~সংসার 💗
~Saymaah Islam Meem
পরপর ২ টা সংসার আর ১ টা বিয়ে ভেঙে যাবার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আত্নহনন করবো। হ্যাঁ, নিজের ইচ্ছেতেই নিজের জীবন শেষ করতে চেয়েছিলাম! তবে আমি তখনো জানতাম না আমার এই জীবন যে আমার নয়, আমার রব্বের দেওয়া আমানাহ মাত্র; যার খিয়ানাত আমি করতে পারবো নাহ।
যেখানে সমাজ আমাকে অপবাদ দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল সেখানে রব্ব পরম যত্নে আমাকে আগলে রেখেছিলেন, তাঁর কাছে ফিরবার পথ করে দিয়েছিলেন।
[১]
বাবা-মা'র ৪ মেয়ের মধ্যে আমি ই ছিলাম সবার বড়। কোনো ভাই ছিল না আমাদের। ইসলাম মেয়েদের অসম্ভব সম্মান দিলেও সমাজ যে এখনো মেয়েদেরকে বোঝা স্বরুপ মনে করে, তা বুঝতে পারছিলাম যখন ১৪ বছরে পা দেওয়ার সাথে সাথেই আমাকে ঘাড় থেকে নামানোর বন্দবস্ত করছিলেন আমার বাবা-মা! আমি স্বল্প বয়সে বিয়ে দেবার বিপক্ষে নই, বরং স্বল্পবয়সে একটা মেয়েকে জোর করে নেশাখোর, চরিত্রহীনের সাথে বিয়ে দেবার বিপক্ষে! তবে আমার বিপক্ষ পাতিত্বে তখন কারো কিছু এসে যায়নি। বিয়েটা আমাকে দেওয়া ই হয়েছিল কোনো এক নেশাখোর-লম্পটের সাথে!
ছোট ছিলাম, তবুও বাবা-মা'র কথা ভেবে সংসার ভাঙতে চাইনি। নতুন করে আবার তাদের ঘাড়ে চাপতে চাইনি। তাই তো নেশাখোরের হাজারো অত্যাচার সহ্য করে ২ বছর টিকে ছিলাম। দিনে দিনে তার অত্যাচার সে আরো বাড়াতে থাকে। আমি যতই সহ্য করতাম, ততই অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে থাকতো সে। একবার মার খেয়ে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো, নিষ্ঠুর টা তবুও একটু সহানুভূতি দেখায়নি, নিয়ে যায়নি ডাক্তারের কাছে। সারা দিন রাত আধমরা অবস্থায় মাটিতে পরে ছিলাম। কারো মাধ্যমে আব্বা-আম্মা খবর পেয়ে আমাকে এসে নিয়ে গেলেন পরদিন সকালে। এরপর আর অই বাড়িতে যাওয়া হয়নি। তালাকের কথা তখনো আমি বলিনি, তবে সে নিজের ইচ্ছেতেই তালাক দিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, কোনো একজনের বউকে ভাগিয়ে এনে সে নতুন সংসার পেতেছে!
তার নতুন সংসার হলো, আর আমার সংসার ভেঙে গেল! পাড়াপড়শির কানাকানি শুনতে শুনতে দিন যেতে থাকে আমার। তাদের একই কথা, আমি যদি ভালো হই আমাকে মারবে কেন? কিন্তু তাদেরকে বোঝাবে কে? নেশাখোরদের মারার কোনো কারণ লাগে নাহ। নেশায় মাতাল হয়ে তারা এমনিতেই স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে। আর তার মধ্যে যদি থাকে বাইরের নারীতে আসক্ত, তাহলে তো আর কোনো কথা ই নেই! এগুলো জানার পরও প্রতিবেশীদের একই কথা, সব দোষ নাকি আমারই। আমি চাইলেই নাকি পারতাম তাকে নেশা থেকে ফেরাতে! কিন্তু তাদেরকে তো বোঝাতে পারিনি, আমি যে বারংবার নেশা ছাড়ানোর চেষ্টা করেছি। এতটুকু বয়সে কতই বা চেষ্টা করা যায়! তবুও তো তাকে ছাড়িনি নিজের ইচ্ছেতে, বরং সে ই ছেড়েছিল অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে! তবুও দিন শেষে সব দোষ আমার ই!
[২]
১৬ বছর বয়সী ডিভোর্সি আমি কি-বা করবো। লোকের কথা শুনতে শুনতে জীবন থেকে মায়া উঠে গেছে! তবুও আব্বা-আম্মার দিকে তাকিয়ে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হতো। আব্বাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে পড়াশোনা আবার শুরু করি। নবম শ্রেণী থেকেই টিউশনি শুরু করি আমি। দিনকাল ভালোই যেতে থাকে। ছোট ৩ বোনের পড়াশোনার খরচ আমি আর আব্বা মিলে জোগাড় করি। কিছুটা হিমশিম খেতে হয়, তবুও পেরে উঠি আমরা!
২ বছর পর, তখন আমার বয়স ১৮ কি ১৯ বছর, কলেজে উঠে একটা ছেলের প্রেমে পরে যাই। যদিও এতে ছেলেটার ই আগ্রহ বেশি ছিল। সে ই আমাকে নানা ভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতো। এক সময় আমিও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার প্রেমে পা বাড়াই। দ্বীনের জ্ঞান ছিল না বলেই এই ধ্বংসের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম।
বান্ধবীরা বলে ছিল ছেলেটা ভালো নয়। আমার সাথে নাকি টাইম পাস করছে। আমি তখন তার প্রেমে এতটাই অন্ধ ছিলাম যে কারো কথা বিশ্বাস করিনি। বান্ধবীদের মিথ্যে প্রমাণ করবো বলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিই। আশ্চর্যজনক ভাবে সেও রাজি হয়ে যায়। তবে শর্ত দেয় তার বাসায় কাউকে জানানো যাবে না। সে কোনো জব পেলে তখন জানাবে। আমিও তার প্রেমে অন্ধ হয়ে রাজি হয়ে যাই।
সে আমাদের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতো বলে সবাই আমাদের বিয়ের বিষয় টা ৬ মাসের মধ্যেই জেনে যায়। তখন তার বাসা থেকে কেউ আমায় মেনে নেয়নি। সবার এক কথা তাদের ছেলেকে তারা ডিভোর্সি মেয়ের সাথে মেনে নিতে পারবে নাহ। তবে আমার ধারণা ছিল, সে সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হবে। আমাকে কোনো ভাবেই ছেড়ে দিবে নাহ। যেহেতু সে আমার বিয়ে করা স্বামী, আর আমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। কিন্তু আমার ধারণা কে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে সে আমাকে ছেড়ে দেয়। ছাড়ার পূর্বে আমি তার পা'য়ে পর্যন্ত ধরেছিলাম যেন আমাকে ছেড়ে না যায়। কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। খুব ভালো বাসতাম তাকে। তার মা-বোনদের কেও প্রচুর অনুনয় বিনয় করেছিলাম। কিন্তু কেউ কথা শুনেনি আমার। সবার এক কথা আমি খারাপ, তাই আমার ডিভোর্স হয়েছে। আর খারাপ কাউকে তারা তাদের এত ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না।
সে তো আমার সম্পর্কে সব জেনেই আমাকে বিয়ে করেছিল। তবুও কেন ছাড়লো? কারণ বিয়েটা সে সিরিয়াসলি করেনি। মজা নেবার জন্য করেছিল। আমার বান্ধবিদের মিথ্যে প্রমান করবার জন্য করেছিল। অথচ শেষমেশ আমি ই মিথ্যে প্রমানিত হয়ে সবার হাসির খোরাক হয়ে গিয়েছিলাম।
[৩]
২য় সংসার ভাঙার পর আমি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। সারা দিন-রাত কাদঁতাম আর বলতাম আল্লাহ কেন আমার সাথে এমন করলেন। আমার ভাগ্য কেন এত বাজে। আমি কেন এত অসহায়। বিনা দোষে রব্ব কেন আমার সাথে এত অন্যায় হতে দিলেন। বারংবার এই অভিযোগ গুলো করতাম আর কান্না করতাম। মরে যেতে চাইতাম, কিন্তু সাহসে কুলাতো না।
এরই মাঝে একদিন খবর এলো অবিবাহিত কোনো ছেলে আমার সকল অতীত জেনেই আমাকে বিয়ে করতে চায়। আব্বা-আম্মাসহ বাকি সবাই ভীষণ খুশি আর ছেলের গুণ গানে মুখরিত। সবাই ভাবলো, ছেলেটা ভীষণ ভালো নাহলে এমন কলঙ্কিনী মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে কেন! যদিও আমি আর বিয়ে করতে চাইনি, রাজিও হইনি প্রস্তাবে। কেননা আমি তখনও আমার প্রাক্তন দ্বিতীয় স্বামীর প্রতারণা ভুলতে পারিনি, আর ছেলেদের প্রতি চরম অনীহা এসে গিয়েছিল। তবুও আমার অমতেই সবাই বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেললো।
বিয়ের দিন প্রায় কাছাকাছি। এমন সময় এত ভালো ছেলের আসল চেহারা প্রকাশ পেল, সবাই বুঝতে পারলো কেন অবিবাহিত ছেলে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল! ছেলের পক্ষ খবর পাঠিয়েছিল বিয়েতে তারা যৌতুক চায় নাহ, তবে মেয়ের যেহেতু বদনাম আছে সেহেতু ক্ষতিপূরণ হিশেবে তাদেরকে ৩ লাখ টাকা দিতে হবে! তাদের এই আবদার শুনে রাগে, দুঃখে-কষ্টে আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝড়তে থাকে। আমি কিছুটা শক্ত হয়ে নিজের হাতে নিজের বিয়ে ভেঙে দিই সেদিন। বাইরে থেকে কঠোরতা দেখালেও ভেতরে ভেতরে তখন আমি একদম ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলাম!
আবার শুরু হয় সমাজের কানাকানি, বলাবলি। এত অপমান, লাঞ্চনা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না ভেবে আত্নহত্যা করতে গিয়েছিলাম। তবে করতে পারিনি আমি, কিসের একটা বাঁধা পাচ্ছিলাম বার বার। বার বার আমার চোখের সামনে ভেসে আসছিল আমার অসহায় বাবা-মা আর ছোট বোনগুলোর চেহারা। তাই মরতে গিয়েও ফিরে এসেছিলাম সেদিন!
[৪]
আমি সেদিন আত্নহত্যা না করলেও ভেতরে ভেতরে একদম মরে গিয়েছিলাম। বেঁচে ছিলাম শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে! এতো কষ্ট, হতাশা, ডিপ্রেশন, লোকের অপমান নিয়েও আমি নিয়মিত পড়াশোনা আর টিউশনি করে যাচ্ছিলাম নিজের অসহায় পরিবারের কথা ভেবে। এই তেতো অতীত ভুলবার জন্য আমি সব সময় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতাম। তাই আরো কয়েকটা টিউশনির খোঁজ লাগাই। হঠাৎ ই এক বড় আপুর মাধ্যমে একটা মহিলা মাদ্রাসায় ইংরেজি পড়ানোর দায়িত্ব টা পেয়ে যাই। যদিও মাদ্রাসার প্রতি তেমন কোনো টান ছিল না তখন, তবুও ব্যস্ত থাকা আর কিছু টাকা আয় হবে ভেবে রাজি হয়ে যাই।
মাদ্রাসাতে সারাক্ষণ বাচ্চাদের পড়াতে ভীষণ ভালো লাগতো। তাদের ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হতাম আর ভাবতাম আমিও যদি তাদের মতো একটু এমন প্রশান্তিতে থাকতে পারতাম। বাকি সময় দ্বীনি বোনদের সাথে মজলিশে বসতাম, তাদের তালিম শুনতাম।
তালিম শুনে শুনে ধীরে ধীরে আমি হিদায়াহ এর দিকে ধাবিত হই। আমার মনের সকল কষ্টগুলো উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হতো আমার যখন আমি কুরআন - হাদিসের কথা শুনতাম। দ্বীনি বোনদের সাথে যখন সব শেয়ার করি আমার লাইফের সকল ঘটানা, তখন তারা আমাকে দারুণ বুঝ দিতে থাকেন। আর আমিও বুঝতে থাকি আমার লাইফে যা হয়েছে তাতে আল্লাহ কল্যাণ ই রেখেছেন। আসলে আল্লাহ মানুষকে নানা পরীক্ষায় ফেলেন, কষ্ট দেন যেন বান্দা কষ্ট পেয়ে হলেও আবার তাঁর কাছে ফিরে আসে। আর আল্লাহ তাকেই বেশি পরীক্ষায় ফেলেন আর কষ্ট দেন যাকে তিঁনি বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহ আমাকেও কষ্ট দিয়ে তার কাছে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন আমি বুঝিনি, ফিরে যাইনি তাঁর কাছে।
আমি ভাবতাম আমার পক্ষে এতো কষ্ট সহ্য করা সম্ভব নাহ। অথচ আল্লাহ বলেন–
"আল্লাহ সাধ্যাতীত কিছু মানুষের উপর চাপিয়ে দেন নাহ।" [1]
আমি বার বার অভিযোগ করতাম আল্লাহ আমার সাথে কেন এমন হতে দিলেন। সকল অন্যায় কেন আমার সাথেই হল। এগুলা ভেবে আল্লাহকে বার বার দোষ দিতাম। অথচ দোষ আমার ই ছিল। আমি ই আল্লাহকে ভুলে গিয়ে সুখ খুঁজতে গিয়েছিলাম। আর আমার গুনাহের কারনেই যে সুখ খুঁজতে গিয়ে দুঃখে পতিত হচ্ছিলাম তা তখন বুঝতে পারিনি। কেননা আল্লাহ বলেন–
"তোমাদের উপর যে বিপদই উপনীত হয় তা তোমাদের হাতের উপার্জনের কারণেই হয়।"[2]
আমি আগে না জানলেও পরে ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম আমার সাথে ঘটা ঘটনাগুলো আমার ই কর্মের ফল ছিল৷। আমি দিনের পর দিন হারামে লিপ্ত ছিলাম। নামাজ, রোজা, আল্লাহর ইবাদাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। অথচ আমার রব্ব একবার ও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। তাই আমাকে শত কষ্ট দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন তিঁনি ছাড়া আর কেউ আপন নয়। আমাকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। আর তাঁর কাছে ফিরতে পারাতেই আছে পরম শান্তি।
আগে আমার হাজারো রকমের অভিযোগ ছিল আমার জীবন নিয়ে। আমি কেন এতো কষ্ট, অপমান পেলাম। অথচ এগুলো না পেলে যে এখন রব্বের পথে ফিরতেই পারতাম না তা আমি বুঝেছি ধীরে ধীরে। যদি কোনো কষ্ট বা কলঙ্ক আমাকে আমার রবের কাছে ফিরতে শেখায়, তবে তো সুখের চেয়ে সেই কষ্ট ই উত্তম।
রব্বের নিকট এখন আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। আছে এক আসমান পরিমান বা তার চাইতেও বেশি কৃতজ্ঞতা। কারণ আমার রব্ব এখন আমায় হিদায়াহ উপহার দিয়েছেন। যা আমার হাজারো না পাওয়ার কষ্টকে দমিয়ে দেয়। যা আমাকে পাইয়ে দেয় হাজারো সুখ, শান্তি, প্রশান্তি!
কষ্টগুলো আর ভয়ানক অতীত আমাকে বার বার হাতছানি দেয়, আমাকে নিরাশ হতে বলে। তবুও এখন আমি আর নিরাশ হই নাহ। বরং কষ্টগুলোকে উপভোগ করার চেষ্টা করি। কারণ আমার রব্ব ই তো বলেছেন–
"নিঃসন্দেহে কষ্টের সাথেই আছে সস্তি।" [3]
সমাজের লোকেরা যখন আমার পর্দা করা নিয়ে, দ্বীনি ইলম অর্জন করা নিয়ে হাসাহাসি করে আর আমার অতীত নিয়ে খোঁটা দেয় তখন তীব্র কষ্টে আমার অন্তর পুড়ে যেতে চায়। তবে আমি বারংবার ধৈর্য ধারণ করে যাই আর আনন্দে আত্নহারা হয়ে যাই এই ভেবে, যে রব্ব আমাকে ধৈর্য ধারণ করার মতো নিয়ামাহ দিয়েছেন আর এর জন্য রেখে দিয়েছেন অপরিমিত প্রতিদান। কারণ আমার রব্ব বলেন–
"আমি ধৈর্যশীলদেরকে তাদের পুরস্কার অপরিমিতভাবে দিয়ে থাকি।" [4]
[৫]
আমার বয়স তখন ৩০ ছুঁইছুঁই। সমাজের লোকের কথা হজম করে তখন আমি নিজের পায়ে দাড়াতে সক্ষম হয়েছি আমার রব্বের উপর তাওয়াককুল করে। এই কয়েক বছরে আমি এক নতুন আমিকে আবিষ্কার করেছিলাম। দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করার পাশাপাশি দীর্ঘ ৪ বছর কঠোর পরিশ্রম করে হিফয শেষ করি। মাদ্রাসায় পড়ানো, টিউশনি, নিজের পড়াশোনা, দ্বীনি জ্ঞান অর্জন আর সকলের মাঝে তা ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে আমার জীবন আনন্দেই চলে যাচ্ছিল। আমি আর কখনো নিজেকে একা অনুভব করিনি।
একদিন আমার মামার মাধ্যমে একজন অবিবাহিত যুবক আমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। আমি শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম সে হয়তো আমার সম্পর্কে কিছু না জেনে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন৷ পরবর্তীতে মামা আমাকে আস্বস্ত করলেন যে তিনি আমার সম্পর্কে সকল খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ের প্রতি আগ্রহি হোন। আমি আগের কথা ভেবে বিয়ের কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। তবে এবার তো আমার পাশে রব্ব আছেন। তাই তাঁর উপর তাওয়াককুল করে উনার সাথে দেখা করতে রাজি হয়ে যাই।
তার সাথে দেখা করে জানতে পারি সেও একজন কুরআনের হাফিয এবং ইঞ্জিনিয়ার। ডিভোর্সি নারীকে বিয়ে করা সুন্নাহ তাই তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান। আর আমার অতীত জেনে, দ্বীনে ফেরার কাহিনী শুনে আমার প্রতি আগ্রহী হোন। তার কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরতে থাকে। আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকি, যে ডিভোর্সি তকমার জন্য আমার আগের দু'টো বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, সেই ডিভোর্সি তকমার জন্যই আবার বিয়ে হতে যাচ্ছে। আমি জানি এই অসম্ভব টা আমার রব্ব ই সম্ভব করে দিয়েছেন। যার কৃতজ্ঞতা স্বরুপ সারাজীবন সিজদাহ্ তে পরে থাকলেও কম হয়ে যাবে! উনার কথা শুনে আমার মনের সকল ভয় কেটে যায়। তবুও আমি রব্বের সিদ্ধান্ত জানবার জন্য ইস্তিখারা করি। ইস্তিখারা করে পজিটিভ দিক নির্দেশনা পেয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যাই।
[৬]
এবার আমার জীবনের ৩য় নাম্বার বিয়ে। তবে আগের দু'টোর থেকে এটা সম্পুর্ন আলাদা। বিয়েটা পুরো সুন্নাহ অনুযায়ী করা হয়েছিল। আমার নতুন জীবন, নতুন সংসার শুরু হয় নতুন একটা মানুষের সাথে। যিনি নিঃসন্দেহে আমার রব্বের দেওয়া নিয়ামাহ, আমার জন্য উত্তম পার্সন।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার ৩য় নাম্বার সংসারের সময়কাল প্রায় ১৭ বছর হতে চললো। নাহ, এবার আর আমাকে ডিভোর্সি হতে হয়নি। কারন এবার আর আমি ভুল কাউকে বেছে নিইনি। বরং আমার রব্ব আমাকে ভালোবেসে, আমার দু'আ কবুল করে আমাকে উত্তম কাউকে জীবনসঙ্গী হিশেবে দান করেছেন। এবার নিরাশ হবো না আগেই জানতাম। কেননা এবার তো আর আগের মতো ভুল করিনি। এবার তো রব্বের কুরআনে দেওয়া বানী থেকেই দু'আ করেছি–
"হে আমার রব্ব, আমাকে এমন স্ত্রী আর সন্তানাদি দান করো যা আমার চক্ষু শীতল করবে আর আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা বানিয়ে দাও।" [5]
আর আমার রব্ব আমার দু'আ কবুল করেছেন। আমাকে চক্ষু শীতলকারী স্বামী দান করেছেন। আমার সন্তানদেরকেও দ্বীনের পথে চলার তাউফিক দিয়েছেন। আমার অতীত আমাকে হিদায়াহ পেতে সাহায্য করেছে, আর রব্ব অতীতের কষ্টগুলো ভুলিয়ে এখন সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছেন আমাকে!
আমার জীবনের দিকে তাকিয়ে আমি বার বার কুরআনের সেই অমৃত বানীর সত্যায়নের প্রমান পাই–
"আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন।" [6]
রেফারেন্সঃ
[1] সুরাহ বাকারাহ; আয়াহ: ২৮৬
[2] সুরাহ শুরা; আয়াহ: ৩০
[3] সুরাহ ইনশিরাহ; আয়াহ: ০৬
[4] সুরাহ যুমার; আয়াহ: ১০
[5] সুরাহ ফুরকান; আয়াহ: ৭৪
[6] সুরাহ আত তালাক; আয়াহ: ০৭
~সংসার~
Saymaah Islam Meem
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: