মানুষ একটি অদ্ভূত প্রানী। খারাপ কাজের পরিনতি
খুব ভাল করে জানার পরও ইচ্ছা করে সে নিজেই নিজের ক্ষতি করে। সে জানে
কাজটা খারাপ, তারপরো সে সেটা থেকে বের হতে পারেনা। অগনিত সৃষ্টির মধ্যে
একমাত্র মানুষকেই দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তা, তারপরও দেখা যায়
অধিকাংশ মানুষ তার বুদ্ধি ব্যবহার করেনা, চিন্তা করেনা। জন্তু-জানোয়ারের
মতন নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে থাকে আজীবন।
অসীম দয়ালু আল্লাহ্ আমাদেরকে যা যা করতে মানা করেছেন, তার প্রত্যেকটা শুধুই আমাদের ভালর জন্য।
সত্যি বলতে কি, শুনতে যতই খারাপ লাগুক, কিন্তু এটা বাস্তবতা যে,
হালাল-হারাম শব্দগুলোকে এখন আর আমরা পাত্তা দেইনা। পাত্তা না দিতে দিতে এখন
কোনটা যে হালাল আর কোনটা যে হারাম সেটাও আমরা এখন আর পরিষ্কারভাবে বুঝিনা।
যেটা আমাদের ভাল লাগে সেটা আমরা করি, যেটা লাগেনা সেটা করিনা। মানুষের
স্বভাবই হচ্ছে যেসব কাজ করতে আমাদের ভাল লাগে সেগুলোর পক্ষে যুক্তি খুজে
বের করা ও সেগুলোর বিপক্ষের যুক্তি এড়িয়ে চলা।
এই আর্টিকেলটির বিষয় “সিগারেট” । এটা এমন
একটি অপরাধ যা আমাদের সামাজিক জীবনে ডাল-ভাতের মতই সহজ ব্যাপার । গলিতে
গলিতে সিগারেট, মোড়ে মোড়ে সিগারেট। কিশোর যুবক বৃদ্ধ সবার হাতে হাতে
সিগারেট। এটা এতই ভয়ানক একটি ব্যাধি হয়ে গিয়েছে এখন যে, আমাদের মধ্যে এমন
একজনও নেই যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিগারেট থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না।
আপনি কি এমন কোন মুসলিমকে চেনেন যে প্রায়ই শূকরের মাংস দিয়ে ভাত খায়? না,
আপনি চিনেন না। আমিও চিনিনা। যদিও ঢাকায় এটা পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি কি এমন
কোন মুসলিমকে চিনেন, যে নিয়মিত সিগারেট খায় ? আপনি নিশ্চয়ই উত্তরটা জানেন
।
এই আর্টিকেল এ যে বিষয়গুলো দেখানো হয়েছে –
- কুর’আনে আল্লাহ কি বলেছেন
- সেখান থেকে স্কলাররা কি সিদ্ধান্তে এসেছেন
- আধুনিক বিজ্ঞান গবেষনা করে কি কি তথ্য বের করেছে
- মানুষ কি কি কারনে সিগারেট খাওয়া শুরু করে তারপর সেটা আর ছাড়তে পারেনা।
- সিগারেট কিভাবে শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটা অংশের ক্ষতি করে।
[] সিগারেট কি হালাল নাকি হারাম নাকি মাকরুহ ?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের একজন প্রফেসর বলেছিলেন- Smokers are the most notorious liars । পৃথিবীর সব স্মোকার-রাই অগনিত অজুহাত দিতে জানে। তার কয়েকটি এরকম-
– আরে আমি তো মাঝে মাঝে খাই। আমার
সেলফ-কন্ট্রোল খুবই ভাল। এইতো পুরো ৩ মাস না খেয়ে থাকলাম। আমার ক্ষেত্রে
এটা নেশা না, এটা বদ অভ্যাস। নেশা করা হারাম, এটা আমিও জানি। কিন্তু আমার
যেহেতু নেশা হয়না, তাই আমার ক্ষেত্রে এটা “অতটা হারাম” না। ( এই ধরনের
মানুষেরা সেলফ-কনভিনসিং এর চরম পর্যায়ে চলে গেছেন।)
– সিগারেট ছাড়া কোন ব্যাপার নাকি ? আমি তো ২০ বার ছাড়লাম এখন পর্যন্ত ( অট্টহাসি) ।
– কমিয়ে দিচ্ছি ভাই। এই তো, সামনেই ছেড়ে দিব। ( এই একই কথা এরা ১০ বছর ধরে বলে যাচ্ছে )
– আমি যতটুকু সিগারেট খাই, তাতে আমার শরীরের
তেমন কোন ক্ষতি হয়না। (মানব শরীরের উপর সিগারেটের ক্ষতি সম্পর্কে
তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নাই। শরীরের ভেতর কি কি ঘটনা ঘটে সেটাও এরা
জানেনা। )
– হায়াত মউত আল্লাহর হাতে ভাই। আর বাঁচবই বা
কয়দিন বলেন? এত হিসাব করে কি হবে? নন-স্মোকাররা মরে না? প্রতিদিন
রাস্তাঘাটে কি পরিমান ধোয়া খাচ্ছি দেখেন না? সেটা কি সিগারেটের চেয়ে কম
খারাপ? (এদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না একদম। )
– (হঠাৎ রেগে উঠে) আপনার বাপের টাকায় সিগারেট খাই নাকি আমি ? আমার শরীর নিয়ে আমি যা ইচ্ছা তাই করব। যান নিজের রাস্তা মাপেন।
কুর’আনে খাবারের বিধি-নিষেধ বিষয়ে কয়েকটা আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-
“তারা তোমাকে( মুহাম্মাদ সাঃ) জিজ্ঞেস করে তাদের জন্য কি কি হালাল করা হয়েছে। তুমি বল- ‘ তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে সকল তায়্যিবাত। …” (কুর’আন ৫ঃ৪)
“আজকের দিনে সকল তায়্যিবাত-কে হালাল করা হল। …” (কুর’আন ৫ঃ৫ )
“তিনি(মুহাম্মাদ সঃ) তাদের নির্দেশ দেন সৎকর্মের এবং নিষেধ করেন অসৎকর্ম থেকে। তাদের জন্য যাবতীয় তায়্যিবাত কে হালাল ঘোষনা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ….।” (৭ঃ১৫৭)
সবগুলো আয়াতে আল্লাহ একটাই শব্দ বলেছেন- তায়্যিবাত।
তায়্যিবা মানে “ভাল ও পবিত্র” । কাজেই সোজা কথা হচ্ছে, যে খাবার আমাদের
জন্য ভাল না, পবিত্র না, আমাদের ক্ষতি করে, সেটা অবশ্যই আমাদের জন্য
নিষিদ্ধ।
আল্লাহ্ আরো বলেছেন-
সূরা বাকারা। আয়াত ১৯৫(আংশিক)-“Do not make your OWN hands the cause of your OWN destruction…” ( ২ঃ১৯৫)সূরা নিসা। আয়াত ২৯ (আংশিক)-
” তোমরা নিজেদের হাত দিয়ে নিজেদেরকে ধ্বংস কোরনা…”
“And Do not Kill Yourselves (Nor kill one another)” (৪ঃ২৯)
” আর নিজেদেরকে হত্যা কোরনা…”
কাজেই যদি বৈজ্ঞানিক তথ্য ও যুক্তি দিয়ে দেখান যায় যে –
– সিগারেট কোন “তায়্যিব” খাবার নয়। এটা ভাল বা পবিত্র কোনটাই নয়।
– এটার ভাল দিক ০%। খারাপ দিক ১০০%।
– সিগারেট খাওয়া আর নিজের শরীরকে ধ্বংস করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
তাহলে নিশ্চয়ই আপনি সিগারেট সংক্রান্ত হারাম-হালালের কনফিউশান থেকে বের হয়ে আসবেন ।
সিগারেট খাওয়া নিয়ে বর্তমানকালের সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য ইসলামিক আইন হল-
কমপক্ষে ৪০০ জন স্কলার একমত হয়েছেন যে সিগারেট ও সকল তামাকজাত দ্রব্য ( জর্দা, গুল, ইত্যাদি) হচ্ছে হারাম, পরিমান যত কমই হোক না কেন। আধুনিক
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির কারনে মানুষ সিগারেটের ক্ষতিকর দিকগুলো এখন জানতে
পেরেছে যা কয়েকশ বছর আগে স্কলাররা জানতেন না। সেকারনে একটা সময়ে এটা
হারাম নাকি হালাল সেটা নিয়ে দ্বিমত ও দ্বিধাদ্বন্দ থাকলেও এখন বৈজ্ঞানিক
প্রমানের মাধ্যমে সন্দেহতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে যে সিগারেট একটি
স্লো-পয়জনিং ছাড়া আর কিছুই নয়। সিগারেট মানুষের শরীরকে ধীরে ধীরে ধ্বংস
ছাড়া আর কিছুই করে না। যে সিগারেট খাচ্ছে, সিগারেট শুধু তার-ই ক্ষতি করে
না, সিগারেট ক্ষতি করে আশেপাশের সবার। কাজেই আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন এটি
একটি নেশা, এবং এটি হারাম। রক্ত, শূকর, মদ যেমন হারাম, ঠিক একই রকম হারাম।
হারামের মধ্যে কোন উনিশ-বিশ-কম-বেশি নেই ইসলামে । শূকরের মাংশ খাবার কথা
শুনলে যেমনি আমরা আঁতকে উঠি, তেমনি সিগারেট খাবার কথা শুনলেও আমাদের আঁতকে
ওঠা উচিত। আর যদি আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন, হারাম হালাল নিয়ে আপনি কেয়ার
করেন না, তাহলে একজন ডাক্তার হিসেবে আমি আপনাকে জানাতে পারি যে সিগারেট
খাওয়ার চেয়ে শূকরের মাংস খাওয়া বরং আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অনেক কম
ক্ষতিকর । যদিও আমি আপনাকে কোনটাই করতে বলব না।
এই আর্টিকেল আপনাকে হালাল-হারাম শেখানোর জন্য
লেখা হয়নি । আপনি যদি সিগারেটের নেশার শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে শুধুমাত্র
হালাল-হারাম এই কথা শুনে আপনি জীবনেও এটা ছাড়বেন না। একেকজন মানুষ
একেকভাবে যুক্তি গ্রহন করে। কেউ ধর্মীয় যুক্তি বেশি গ্রহন করে । কারোর কাছে
হয়ত বিজ্ঞানের তথ্যগুলো বেশি শক্তিশালী অনুপ্রেরনা। আপনাকে কটাক্ষ করার বা
হেয় প্রতিপন্ন করার কোন উদ্দেশ্য আমার নেই। আপনি নিজেও জানেন সিগারেট
ক্ষতিকর। কতটা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর সেটা আমি আপনার কাছে এখানে তুলে ধরব। আপনি
যদি একজন বুদ্ধিমান, শিক্ষিত ও চিন্তাশীল মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে আপনি আমার
কথাগুলো উপলব্ধি করে কাজে লাগাতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
অধিকাংশ মানুষ সিগারেট সম্পর্কে এই একটাই
লাইন জানে- ” সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়।” সিগারেট খেলে কি ক্যান্সার হয়?
হ্যা, অবশ্যই হতে পারে। হবেই, এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবেনা। ধরুন, ১০০০
জন লোক সিগারেট খায়। তাদের মধ্যে ৬০ জনের ফুসফুস ক্যান্সার হল। আর অন্য
১০০০ জন লোক সিগারেট খায় না। তাদের মধ্যে ৫ জনের ফুসফুস ক্যান্সার হল। আশা
করি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। সিগারেট আপনার ফুসফুস সহ অন্যান্য অনেকগুলো
অঙ্গের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা বহু গুনে বাড়িয়ে দেয়। নন-স্মোকারদেরও
ফুসফুস ক্যান্সার হতে পারে, কিন্তু সেটার সম্ভাবনা খুবই কম। Smokers are
many times more riskful to develop Lung Cancer in comparison with
Non-smokers.
এটা ছিল জরিপ। আসুন তথ্য দেখা যাক।
– পৃথিবীতে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে মদ্যপান । দুই নাম্বারে আছে সিগারেট।
– ক্যান্সার এর সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে ধূমপান ।
মুখ, খাদ্যনালী( Esophagus) , শ্বাসনালি( Laryngx) , পাকস্থলী (Stomach),
কিডনী, ব্লাডার, অগ্নাশয় (Pancreas), জরায়ু(Cervix) প্রতিটি জায়গায়
ক্যান্সার করার ক্ষমতা আছে সিগারেট এর।
– ফুসফুস ক্যান্সারে যারা মারা যায়, তাদের মধ্যে ৯০% এর কারন হচ্ছে তারা স্মোকার।
– যাদের ব্রঙ্কাইটিস (Bronchitis ) হয়, তাদের ৭০% এর পিছে কারন হচ্ছে সিগারেট।
– পৃথিবীতে ৬০০ কোটির মধ্যে ১০০ কোটি মানুষ স্মোকার। প্রতি ৬ জন এ একজন।
– প্রতিদিন ১৫ বিলিয়ন ( ১৫০০ কোটি) সিগারেট বিক্রি হয়। এবং প্রতি মিনিটে ১ কোটি।
– প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন মারা যাচ্ছে স্মোকিং এর কারনে।
– প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ নতুন শিশু সিগারেট খাওয়া শুরু করছে।
– সিগারেট এর মধ্যে ৪০০০ টির মতন আলাদা আলাদা কেমিক্যাল আছে। যার মধ্যে কমপক্ষে ৫০ টির ক্ষমতা আছে ক্যান্সার তৈরী করার।
সিগারেট একটি স্লো পয়জন। আপনি টের পাবেন না
কিন্তু খুব ধীরে ধীরে এটি আপনার শরীরকে ধ্বংস করে ফেলছে। যেদিন আপনি টের
পাবেন, সেদিন হয়ত অনেক দেরি হয়ে যাবে। সেদিন হয়ত আপনার আর পেছনে ফিরে আসার
কোন রাস্তা খোলা থাকবেনা। ক্যান্সারের কথা বাদ দিলাম। সিগারেট আপনার
শরীরের অন্যান্য এমন কতগুলো ক্ষতি করছে যে আপনি হয়ত না মরলেও সুস্থভাবে
বাচঁতে পারবেন না কোনদিন। একটা একটা করে আপনার শরীরের অমূল্য অঙ্গগুলো
ভেতরে ভেতরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিজেই দেখে নিন।
কি আছে সিগারেটের ধোয়াতে (Tobacco Smoke) ?
সিগারেট কোম্পানীগুলো আপনাকে কখনোই বলবেনা
তারা কি দিয়ে সিগারেট বানায়, কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে বের করেছেন
মাত্র একটি সিগারেট এ কমপক্ষে ৪ হাজারটি আলাদা আলাদা কেমিক্যাল কমপাউন্ড আছে। যার মধ্যে কমপক্ষে ৫০-৭০
টি সরাসরি মানবদেহে ক্যান্সার করতে পারে। আপনি যদি স্মোকার হন, তাহলে
আপনার জেনে রাখা উচিত প্রতি টানে টানে আপনি যেসব কেমিক্যাল খাচ্ছেন
সেগুলো আর কিসে কিসে পাওয়া যায়। মাত্র কয়েকটি আমি দিলাম।
ক্যাডমিয়াম- ব্যাটারি
বিউটেন- লাইটার এর জ্বালানি
মিথেন- ম্যানহোলের গ্যাস
আর্সেনিক- বিষ বানাতে
টলুইন- ইন্ডাস্ট্রি তে সলভেন্ট হিসেবে
নিকোটিন- কীটনাশক বানাতে
এমোনিয়া- টয়লেট ক্লীনার এ
ডি ডি টি- কীটনাশক
ন্যাপথালিন- তেলাপোকার ওষুধ
আমি যদি আপনাকে টাকা দিয়েও বলি যে ভাই,
আপনাকে উপরের জিনিসগুলো খেতে হবে, আপনি কখনোই রাজি হবেন না। তাহলে আপনি
নিজেকে জিজ্ঞেস করেন আপনি আসলে কি করছেন, কি ঢুকাচ্ছেন নিজের শরীরে
প্রতিদিন । এবার ধরুন, আমি সেই একই জিনিসগুলো নিয়ে বসে আছি রাস্তার পাশে।
আপনি হাসিমুখে এসে উলটা আমাকে টাকা দিয়ে সেই জিনিসগুলো কিনে কিনে খাচ্ছেন
আর চরম আনন্দ পাচ্ছেন । জিনিসটার নাম আমি দিয়েছি বেনসন, পলমল, মার্লবোরো
ইত্যাদি। আমি সিগারেট কোম্পানি, আমার নাম ব্রিটিশ এমেরিকান টোব্যাকো । আমি
বিষ বানাই। আপনি সেই বিষ আমার কাছ থেকে আপনার নিজের টাকা দিয়েই কিনে খান।
সিগারেট এর ধোয়া প্রথমেই সরাসরি যায় ফুসফুসে।
সেখান থেকে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে এই কয়েক হাজার কেমিক্যাল ছড়িয়ে
পড়ে। তাই সবচে বেশি ক্ষতি লাংস এর হলেও সারা শরীরেই এর প্রভাব আছে।
ফুসফুসের পরেই সিগারেট সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে আপনার হৃৎপিন্ড ও রক্তনালিকা (Blood Vessel) গুলোকে।
সিগারেট এর ধোঁয়ার মূল উপাদান ৩টি। তা হল-
- TAR( আলকাতরা) ,
- CO ( কার্বন মনো-অক্সাইড) ,
- Nicotine ( এটি-ই সিগারেটের নেশার জন্য দায়ী মূল ড্রাগ)
আসুন দেখি কোনটি আপনার কি করে।
TAR/ আলকাতরা –
আলকাতরা দিয়ে রাস্তার পিচ ঢালাই করা হয়। টিনের
চাল লেপা হয়। সিগারেট এর ধোঁয়াতে সেই হুবহু একই আলকাতরা আছে। সিগারেট এর
কেমিক্যালগুলো পুড়ে যে বিষাক্ত অবশেষ থাকে সেটাই হচ্ছে টার ( TAR= Total
Aerosol Residue) । এটি একটি ভয়ঙ্কর বিষাক্ত জিনিস যা আপনার ফুসফুসের
ভিতরে দিন দিন আস্তে আস্তে জমা হয়। আমাদের লাংস দুইটি বড় স্পঞ্জ এর মতন
জিনিস যা মিনিটে গড়ে ১২-১৮ বার সংকোচিত-প্রসারিত হয়ে আমাদের দেহে অক্সিজেন
পৌঁছে দেয়। আমাদের ২টি লাংস এর ভিতরে রয়েছে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ( ৬০ কোটি)
ছোট ছোট বেলুনের মতন জিনিস, এগুলার নাম Alveoli ( অ্যালভিয়োলাই) . এদের
গায়ে আছে আরো কোটি কোটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রক্তনালী ( Alveolar Capillary).
আমরা নাক দিয়ে যে শ্বাস নেই তা এই Alveous এর মধ্যে যায়, সেখান থেকে রক্তে
মিশে, সেখান থেকে শরীরের সবগুলো কোষ এ যায়। কোষ এই অক্সিজেন ব্যবহার করে
বেচে থাকে, বদলে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরী হয়, সেটা আমরা আবার নাক দিয়ে বের
করে দেই। এই প্রক্রিয়া আমৃত্যু চলতে থাকে আমাদের অজান্তেই। (ছবি ও এনিমেশন)
প্রতিটি সিগারেট এ ব্র্যান্ডভেদে ৭-২২ গ্রাম
আলকাতরা থাকে। সিগারেট এ যতই ফিল্টার দেয়া থাকুক, এগুলো সবই ভুয়া জিনিস,
আপনার ফুসফুসে ঠিকই আলকাতরা যাচ্ছে। আপনি যখন সিগারেট টানেন, তখন এই
আলকাতরা আপনার লাংস এর ভিতর জমতে থাকে। সেটা আপনি টের পান না। কিন্তু তাতে
কিছু যায় আসে না, যা ঘটার সেটা ঘটে যাচ্ছেই। প্রতিদিন একজন মানুষ মিনিটে ৬
লিটার করে সারাদিনে ৮০০০ লিটার বাতাস গ্রহন করে যার ভিতরে অগনিত ধূলা-বালি ও
রোগ-জীবানু আছে। আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস এর যে সিস্টেমটা আছে (
Respiratory sytem) এটার ভিতর Cilia নামে ছোট ছোট ব্রাশের মতন লক্ষ লক্ষ
জিনিস আছে যারা সবসময় নড়াচড়া করে ও বাতাসের ধূলা-ময়লা, জীবানু কে ফিল্টার
করে লাংস কে পরিষ্কার রাখে । আরেক ধরনের কোষ আছে যাদের নাম গবলেট কোষ(
Goblet Cell) যাদের কাজ হল প্রতিরক্ষাকারী পিচ্ছিল মিউকাস (Mucus) তৈরী
করা। সিলিয়া ও গবলেট কোষ এরা দুইয়ে মিলে সব ধূলা-বালিকে আটকে ফেলে, আর
সেগুলো আমরা একটু পর পর গলা খাঁকারি দিয়ে, কাশি-হাচি দিয়ে বের করে দেই বা
গিলে ফেলি। সিলিয়া প্রতি মিনিটে ১০০০-১৫০০ বার নড়াচড়া করে তার কাজ করেই
যাচ্ছে, আমরা টেরও পাই না, চিন্তাও করিনা। চলছে চলুক না। (ছবি ও এনিমেশন)
টার একটি মারাত্বক ক্ষতিকর কেমিক্যাল
(Irritant Chemical) । টার এই cilia গুলোর কাজ করার ক্ষমতাকে নষ্ট করে
দেয়। ফলে ফুসফুসের ভিতরে আস্তে আস্তে ময়লা, ব্যাক্টেরিয়া জমতে থাকে, এবং
ভিতরে ইনফেকশন তৈরী হয়। যখন ফুসফুসে আলকাতরা যাওয়া শুরু করে তখন গবলেট
কোষেরা মনে করে – “আরে এত ময়লা যাচ্ছে কেন, দেখি আমি আরো বেশি বেশি মিউকাস
তৈরী করতে থাকি যাতে ময়লা পরিষ্কার হয়” । একদিকে আপনার সিলিয়া নষ্ট,
অন্যদিকে তৈরী হচ্ছে বেশি বেশি মিউকাস। ফলে এগুলো আপনার লাংস এর ভেতরেই
জমতে থাকে। এই আলকাতরা আপনার Alveolus গুলোকে আস্তে আস্তে চিকন ও বন্ধ করে
দেয়। এটা একদিনে হয় না, বছরের পর বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। প্রতি
বছর ধূমপানের ফলে আপনার ফুসফুসে কমপক্ষে এক গ্লাস বা ২০০ মিলি. আলকাতরা জমে
(World Health Organization )।
আপনি দেখবেন যারা বহুদিন ধরে সিগারেট খায়,
তারা খুক খুক করে কাশে। এটার নাম Smokers Cough. তাদের শরীর তাদের লাংস এর
ভেতরে জমে থাকা আলকাতরা ও মিউকাস গুলোকে বের করার একটা নির্জীব চেষ্টা
চালায়। আপনার যদি অনেকদিন ধরে এ ধরনের খুক খুক কাশি ডেভেলপ করে থাকে,
তারমানে আপনার শরীরেও এই ঘটনা ঘটছে। এই যে পুরো অসুখটির কথা বললাম আমি,
এটার নাম ব্রঙ্কাইটিস ( Chronic Bronchitis) । সিগারেট খেলে আপনার
ক্যান্সার হোক বা না হোক, আপনার লাংস এর ভিতরে এই ক্ষতি হচ্ছে এটা আপনি
লিখে রাখতে পারেন।
এইরকম আরেকটি অসুখ আছে যেটার নাম এমফাইসিমা (
Emphysema) . দিনের পর দিন আলকাতরা জমে ঘন ঘন ইনফেকশান ও ফুসফুসের
অ্যালভিয়োলাইগুলোর ইনজুরির কারনে সেগুলোর স্বাভাবিক সঙ্কোচন-প্রসারন ক্ষমতা
( Elasticity) নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সেগুলো আর আগের মতন সঙ্কোচন-প্রসারন
করতে পারেনা। ফলে আপনার রক্তে আর যথেষ্ট অক্সিজেন পৌছায় না। আস্তে আস্তে
শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে, ঘন ঘন ঠান্ডা-কাশি লেগে থাকে, বুকের ভিতরে মাঝে মাঝে
ব্যথা বা কেমন দমবন্ধ অনূভুতি ( Chest Tightness) হয়। এ দুটি রোগকে
একসাথে বলা হয় COPD বা Chronic Obstructive Pulmonary Disease. এই দুটি
রোগের কোনটারই কোন চিকিৎসা নেই। এগুলো কখনোই ভাল হয়না। আপনার ক্ষতি যা হবার
হয়ে গেছে। এই ক্ষতি IRREVERSIBLE, তার মানে যা হয়ে গেছে তা আপনি ফেরত
পাবেন না, বাকি যা আছে তা দিয়েই আপনাকে বাকি জীবন চলতে হবে। (ছবি ও
এনিমেশন)।
এখনো যদি আপনার টনক না নড়ে, তাহলে দয়া করে দেখে নিন টার কিভাবে জমা হয় ফুসফুসে এবং কিভাবে সেটা ফুসফুসকে ঠিকমতন কাজ করতে দেয়না।
২- CO/ কার্বন মনো-অক্সাইড –
কার্বন মনো-অক্সাইড কি ক্ষতি করে সেটা জানতে
হলে আগে জানতে হবে কিভাবে লাংস থেকে শরীরে অক্সিজেন পৌছায়। আমাদের রক্তের
মধ্যে আছে চ্যাপ্টা গোল এক ধরনের কোষ, যাদের নাম লোহিত রক্ত কনিকা বা Red
Blood Cell (RBC). এদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে ৪টি করে প্রোটিন যার নাম
হিমোগ্লোবিন। লাংস থেকে অক্সিজেন প্রথমে রক্তের RBC তে ঢুকে এই
হিমোগ্লোবিনের সাথে জোড়া লেগে অক্সি-হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। তারপর সেটা
রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে যায় ও কোষে কোষে অক্সিজেন সাপ্লাই দিয়ে ও কোষ
থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে আবার লাংস এ ফেরত আসে। আমরা যে প্রতিবার
শ্বাস নিচ্ছি আর ফেলছি , এর মধ্যেই এই অসাধারন ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে।
কার্বন মনো অক্সাইড(CO) এত বিষাক্ত একটি
গ্যাস যে বিশুদ্ধ কার্বন মনো-অক্সাইড এ মাত্র কয়েক মিনিট থাকলেই মানুষ মারা
যাবে। সিগারেটের ধোয়ায় এই বিষ আছে, কিন্তু তা থেকে মানুষ মরে না কারন
ধোয়াটা বাতাসের সাথে মিশে অনেকটাই হালকা ( Dilute/Masking ) হয়ে যায় এবং
তার পারসেন্টেজ কমে আসে। এছাড়াও ধূমপানের সময় মানুষ নাক দিয়ে স্বাভাবিক
ভাবে শ্বাস নেয়, কাজেই সে মরে না।
এই ধোয়া কি ক্ষতি করে?
গাণিতিক হিসাব দেখা যাক। আশা করি আপনার নিজের উপর অনুশোচনা হবে যে আপনি স্রষ্টার দেয়া অমূল্য শরীরটাকে কিভাবে নষ্ট করে ফেলছেন ।
আমাদের শরীরে ৫ লিটার রক্ত আছে। এদের মধ্যে আছে লোহিত রক্ত-কনা, বা red blood cell(RBC), এরাই অক্সিজেন বহন করে নিয়ে যায় সব কোষ এ।
আমাদের শরীরে ৫ লিটার রক্ত আছে। এদের মধ্যে আছে লোহিত রক্ত-কনা, বা red blood cell(RBC), এরাই অক্সিজেন বহন করে নিয়ে যায় সব কোষ এ।
১ লিটার=১ লক্ষ মাইক্রোলিটার ( ১,০০,০০০)
প্রতি মাইক্রোলিটার এ লোহিত রক্ত-কনা আছে ৬ মিলিয়ন, বা ৬০ লক্ষ।
তাহলে পুরো শরীরে লোহিত রক্ত-কনা আছে = ৬০ লক্ষ X ১০০০০০ X ৫ = ৩0,00,00,00,00,000
বা ৩ লক্ষ কোটি।
প্রত্যেকটি লোহিত রক্ত-কনা তে ২৫ কোটি হিমোগ্লোবিন (hemoglobin) আছে।
প্রত্যেকটি হিমোগ্লোবিন ৪টি করে অক্সিজেন বহন করতে পারে।
তাহলে প্রত্যেকটি লোহিত রক্ত-কনা ১০০ কোটি অক্সিজেন বহন করে একেকবারে। ( এবার এটাকে ৩ লক্ষ কোটি দিয়ে গুন করে দেখতে পারেন সারা শরীরের জন্য )
প্রতি মাইক্রোলিটার এ লোহিত রক্ত-কনা আছে ৬ মিলিয়ন, বা ৬০ লক্ষ।
তাহলে পুরো শরীরে লোহিত রক্ত-কনা আছে = ৬০ লক্ষ X ১০০০০০ X ৫ = ৩0,00,00,00,00,000
বা ৩ লক্ষ কোটি।
প্রত্যেকটি লোহিত রক্ত-কনা তে ২৫ কোটি হিমোগ্লোবিন (hemoglobin) আছে।
প্রত্যেকটি হিমোগ্লোবিন ৪টি করে অক্সিজেন বহন করতে পারে।
তাহলে প্রত্যেকটি লোহিত রক্ত-কনা ১০০ কোটি অক্সিজেন বহন করে একেকবারে। ( এবার এটাকে ৩ লক্ষ কোটি দিয়ে গুন করে দেখতে পারেন সারা শরীরের জন্য )
অক্সিজেন যত দ্রুত হিমোগ্লোবিন এর সাথে জোড়া লাগে, কার্বন মনো-অক্সাইড তার চেয়ে ২৫০ গুন বেশি গতিতে
হিমোগ্লোবিন এর সাথে জোড়া লেগে তৈরী করে কারবক্সি- হিমোগ্লোবিন । ফলে
কার্বন মনো-অক্সাইড রক্তে আসা মাত্রই তারা অক্সিজেন এর যায়গা দখল করে নেয়
অত্যন্ত কম সময়ে। একজন ধূমপায়ীর রক্তের ১/৫ অংশ দখল করে নেয় কার্বন মনো-অক্সাইড ।
ফলাফল – উপরের বিশাল সংখ্যা দেখে বুঝতে পারছেন
শরীরের ভিতরে কি ঘটে যাচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে । শরীরের কোষগুলোর অক্সিজেন
দরকার বাচার জন্য, কিন্তু ধূমপানের ফলে তারা পায় কার্বন মনো-অক্সাইড। দিনের
পর দিন এই ঘটনা ঘটতে থাকে। আস্তে আস্তে কোষগুলো ধ্বংস হতে থাকে। কমতে
থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের 100 trillion (1014) কোষের প্রতিটি কোষ এ ঘটছে এই ক্ষতি।
৩- নিকোটিন/Nicotine :
এটিই সেই DRUG যার জন্যে মানুষ ধূমপান করে। Nicotine কে এখন ড্রাগ বলা হয়, কারন এটি একটি নেশা। তাই ধূমপান কেও এখন addiction
বলা হয়। যারা ধূমপান করেন, তারা addict. এটা নিয়ে আপনি তর্ক করতে পারেন,
কিন্তু এটাই পরীক্ষিত সত্য এখন পৃথিবীতে। Nicotine রক্তের মাধ্যমে ব্রেইন এ
যায় এবং নির্দিষ্ট কিছু কেমিক্যাল রিলিজ করে ( ডোপামিন, এড্রেনালিন
) । ডোপামিনের প্রভাবে স্মোকারের নার্ভাস সিস্টেমে কিছু অনুভুতির সৃষ্টি
করে, যেমন- ভাল লাগা, মাথা ঝিম ঝিম করা, মনোযোগের মাত্রা বাড়া। এটাই নেশা।
কিছুক্ষন পরেই রক্তে ডোপামিনের পরিমান কমে যাবে। তখন সেই মানুষের আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা হবে। এরপর আরেকটা…এভাবে চলতেই থাকবে।
Nicotine এ আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এটা মানুষ ছাড়তে পারেনা সহজে।
তখন এটার নাম হয় Nicotine Dependence. যার অর্থ নির্ধারিত মাত্রার নিকোটিন
রক্তে না গেলে সেই ব্যক্তির অস্থির লাগবে, বিরক্ত লাগবে, মানসিক অশান্তি
হবে।
নিকোটিন আরো ক্ষতি করে । এটা ব্রেইনে যেয়ে এড্রেনালিন হরমোন
কে বেশি বেশি রিলিজ করে। এবং একই সাথে শরীরের রক্তনালীগুলোকে আরো সঙ্কোচিত
( Vasoconstriction) করে দেয়। ফলে রক্তনালীর চাপ বেড়ে যায়। আমাদের শরীরের
রক্তনালীর মোট দৈর্ঘ্য ১ লক্ষ কিলোমিটার যা পুরো পৃথিবী
আড়াই বার ঘুরে আসার সমান। এই বিশাল লম্বা রাস্তায় যখন দিনের পর দিন ধরে
রক্তচাপ বাড়তে থাকে তখন ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায় ও হার্টের উপর চাপ বেড়ে
যায়।
রক্তনালী চিকন হয়ে যাওয়ার কারনে হাত ও পায়ে
রক্ত সরবরাহ কমে যেতে থাকে। নিকোটিন আরো একটা মারাত্বক ক্ষতি করে। আমাদের
শরীরের কোন জায়গায় কেটে গেলে সেটা জমাট বাধার জন্য যারা কাজ করে তাদেরকে
অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট( Platelet) বলে। নিকোটিন রক্তনালির ভেতর রক্ত জমাট
বাধার এই প্রবনতাকে বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই রক্তনালী সিগারেট খেয়ে
খেয়ে চিকন হয়ে আছে, এরমধ্যে যদি কোনভাবে একটা রক্তের জমাট ( Embolus) তৈরী
হয়, সেটা আপনার শরীরের যেকোন রক্তনালীতে যেয়ে আটকে যেতে পারে। এই ঘটনা
হার্টে ঘটলে সেটার নাম হার্ট অ্যাটাক, আর ব্রেইনে ঘটলে সেটার নাম স্ট্রোক। আপনি নিশ্চয়ই কোন না কোন স্ট্রোকের রুগীকে প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখেছেন? আপনিও কি একই পরিনতি চান?
কেন মানুষ ধূমপান শুরু করে ?
বেশিরভাগ মানুষ ধূমপান শুরু করে আশেপাশের
পরিবেশ, বন্ধুবান্ধব, সঙ্গদোষের কারনে। কেউ মায়ের পেট থেকে সিগারেট খাওয়া
শিখে আসেনা। এটা কোন সুস্বাদু খাবার নয়, এমনকি এটা কোন খাবারই না। সিগারেট
খাওয়ার আগে ও পরে বিসমিল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ বলে নাই কেউই। ঘরে পরিবারের
সামনে সিগারেট টানেনা কেউই। সিগারেটে প্রথমবার টান দিয়ে কাশতে কাশতে
অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে প্রতিটা মানুষেরই। তারপরো মানুষ এটা খায়। টীন-এজ
বয়সে ছেলেরা ধূমপান শুরু করে সবচেয়ে বেশি। তারা এটাকে খুব পুরুষালী কিছু
মনে করে। কেউ হয়ত বান্ধবীকে আকৃষ্ট করার জন্য স্মোকিং শুরু করে। আর
স্মোকার বন্ধুদের আড্ডা-সঙ্গদোষের প্রভাব তো আছেই, এটাকে বলা হয় Peer
Pressure. এভাবেই আস্তে আস্তে শুরু, শুরু থেকে অভ্যাস, অভ্যাস থেকে
বদ-অভ্যাস, সেখান থেকে নেশা, সেখান থেকে মরননেশা, সেখান থেকে ধ্বংস।
কেন ক্যান্সার হয় ?
আমাদের শরীরের প্রতি সেকেন্ডে নতুন নতুন কোষ
মারা যাচ্ছে ও তৈরী হচ্ছে। যখন কোষ বিভাজনের হারকে শরীর আর নিয়ন্ত্রন করতে
পারে না, তখন সেটাকে ক্যান্সার বলে। সিগারেটের ক্ষতিকর কয়েক হাজার
কেমিক্যাল মানুষের শ্বাসতন্ত্রের কোষগুলোকে বারবার ক্ষতিগ্রস্থ করতে থাকে,
এটার নাম Cell Injury. দিনের পর দিন ইনজুরি হতে থাকলে কোষের স্বাভাবিক কাজ
করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন সে অতিরিক্ত বিভাজন শুরু করে, মূলত এভাবেই
ক্যান্সারের শুরু হয়।
আপনি যদি আজীবন সুস্থ ও সুন্দর থাকতে চান…
আপনি দেখবেন, কিছু মানুষ খুব অল্প বয়সেই
বুড়িয়ে যায়। এদের চামড়ায় দ্রুত ভাঁজ পড়ে, চুল পড়ে যায়, চেহারা নষ্ট হয়ে
যায়। প্লেট উপচিয়ে ভাত খাওয়া বাংগালীরা এই দলে পড়ে । অন্যদিকে কিছু মানুষ
আছে যাকে দেখে আপনার ৩০ বছর মনে হবে, কিন্তু আসলে তার বয়স ৫০। এগুলোর পিছে
মূল কারন আমি আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি।
একটা কারন উপরে বলা হয়েছে- Cell Injury.
শরীরের কোষের অক্সিজেন সাপ্লাইতে যদি আপনি ক্ষতি করেন, তাহলে কোষ নষ্ট হতে
বাধ্য। সিগারেট ঠিক এই কাজটাই করে যা উপরে ব্যখ্যা করা হয়েছে । ধূমপান,
স্ট্রেস, মানসিক চাপ, অস্থিরতা, এইগুলো কোষের অক্সিজেন সাপ্লাই কমিয়ে দেয়।
ফলে মানুষের Ageing Process দ্রুতগতিতে হয়। ফলে চেহারা নষ্ট হয়ে যায় কম
বয়সেই।
২য় রহস্য হচ্ছে আপনার ফুসফুস, হার্ট ও
রক্তনালী। আপনি যদি সিগারেট না খান, আপনার ১ লক্ষ কিলোমিটার লম্বা
রক্তলানীর উপর বাড়তি চাপ পড়বে না, ফলে আপনার হার্টের উপরও চাপ পড়বে না।
আপনি যত বেশি পরিমানে এক্সারসাইজ করবেন, আপনার রক্তনালীর ভেতর থেকে তত বেশি
নাইট্রিক অক্সাইড (Nitric Oxide) রিলিজ হবে। নাইট্রিক অক্সাইড আপনার
রক্তনালীকে সবসময়ে প্রসারিত ( Vasodilation) করে রাখবে। একজন এভারেজ
মানুষের হার্ট মিনিটে ৬০-১০০ বার পাম্প করে, যেটাকে পাল্স বলে। আপনার
পাল্স আপনি যত কমিয়ে আনতে পারবেন, আপনার হার্ট ততই ভাল থাকবে। আপনি যদি
নন-স্মোকার হন এবং নিয়মিত এক্সারসাইজ করেন, আপনার পাল্স অবশ্যই কম থাকবে।
একজন এভারেজ পূর্নবয়ষ্ক মানুষ প্রতি নিশ্বাসে
৫০০ মিলিলিটার ও প্রতি মিনিটে ৬ লিটার বাতাস নেয়। এজন্য তাকে ১২ বার
শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলতে হয়। আপনার ফুসফুস কতটা ভাল আছে তার প্রমান হচ্ছে
আপনার শ্বাসের হার ( Respiratory Rate) কতটা কম । আপনার শ্বাসের হার কম
এটার মানে হচ্ছে, আপনার ফুসফুস অত্যন্ত ভাল, সেকারনে আপনার শ্বাসের গভীরতা
(Respiratory Depth) অনেক বেশি, যার অর্থ আপনি এক শ্বাসেই ৫০০ মিলিলিটারের
চেয়ে অনেক বেশি বাতাস নিতে পারেন ( ধরুন ৮০০ মিলি ) । সিগারেট খেয়ে আপনি
যদি আপনার ফুসফুসের বারটা বাজিয়ে রাখেন, তাহলে এই ৬ লিটার বাতাস নিতে
আপনাকে কমপক্ষে ২০-২৫ বার শ্বাস ফেলতে হবে। ব্যাপারটাকে এভাবে তুলনা করা
যেতে পারে- ১০০ মিটার দৌড়াতে আমি পা ফেলি ৩০০ বার, আর আপনি পা ফেলেন ২০০
বার। যার অর্থ একই কাজ আপনি অনেক কম কষ্টে করতে পারেন।
এই হচ্ছে আজীবন সুন্দর স্বাস্থ্য ধরে রাখার
রহস্য। আপনাকে আপনার পাল্স ও শ্বাসের হার কমিয়ে রাখতে হবে
ব্যায়াম/খেলাধূলা করে ও সিগারেট না খেয়ে। আমাদের আয়ু অবশ্যই আল্লাহর হাতে এ
ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আল্লাহ আমাদের
দিয়েছেন। আপনি সিগারেট খাবেন কি খাবেন না এই সিদ্ধান্ত আপনার । আপনি যেরকম
সিদ্ধান্ত নিবেন এই পৃথিবীতে এবং এর পরের জীবনে সেটারই প্রতিদান পাবেন।
তাহলে ডাক্তাররা যে সিগারেট খায়…?
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিই করেছেন যেন আমরা عقل (আ’ক’ল) ব্যবহার করি এবং فكر (ফিকর) করি।
- عقل (আ’ক’ল) অর্থ বিচার-বুদ্ধি, যুক্তি, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, মানসিকতা, বোধ।
- فكر (ফিকর) অর্থ চিন্তা, উপলব্ধি, অনুধাবন, প্রতিফলন, মাথা ঘামানো।
আল্লাহ কু’রআনে ৪৯ বার আ’ক’ল এবং ১৮ বার ফিকর
করতে বলেছেন। যদি যোগ করি তাহলে পুরো কু’রআনে আল্লাহ আমাদেরকে কমপক্ষে ৬৭
বার চিন্তা করতে, বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করতে বলেছেন।। জ্ঞান থাকলেই মানুষ
সেটা কাজে লাগাবে এমন কোন কথা নেই। এই আর্টিকেল এর শুরুতেই বলা হয়েছে
মানুষ জেনেশুনে নিজের ক্ষতি করে। ডাক্তাররাও এর ব্যতিক্রম না। আপনি যদি
সিগারেট না খান তাহলে আপনি একজন ধূমপায়ী কার্ডিওলজিস্ট এর চেয়ে বেশি
বুদ্ধিমত্তা রাখেন এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।
Passive Smoking-
আপনি যখন আপনার ধূমপায়ী বন্ধুদের সাথে আড্ডা
দেন, তখন আপনি হন Passive Smoker. আপনি সারা জীবন একটি সিগারেট না খেয়েও
তাদের ধোয়া, কার্বন মনো অক্সাইড, আলকাতরা খেয়ে চলেছেন। খুন করে ফাসিতে
ঝুলবেন নাকি খুন না করে ফাসিতে ঝুলবেন এটা আপনার সিদ্ধান্ত ! হয় বন্ধুদের
বোঝান, বা নিজের জীবন ও ধূমপায়ী বন্ধু থেকে একটি বেছে নিন।
যদি কোন নবজাতক বাচ্চার বাবা-মা দুইজনেই
প্রতিদিন ২০টি করে সিগারেট খায়, তাহলে বাচ্চাটির বয়স এক বছর হবার আগেই সে
কমপক্ষে ৮০টি সিগারেট পরোক্ষভাবে খেয়ে ফেলবে। কাজেই আপনি যদি আপনার
সন্তানের ক্ষতি না চান, আপনার উচিত হবে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেওয়া। আজকে
থেকে ১৫ বছর পরে আপনার ছেলের হাতে সিগারেট দেখলে আপনার কেমন লাগবে? আপনি কি
তাকে মানা করতে পারবেন? মানা করতে গেলে যখন আপনার ছেলে বলবে- “বাবা তুমি
তো সবসময় খাও, তাই আমিও খাই। ” একথা শুনার পর আপনি কি করবেন কখনো চিন্তা
করেছেন?
আপনি যদি একজন ধূমপায়ী , ও এই আর্টিকেল পড়ে বোঝার মতন শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান হয়ে থাকেন তাহলে আপনি নিচের যেকোন একটি করবেন-
১। আপনি সবসময়েই জানতেন সিগারেট ক্ষতিকর। এই
আর্টিকেল পড়ে ও ছবি/ভিডিও দেখে সেটা আরো ভালভাবে নিশ্চিত হলেন। আপনি
সিগারেট জীবনের তরে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
২। কিছুদিন আপনি ছেড়ে দিবেন। এরপর যখন এই কথাগুলো ভুলে যাবেন তখন আবার শুরু করবেন।
৩। এই আর্টিকেল পড়ে আপনার কিছু যায় আসে না। এটা পড়তে পড়তেই হয়ত আপনি একটা সিগারেট ধরাবেন ও মনিটরের উপর একগাল ধোঁয়া ছাড়বেন।
আপনি কি করবেন এটা একান্তই আপনার ব্যাপার।
মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে সত্য কথা জানানো, ভাল কাজের
অনুপ্রেরনা দেওয়া ও খারাপ কাজ করতে মানা করা। এই আর্টিকেল পড়ে বেশ কয়েকজন
মানুষ সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন আগে। কাজেই আপনিও পারবেন। আমরাই আমাদের
অভ্যাস বানাই। ভাল অভ্যাস, খারাপ অভ্যাস, নেশা, সবই আমরাই বানাই। ধরতে যখন
পারি, ছাড়তেও পারি।
We create our Habits, then our
habits create us. As we have the power to create one, so we must also
have to power to quit one. It only depends how much effort you will
give.
আপনাকে অনুরোধ করব, এই কথাগুলো মানুষকে জানান।
দরকার হলে অন্তত এক কপি প্রিন্ট করে কাউকে পড়তে দিন। আপনার আমার চেষ্টার
মাধ্যমে যদি আল্লাহ কাউকে পথ দেখান, সেটার প্রতিদান আমরা কখনো কল্পনাও করতে
পারবনা।
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: