্য থাকতে পারে, দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও সবাই স্বীকার করে যে, যে কোনো মূল্যেই হোক না কেন প্রতিজ্ঞা অবশ্য পালনীয়।
শুধু মুসলমানরাই নয়, এমনকি কাফেররাও এর মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে অনুধাবন করার কারণে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাকে তাদের আবশ্যিক কর্তব্য বলে ভাবত।
সুতরাং তুমি তোমার সম্পাদিত সন্ধি, চুক্তি ও প্রতিজ্ঞাসমূহ পালন করার ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হও।
শত্রুপক্ষের প্রতি পূর্বাহ্নে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ বা চরমপত্র না দিয়ে কখনই আক্রমণ করতে যাবে না।
মনে রাখবে যে, এমনকি শত্রুপক্ষের সাথেও প্রবঞ্চনা করার অর্থ আল্লাহর সাথে চাতুরি করা। এর মানে হচ্ছে, আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা আর একজন ঘৃণ্য মূর্খ ছাড়া অন্য কেউ এমন গ্লানিময় যুদ্ধে জড়াবে না।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ প্রতিজ্ঞা, চুক্তি ও সন্ধিকে পবিত্র করে দিয়েছেন, যেহেতু এগুলো মানব জাতির মধ্যে শান্তি আনে। এগুলো হচ্ছে সমস্ত মানুষের সর্বজনীন মতাদর্শ ও সর্বজনীন প্রয়োজনীয়তা।
আল্লাহ শান্তিকে প্রত্যেকের জন্যই একটি আশ্রয় ও একটি নিরাপত্তা বানিয়ে দিয়েছেন, তাই কোনো চুক্তি বা সন্ধিতে স্বাক্ষর করার সময় কোনো মতলব বা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিও না এবং তার মধ্যে নতুন কোনো অর্থ খুঁজে আনতে যেও না।
তোমার চুক্তিগুলোতে এমন দ্ব্যর্থবোধক কথা ব্যবহার কর না যার দুই ধরনের ব্যাখ্যা থাকতে পারে। সন্ধিটি হবে স্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত, সুনির্দিষ্ট এবং অস্পষ্টতা হতে মুক্ত।
নেতার ব্যক্তিগত ও সামাজিক কর্তব্যের রূপরেখা
অহেতুক রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে সাবধান হও। মনে রাখবে যে, একজন নির্দোষ ব্যক্তির রক্তপাত ঘটানোর চেয়ে আর কিছুই আল্লাহর রহমত থেকে তোমাকে বঞ্চিত করতে, তাঁর শাস্তির পাত্রে পরিণত করতে, আয়ু কমিয়ে দিতে এবং একইভাবে তোমাকে তাঁর রোষানলে জ্বালাতে এত দ্রুত নয়।
হাশরের দিন আল্লাহ সর্বপ্রথম মানুষ কর্তৃক মানুষের রক্তপাত ঘটানোর হিসাব নেবেন।
সুতরাং তুমি নির্দোষ রক্তপাত ঘটিয়ে তোমার সরকারকে শক্তিশালী এবং তোমার ক্ষমতাকে সুসংহত করতে যেও না। এ ধরনের কাজ তোমার সরকারকে দুর্বল ও ধ্বংস করে দেবে, এমনকি তোমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।
যদি তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা কর, তুমি আল্লাহর সম্মুখে, আমার বা অন্য কারো কাছে এর কোনো কৈফিয়ত দিতে পারবে না। কেননা, এ ধরনের অপরাধের শাস্তি অত্যন্ত জরুরি এবং তা অবশ্যই মৃতুদণ্ড।
যদি একজন মানুষকে তুমি অনিচ্ছাকৃতভাবে হত্যা কর, কিংবা বিধিসম্মত শাস্তি প্রদানের সময় তোমার চাবুক, তরবারি বা হাত ভুলক্রমে কারো হত্যার জন্য দায়ী হয়, কিংবা কানের মধ্যে সামান্য একটি শক্তিশালী চড় বা ঘুষিতে কেউ নিহত হয় তাহলে তার উত্তরাধিকারীদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে যত্নবান হও। সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে তোমার পদমর্যাদা যেন বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।
আত্মপ্রশংসা ও আত্মগৌরবকে তোমার অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।
তোমার ভালো কাজগুলোর জন্য আপন প্রকৃতির মধ্যে যে সাধারণ গুণ প্রত্যক্ষ কর তার জন্য অহংকার বোধ করো না।
চাটুকারিতা ও মিথ্যা স্তুতি যেন তোমাকে আত্মাভিমানী করে না তোলে।
মনে রেখ, তোমার চোখে যেগুলো ভালো লাগে সেগুলোর ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ো না এবং নিজের সম্পর্কে অতিরঞ্জিত প্রশংসার প্রতি তোমার যেন অনুরাগ না থাকে; কেননা, তা নিজেই শয়তানের একটি বড় সুযোগ, যা দ্বারা সকল সৎকর্মশীলের সৎকর্মকে বিলীন করে দেয়।
জনগণকে তাদের প্রতি কৃত তোমার দয়া ও দাক্ষিণ্যের কথা মনে করিয়ে দিতে যেও না এবং তাদেরকে তা অনুভব করানোরও চেষ্টা কর না।
তোমার সম্পাদিত কার্যাবলি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামিও না, নিজেই নিজের ভালো কাজের প্রদর্শনী কর না আর কখনো তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ কর না। এগুলো হচ্ছে মানবপ্রকৃতির জঘন্যতম দিক, এগুলো অপরের প্রতি তোমার ভালো কাজের সুফল নষ্ট করে দেবে। আপন কার্যাবলির প্রদর্শনী মানুষকে আল্লাহর হেদায়াত থেকে বঞ্চিত করে দেয়।
প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ব্যক্তিকে জনগণের কাছে ঘৃণ্য এবং আল্লাহর কাছে শাস্তির যোগ্য করে তোলে। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন : ‘ঐসব কথা বলা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় যেগুলো তোমরা নিজে কর না।’
সময় আসার আগেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে তড়িঘড়ি করলে চলবে না। আবার সময় যখন আসে তখন সিদ্ধান্ত ও কাজের ব্যাপারে বিলম্ব কর না।
একটি জিনিসের মধ্যে যখন খুঁত পাবে তখন তা করার জন্য জোর কর না। আবার যখন তুমি তোমার কাজের ত্রুটিহীনতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত তখন আর মোটেও বিলম্ব করবে না।
মোদ্দা কথা প্রতিটি কাজ তুমি যথাসময়ে, যথার্থ প্রক্রিয়ায় এবং যথাস্থানে করার ব্যাপারে যত্নবান হবে।
যেটাতে সবার সমান অধিকার রয়েছে কখনো তা নিজের জন্য সংরক্ষিত করে রাখবে না।
যেহেতু তোমাকেই সবার অধিকার হরণের জন্য দায়ী করা হবে তাই সব সময় তোমার কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অন্যায় ও অপরের অধিকার হরণের ব্যাপারে সজাগ থাকবে।
তোমার কুশাসন শীঘ্রই জনগণের চোখে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়বে এবং অসহায় ও মযলুমদের প্রতি কৃত অন্যায়ের জন্য তোমার কৈফিয়ত তলব এবং তোমাকে শাস্তি প্রদান করা হবে।
অহংকারের প্রতি দুর্বলতা, ক্রোধ এবং ঔদ্ধত্য প্রবণতার ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ কর।
শাস্তি দেবার সময় তোমার হাত সম্পর্কে এবং গালমন্দ করার সময় তোমার জিহ্বার তীক্ষ্ণতা সম্পর্কে সাবধান হও।
এটা অর্জন করার শ্রেষ্ঠতম উপায় হচ্ছে মন্তব্য প্রয়োগের সময় ধীর ও সতর্ক হওয়া যাতে তুমি মাথা ও মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে পার।
এটা অর্জন করা কঠিন যদি তোমার পালনকর্তার কাছে অবশ্যম্ভাবী প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি তোমার দৃষ্টির সামনে বর্তমান না থাকে এবং তাঁর ভয় তোমার প্রতিটি বিবেচনায় প্রাধান্য বিস্তার না করে। দায়িত্ব গ্রহণে তোমার ক্রমবর্ধমান আগ্রহ তোমাকে তোমার এ লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য ব্যাপক সহায়তা দেবে।
পূর্বতন সরকারগুলোর দ্বারা কৃত ন্যায়নীতি ও ইনসাফের ভিত্তিতে করা সুকর্ম, সমাজের কল্যাণে তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান, তাদের আইন ইত্যাদি তোমার অবশ্যই মনে রাখতে হবে। পবিত্র কুরাআনে বিধৃত আল্লাহর আদেশগুলো এবং মহানবী (সা.)-এর হাদীসগুলো সবসময় স্মরণ রাখবে। আমাকে যেভাবে করতে দেখেছ আর বলতে শুনেছ ঠিক সেভাবে তাঁদেরকে অনুসরণ করবে।
একইভাবে এ নসিহতনামায় আমি তোমাকে যা দেখাবার প্রয়াস পেয়েছি তা তোমাকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, যেন তুমি অধঃপাতে না যাও, প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকতে পার এবং সত্যের পথে সুদৃঢ় থাকতে পার। যদি তুমি বিপথে যাও তাহলে খোদার সামনে তুমি কোনো ক্ষমা পাবে না।
পরিসমাপ্তি দোয়া
পরম করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে এ দোয়া করছি তিনি যেন আমাকে ও তোমাকে তাঁর হেদায়াতের পথে সুদৃঢ় থাকার তাওফিক দান করেন, তাঁর ইচ্ছা ও জনগণের সন্তুষ্টি সাধনই যেন আমাদের যাবতীয় কাজের লক্ষ্য হয়, আমরা যেন ন্যায়ানুগ ইনসাফভিত্তিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে এমন একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি যা সারা দুনিয়ার মানুষের অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়।
তাঁর অশেষ দয়া ও রহমত আমাদের ওপর বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ! আমাদেরকে শহীদ হবার সৌভাগ্য নসিব করুন। কেননা, একমাত্র আপনারই দিকে আমাদের নিশ্চিত প্রত্যাবর্তন। মহানবী, তাঁর বংশধর ও তাঁর অনুসারীদের ওপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।
অনুবাদ : মনজুর আলম 
সুপ্রিয় পাঠক,হজরত আলীর(আঃ) মত প্রশাসনিক নির্দেশমালা হজরত আবুবকর(রাঃ),উমর (রাঃ) ও উসমান কোন গভর্নরকে কি কখনও দিয়েছিলেন ?কেউ কি দেখাতে পারবেন ?

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This
Previous Post
Next Post

0 comments: