Saturday, October 3, 2015

উপাসনা না দাসত্ব

আমাদের ধর্মের প্রতি অনীহার মূল একটা কারন হল, আমরা স্রষ্টাকে ঠিকমতন উপলব্ধি-ই করতে পারিনা। স্রষ্টা্র কথা আমরা জন্মগত মুসলিমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে শুনে বড়ো হয়েছি। একারনে তাঁর প্রতি আমাদের "অতিরিক্ত" কোন আবেগ কাজ করে না। বা তিনি যে আসলে কত মহান একজন সত্তা, সেটা নিয়ে আমরা গভীরভাবে কিছু চিন্তাই করিনা কখনো। তিনি আছেন, আমরাও আছি, আমাদের জীবন চলছে, এইতো বেশ আছি। একদিন মরে যেতে হবে, কিন্তু কেন জানি মৃত্যুর কথা আমরা চিন্তাই করতে চাইনা। মৃত্যু নিয়ে যতবার কথা উঠে, আমরা এড়িয়ে যেতে চাই। কোন এক অজ্ঞাত অদ্ভুত কারনে আমরা ভাবতে চাইনা যে আমাকে মাটির মধ্যে একা পুতে রাখা হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। কি ভয়ঙ্কর অন্ধকার। কেউ নেই আমার সাথে। কেউ নেই। শুধু অন্ধকার জগতের অশরীরী কিছু সত্তা।
প্রশ্ন- পৃথিবীতে মানুষের উদ্দেশ্য কি ?
উঃ- একসময় কিছুই ছিল না। শুধু আল্লাহ ছিলেন। তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করলেন, তাঁর অন্যান্য সৃষ্টি যাদেরকে আমরা জীন ও ফেরেশতা বলে জানি, তাদের সৃষ্টি করলেন। একদিন আল্লাহ ইচ্ছা করলেন, তিনি পৃথিবীতে মানুষকে তাঁর "প্রতিনিধি" হিসেবে পাঠাবেন।
যখন কোন রাজা অন্য কোন দেশে তার প্রতিনিধি পাঠান, প্রতিনিধির মূল উদ্দেশ্য থাকে সেখানে যেয়ে রাজার কথা সবাইকে জানানো, আর রাজা যদি কোন কাজ দিয়ে থাকেন সেগুলো ঠিকঠাক মতন করে আবার নিজ রাজ্যে ফিরে রাজার সন্তুষ্টি অর্জন করা।
আমরা আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ আমাদেরকে ফেরেশতা, জীন ও অন্যান্য সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ করে তৈরী করেছেন। মানুষকে দেওয়া হয়েছে প্রানীজগতের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত মস্তিষ্ক, চিন্তা করার ক্ষমতা, ভাল মন্দ বুঝার ক্ষমতা, অনুভূতি, আবেগ, যুক্তি, কল্পনাশক্তি, বিবেক। একি সাথে পবিত্র ও কলুষিত চিন্তা করার ক্ষমতা। অকল্পনীয় জটিল গঠন মানুষের।
আপনি গ্রামীন ফোনের কাস্টোমার কেয়ারে কাজ করেন। এই মূহুর্তে আপনার সামনে ৩০ মিনিট ধরে যে লোকটি দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে আপনার জান ভাজাভাজা করে ফেলছে তাকে আপনার চড়াতে ইচ্ছা করছে। মনে মনে তার গুষ্টী উদ্ধার করা গালি দিতে দিতে আপনি মিষ্টিমুখে তাকে বলছেন- আর কিছু করতে পারি স্যার?
গুলশানের অভিজাত রাস্তা। একটা কমবয়েসী আকর্ষনীয় মেয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর কাপড় পরে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। একটা চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে খেয়াল করল না, ৪-৫টা ছেলে তাকে চোখ দিয়ে গিলে গিলে খাচ্ছে। যতক্ষন সে তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে রইল তারা তার দিকে তাকিয়ে রইল, নিজেদের মধ্যে অর্থপূর্ন দৃষ্টি আদানপ্রদান করল। রাস্তার উল্টোপাশ দিয়ে একজন চুপচাপ ধরনের যুবক আসছিল। মেয়েটার দিকে চোখ পড়াতে আস্তে করে চোখ নামিয়ে সে তাকে হেটে অতিক্রম করে গেল।
সবগুলোই মানুষের উন্নত মস্তিষ্কের জটিল ক্রীয়াকলাপ।
পৃথিবীতে মানুষের প্রথম ও প্রধান কাজ- আল্লাহর অস্তিত্তে বিশ্বাস করা। এই মহাজগত যে অত্যন্ত ক্ষমতাধর বিচক্ষন কারোর বানানো, সেটা স্বীকার করা ও বিশ্বাস করা। সেটা বিশ্বাস করার জন্য আল্লাহ চারপাশে অসংখ্য প্রমান রেখেছেন। তারাভরা রাতে একবার আকাশের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সমগ্র সৃষ্টির তুলনায় আমরা কতটা ছোট, কতটা নগন্য, কতটা ক্ষুদ্র। প্রত্যেকদিন ঠিক একিভাবে দিন ও রাত আবর্তন করে, ঠিক ৩৬৫ দিন পর পর পৃথিবীটা সূর্যকে একবার করে ঘুরে আসে, একদিনও এদিক ওদিক করে না, লীপ ইয়ারও যদি হয়, সেটাও একদম মাপা। অত্যন্ত নিঁখুত ভাবে কেউ একজন এগুলো ডিজাইন করে রেখেছেন এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রন করছেন কোটি কোটি বছর ধরে।
এরপর গাইডলাইন হিসেবে আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন একটা বই। সেটা আমাদের জন্য কু'রান। তার আগে যখন যে সময়ে যেভাবে প্রয়োজন যতটুকু প্রয়োজন তিনি দিয়ে এসেছেন তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জীল গ্রন্থের মাধ্যমে। বইগুলো তিনি আকাশ থেকে ধাম করে ফেলে দিয়ে বলেননি যে- যাও মুখস্ত কর গিয়ে ! প্রত্যেকটি বই এর প্রতিটি কথা, প্রতিটি আদেশ-নিষেধ মানুষকে বোঝানোর জন্য তিনি মানুষের মধ্যে থেকেই বেছে নিয়েছেন তাঁর মেসেঞ্জার বা নবী-রাসূলদের। তারা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে এই একটি কথাই বলে গেছেন- আল্লাহ কে বিশ্বাস কর, তাকে মেনে নাও একমাত্র উপাস্য হিসেবে, তাঁর কথাগুলো মেনে চল।
কেউ যদি নিজেকে মুসলমান হিসেবে দাবি করে, তাহলে সে বিশ্বাস করে যে, পরকাল বলে একটা বিষয় আছে, যদিও বিজ্ঞান আজীবন গবেষনা করেও এটি প্রমান করতে পারবেনা, এবং বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের সবচে বড়ো বিতর্ক এই যায়গাতেই। কেউ যদি পরকালে বিশ্বাস নাও করে, সে যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো কোন নাস্তিক ও হয়, তাহলেও সে অস্বীকার করতে পারবেনা যে সে একদিন মারা যাবে।
মৃত্যুকে কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা।
যদি পরকাল কেমন এটার একটা ক্ষুদ্রতম ধারনাও পাওয়া যেত, তাহলেও মানুষের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত। বাজারে "কবরের আজাব" জাতীয় যে সিডি গুলো পাওয়া যায় সেটা দেখে আপনার একটু ভয় ভয় লাগতে পারে, কিন্তু সেটাও আসলে কোন না কোন মানুষের বানান। সেই মানুষটা যদি স্টীভেন স্পীলবার্গ এর মতন অসম্ভব মেধাবী কেউ-ও হয়, তাহলেও সেটা কখনই পরকালের জিনিসগুলোকে তুলে ধরতে পারবেনা। পরকাল কেমন এটা জানার জন্য মানুষকে একবার মরে গিয়ে সেটা দেখে এসে আবার বেচে উঠে তারপর মানুষকে জানাতে হবে ! পৃথিবীতে একজন মাত্র মানুষ জিনিসগুলো সরাসরি দেখে এসেছেন, তিনি মুহাম্মদ(স)।
কিন্তু আমাদের জীবনে যেহেতু এটা সম্ভব নয়, তাই মানুষকে বিশ্বাস ও কাজ করতে হয় "অদেখা ভুবনের" উপর। সেটা সবাই করতে পারেনা। হয় বিশ্বাস-ই করতে পারেনা, বা পারলেও কিছু সন্দেহ থাকে( যেমন- জীন ? যাহ, কি বলে! এগুলা আবার হয় নাকি ! কি প্রমান আছে? যতসব ধর্মীয় গাজাখুরি! হেহ !) | অনেকের বিশ্বাস বেশ দৃঢ়, কিন্তু যেই নামাজ-রোজা-যাকাত-হিজাব এর ব্যাপার চলে আসে, তখন নানারকম অজুহাত বের হতে থাকে।
সবচেয়ে সংক্ষেপে বললে, পৃথিবীতে মানুষের উদ্দেশ্য হল-
- তাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করা।
- প্রকৃত স্রষ্টাকে খুজে বের করা
- তার দেখানো নিয়ম অনুসারে জীবন অতিবাহিত করা
- অন্য মানুষদের সত্য ধর্মের দিকে স্রষ্টার শেখান নিয়মে আহ্বান করা।
FREE-WILL কি জিনিস-
এই জিনিসটা কে ব্যবহার করে আজকালকার মুসলিমরা তর্ক করার চেষ্টা করে। যেমন-
- ভাই, সব-ই তো আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। তাহলে এই যে আমি নামায পড়তে পারি না, তাগিদ পাই না( আসলে উনি ইচ্ছা করে পড়েন না) , এটাও তো আল্লাহর ঠিক করা। এখানে আমার কি দোষ ?
- আপা, আল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছে না বলে আমি এখনো হিজাব করা শুরু করতে পারি নাই। আমার কি দোষ বলেন?
- দেখেন, আল্লাহ তো জানেন-ই আমি জান্নাতে যাব নাকি জাহান্নামে যাব, তাইনা ? তাহলে এই যে আমার কষ্ট করে নামায-রোজা, যাকাত, হিজাব, এগুলোর তো মানে নাই। আল্লাহ তো আমার নিয়তি আগেই ঠিক করে রেখেছেন , তাইনা ?
- একজন আত্মহত্যা করেছে। আরেকজন যুক্তি দিচ্ছে- ও যে এভাবে মারা যেত এটা আল্লাহর-ই ঠিক করা। কাজেই ও আর অন্য কোনভাবেই মারা যেতে পারত না। কাজেই আল্লাহই ওকে দিয়ে আত্মহত্যা করিয়েছেন। এখন যদি আল্লাহ ওকে ক্ষমা না করেন, এটা কার দোষ বলেন ?
এই ফালতু যুক্তিটার উত্তর হল-
মানুষ, জীন ও ফেরেশতাদের মধ্যে একমাত্র ফেরেশতা দের কোন FREE WILL নাই। তাদের নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেবার কোন ক্ষমতা নাই। তাদেরকে আল্লাহ যে কাজ দিয়ে রেখেছেন সেটাই তারা করে এবং তাদের অন্যভাবে চিন্তা করার কোন শক্তি আল্লাহ দান করেন নাই। যেমন- ইসরাফীল(আ) হাতে একটা শিঙ্গা নিয়ে কোটি কোটি বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
না, তার ক্ষিদে লাগেনা, পা ব্যথা করে না, দাঁড়িয়ে থাকতে তার কোন সমস্যা হয়না। কারন Allah is taking care of him ! তাদের কোন ফ্রী উইল নেই।
মানুষ আর জীন জাতিকে আল্লাহ FREE WILL দিয়ে বানিয়ে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েছেন। তাদেরকে সঠিক পথের রাস্তা টা দেখিয়ে দিয়েছেন ( নবী এবং বইয়ের মাধ্যমে)| কিন্তু কাউকে আল্লাহ কোন কিছু নিয়ে কোন জোর করেন না। যে যার বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে ইচ্ছা মতন চলতে পারে। আল্লাহ এখন কিছুই বলবেন না। হ্যা, তিনি অসুখ দিতে পারেন, দুর্যোগ দিতে পারেন, কিন্তু আপনার চিন্তায় উনি কোন বাঁধা দিবেন না। আল্লাহ একদিন-ই ধরবেন, মাত্র একদিন, সেদিন কোন ছাড়াছাড়ি নেই। পাই পয়সার হিসেব আদায় করবেন তিনি সেদিন।
FREE WILL এর সবচে বড়ো উদাহরন- আপনি কি গতকালকে ৫ বার মাসজিদে যেয়ে সালাত আদায় করেছেন? আপনার করার কথা ছিল, আপনি করেন নাই। যদিও এ ব্যাপারে আপনার পূর্ন জ্ঞান আছে তাইনা ? এই কাজটার জন্য কি আপনি দায়ী নাকি আল্লাহ দায়ী। কিন্তু আপনি যে গতকালকে যাবেন না, বা আজকে যাবেন এটা আল্লাহ খুব ভালো করেই জানেন। আপনাকে সৃষ্টি করার আগেই জানেন। মহাজগত বানানোর আগেই জানেন।
কিভাবে জানেন? কারন তিনি স্রষ্টা। আপনি চেষ্টা করছেন তাকে জাগতিক জ্ঞানের মধ্যে ধারন করতে, জাগতিক পার্থিক জিনিসের সাথে তাঁর তুলনা করতে, আপনার যুক্তির মধ্যে তাঁকে ধারন করতে। আপনি যেভাবেই তাঁকে চিন্তা করেন, আপনি পারবেন না। কারন আপনি ঠিক যেরকম কল্পনা করবেন, স্রষ্টা একদম তার চেয়ে অন্যরকম।
THERE IS NO POINT IN PERSONIFYING GOD; BECAUSE HE IS NO PERSON, NOR ARE HIS QUALITIES.
শয়তান ঠিক একি কাজ করেছিল। সে আল্লাহকে আমাদের চেয়ে অনেক ভাল করে চিনে, কারন সে আল্লাহর সাথে কথা বলতে পারত, সে জান্নাতেই থাকত। সে তার ফ্রী উইল ব্যবহার করে আল্লাহর অবাধ্যতা করে।
শয়তান কিন্তু জীবনেও বলে নাই- আল্লাহ, আমাকে মানুষের শত্রু বানানোর জন্য আপনি দায়ী।
সে নিজেও এটা জানে।
আদম (আ) কে মানা করার পর-ও তিনি ভুল করে ফেলেন। তিনিও ফ্রী-উইল ব্যবহার করেন। আল্লাহ তাকে সাবধান করেছিলেন, কিন্তু ফল খেতে বাঁধা দেননি।
সবাইকে ফ্রী-উইল দিলে মানুষ আর ফেরেশতার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকত না। মানুষ খারাপ -ভাল দুইটাই করতে পারে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে আল্লাহর ভয়ে, এইটাই মানুষ ও জীনের একটা স্পেশাল গুন।
[] "ইবাদত" শব্দের Mis-Interpretation:
কু'রানে আল্লাহ খুব সোজা কথায় আমাদেরকে বলে দিয়েছেন-
" And I did not create the jinn and mankind except to worship Me." [ 51:56 ]
(আর আমি জীন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোন কারনে সৃষ্টি করিনি)
আপনি যদি বলেন- আমি আজকে ধানমন্ডী যাব। আর আপনি যদি বলেন- আজকে আমি ধানমন্ডি ছাড়া আর কোন যায়গায় যাবনা, যাবনা !!!
দুটির মধ্যে অবশ্যই দ্বিতীয় কথাটিতে অতিরিক্ত জোরাল বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।
"আর আমি জীন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোন কারনে সৃষ্টি করিনি" - এই কথাটির মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের সকল প্রকার সকল অজুহাতকে উড়িয়ে দিয়েছেন।
অজুহাত-
- ভাই, আমি অনেক অনেক ব্যস্ত থাকি সারাদিন। নামাজ কখন পড়ব বলেন ? তাও টাইম পাইলে পড়ি। জুম্মা মিস দেই না।
- ভাই, আমি একজন নিউরোসার্জন। আমার কত কাজ আপনার মতন মানুষের কোন ধারনাও নাই। আমি মানুষের ব্রেইনের ডাক্তার, বুঝলেন ? একেকটা অপারেশনে আমার ১০ ঘন্টাও চলে যায়। এত ধর্মকর্ম করার টাইম আমার নাই। আমার নিয়ত শুধুই মানুষের সেবা করা( টাকা কিন্তু ঠিক-ই নেন) আপনারাই বাড়াবাড়ি করেন ধর্ম নিয়ে। আসলে ধর্ম এত কঠিন কিছু না।
- ভাই, সামনে আমার এডমিশন টেস্ট। দিনে ৫ বার মাসজিদে গেলে আমার পড়া কি আপনি পড়ে দেবেন? বাসায় পড়ে নিব। আল্লাহ তো দয়ালু, তাইনা ?
- আমি মনে করি না এত কম বয়সে আমার হিজাব করার/ দাড়ি রাখার দরকার আছে। আব্বুর মতন বয়স হোক, দেখা যাবে। তাছাড়া আমার মন তো পরিস্কার। ধর্ম নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কি আছে?
আসুন একটু ডিটেইল জানা যাক-
কু'রানে বহুবার ইবাদাহ/উ'বুদু/ আবাদা/ আ'বুদু শব্দগুলো এসেছে। প্রথম শুরু হয়েছে সূরা ফাতিহার ৪ নং আয়াত থেকে-
" ইয়্যাকা না'বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন "
(আমরা একমাত্র আপনার-ই ইবাদত করি এবং আপনার কাছেই সাহায্য চাই) ( 1:4)
তারপরেই আবার ইবাদতের কথা এসেছে সুরা বাকারার ২১ আয়াতে-
মানব জাতি! তোমাদের সেই প্রভুর প্রতি পূর্ণ দাসত্ব ও উপাসনা করো, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা তাঁর প্রতি সবসময় পূর্ণ সচেতন থাকতে পারো। [বাকারাহ ২১]
বেশিরভাগ অনুবাদে উ’বুদুকে ٱعْبُدُوا۟ ‘ই’বাদত করো’ বা ‘উপাসনা করো’ অনুবাদ করা হয়, যা মোটেও উ’বুদুর প্রকৃত অর্থকে প্রকাশ করে না। উ’বুদু এসেছে আবাদা عبد থেকে যার অর্থ দাসত্ব করা। আমরা শুধুই আল্লাহর ﷻ উপাসনা করি না, আমরা আল্লাহর ﷻ দাসত্ব করি।
ইবাদত= পূর্ন দাসত্ব , আব্‌দ = দাস ( যেমন, আব্দুর রাহমান= আল্লাহর দাস)
পুরো কু'রান এর সারমর্ম কিন্তু এই এক লাইন- আল্লাহর দাসত্ব কর !!!
উপাসনা আর দাসত্ব এক জিনিস নয়। উপাসনা আসলে দাসত্বের একটি অংশ। যেমন- লাল হচ্ছে একটি রঙ, কিন্তু সব রঙ লাল নয়। শুধু লাল দিয়ে আপনি সব রঙ কখনোই বুঝাতে পারবেন না।
আল্লাহর উপাসনা করি- শুধু এই চেতনা নিয়ে কখনোই আপনি আল্লাহর ইবাদত( দাসত্ব) করতে পারবেন না। নামায পড়ে ফেললেন, তারমানে এই না এখন আপনি অন্যায়, হারাম কাজ করার জন্য লাইসেন্স পেয়ে গেলেন, এখন আপনি মনের আনন্দে যা ইচ্ছা তাই করবেন, কারন আপনি তো আল্লাহর জন্য নামাজ পড়েই ফেলেছেন, এখন খালি ফুর্তি । আপনাকে প্রতি সেকেন্ডে খেয়াল রাখতে হবে যে, আল্লাহ খুব কাছে থেকে আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন, আপনার প্রতি কাজ, চিন্তা, কল্পনা স্ক্যান করা হচ্ছে, রেকর্ড করা হচ্ছে। আপনি আল্লাহকে না দেখেও তাঁকে ভয় করবেন, তাঁর আদেশ-গুলো মেনে চলবেন, তাঁর কোটি কোটি নিয়ামতের কথা ভেবে কৃতজ্ঞ হবেন, তাঁর পুরস্কার গুলোর কথা ভেবে আনন্দিত হবেন।
" সকল দাস-ই উপাসনা করে, কিন্তু সকল উপাসক দাসত্ব করতে পারেনা"
উপাসনা= Worship, দাসত্ব= Slavery
আপনার যদি নিজেকে আল্লাহর চাকর হিসেবে চিন্তা করতে খুব কষ্ট হয় তাহলে এটাও চিন্তা করে দেখবেন যে, আপনি আসলে একটা (চাকর+ই) চাকরী করছেন আপনার অফিসে। আপনি সেখানে কাজ করেন, বিনিময়ে আপনাকে কিছু টাকা দেয়, আপনি খাবার কিনে খেয়ে বেচে থাকেন। আপনি সেখানে নিয়মিত না গেলে আপনাকে সেখান থেকে স্যাক করে দিবে। কোন খাতির নেই।
আপনি মিনিটে ৬ লিটার অক্সিজেন নিচ্ছেন নাক দিয়ে। এটা আপনার অফিস আপনাকে দেয় না। আল্লাহ দিচ্ছেন। ফ্রী, কোন টাকা লাগে না। আল্লাহ আপনাকে আজকে ঘুম থেকে উঠিয়ে এখনো বাচিয়ে রেখেছেন। পেপার খুলে দেখেন কালকে কয়জন মারা গেছেন। আল্লাহ আপনাকে এখনো সুযোগ দিচ্ছেন। আল্লাহকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অস্বীকার ও অমান্য করার পর-ও আল্লাহ আমাদের কিছু বলছেন না। আমাদেরকে তিনি খাবার, পানি, টাকা, শিক্ষা, আনন্দ, দিয়েই যাচ্ছেন, দিয়েই যাচ্ছেন। আমাদের অকৃতজ্ঞতা সহ্য করেই যাচ্ছেন, করেই যাচ্ছেন।
তাহলে আপনি কার দাস হবেন চিন্তা করে দেখেছেন ???
ঈমানের অনেক লেভেল আছে। এর অনেক গভীরে যাওয়া যায়। আপনি কি বলতে পারবেন মুহাম্মদ (স) যেভাবে আল্লাহকে ফীল করতেন, আপনি সেই একিভাবে আল্লাহকে ফীল করেন ??!
বেশিরভাগ মুসলিম আল্লাহর শুধুমাত্র উপাসনা করে, তাও কোনভাবে ফাকিঝুকি দিয়ে। ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরয , সেটা পড়লেই হয়ে গেল, এমন একটা চিন্তা নিয়ে ঘুরে তারা।
- সূর্য উঠে সাড়ে ৬টায়, কোনরকমে ৬টা ২০ এ উঠে ৪ রাকাত "পশ্চিম দিকে আছাড় খেয়ে" আবার লেপের তলায় শুয়ে পড়ে ভাবা- "ইয়েস ! নামাজ পড়েছি !" অথচ আপনার মাসজিদে যাওয়ার কথা ছিল।
- জুমার নামাজে কোনমতে রাস্তার উপর যায়নামাজ বিছিয়ে ২ রাকাত নামাজ পড়ে আবার বাসায় এসে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া- Prayed Jummah, Alhamdulillah !.
আসুন দেখিয়ে দেই কিভাবে আজকের দিনের মুসলিমরা এখনো আল্লাহর উপাসনা করলেও দাসত্ব করতে পারেনা-
[] খুব ধার্মিক, সব নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়েন, প্রচুর দান করেন, এলাকায় সবাই সম্মান করে। কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে সুদ নেন।
[] খুব ধার্মিক, মানুষকে দেখলেই ইসলামের দাওয়াত দেন, কিন্তু ফকির দেখলে মুখ কালো করে ফেলেন। সিগন্যাল এ গাড়ি থামলে জানালায় একটা ভিক্ষুক এলে না দেখার ভান করেন, বা দিলেও ছিড়া ২ টাকার নোটটা দেন।
[] মোটামুটি নামাজ পড়েন। নামাজ শুরু হলেই প্যান্টটা গুটিয়ে গোড়ালির উপর তুলে ফেলেন। নামাজ শেষ করে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে তা নামিয়ে ফেলেন। কারন এইভাবে সমাজে ঘুরা যাবে না। লোকে কি বলবে !!
[] বন্ধুরা মিলে জুম্মার নামাজ পড়লেন (সবার পিছনে, দুই রাকাত) | তারপর মোড়ের দোকান থেকে কয়েকটা বেনসন সিগারেট কিনে শুরু করলেন রাজনীতি, চাকরি, খেলা, সিনেমার নায়িকা নিয়ে চরম আড্ডা।
[] নামায-রোজা সব-ই করেন, সাথে বাচ্চার জন্মদিনের উদযাপন, পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইন ডে, নানারকম এনিভার্সারী, মেরি ক্রিসমাস, গায়ে হলুদ, বউ-ভাত ইত্যাদি হেন কোন প্রোগ্রাম নাই যেটাতে তাকে পাওয়া যায় না। দেশের সংস্কৃতি তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ন।
[] প্রচুর ধর্ম কর্ম করেন, তাবলীগ-চিল্লায় বহু সময় লাগান। কিন্তু বাসায় স্ত্রী-পুত্র- কন্যাদের কোন সময়-ই দেন না। ভাল করে জানেনও না কে কোন ক্লাসে পড়ে।
[] নামায পড়বেন, কিন্তু মাসজিদে যাওয়াটাকে খুন একটা গুরুত্ত দিবেন না। মনে করেন, নামায বাসায় পড়ে নিলেই হল।
[] মাথায় কাপড় দেন, কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে, যায়গা বুঝে, সময় বুঝে। বাসায় টুকটাক নামাজ রোজা করেন, কিন্তু বিয়ের প্রোগ্রামে যাবেন দামি ফিনফিনে অর্ধ-স্বচ্ছ শাড়ী পরে।
[] আমাদের দেশের চ্যানেলগুলোতে সংবাদ পাঠিকা দের দেখবেন রমজানে মাথায় একটা আধা-ঘোমটা থাকে, ঠিক ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই তা নেমে যায়।
[] সৌদি আরবে গেলে বোরখা পরেন, কিন্তু প্লেন এয়ারপোর্ট ছাড়ার সাথে সাথে আবার ঐ বর্বর প্রাচীন বোরখা খুলে আধুনিক কোন পোশাক পরে নেন।
মুখে বলেন হিজাব করি, কিন্তু আসলে পরেন একটা অত্যন্ত রংচঙ্গে খীমার( যেটা দিয়ে মাথা ঢাকা হয়) | আর নিচে থাকে "লেগিংস" নামে স্কিন-টাইট সুইমসুটের মতন কোন জিনিস।
আমি যতগুলো উদাহরন দিলাম, এরা একজন-ও আল্লাহর দাসত্ব করতে পারেনা। এরা শুধুমাত্র আল্লাহর উপাসনা করে, অর্থাৎ ধর্মীয় রীতি গুলো পালন করে। "মানুষ কি মনে করবে"- এটা এদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ইসলামে কি বলা আছে বা আল্লাহ কি মনে করবেন এটা নিয়ে এরা অতটা মাথা ঘামায় না।
আমরা কেন পূর্ন দাস হতে পারিনা জানেন?
কারন, ইসলাম নিয়ে আমরা প্রচুর প্রশ্ন তুলি। যেটা আমাদের ভাল লাগে না, বা যেটায় কষ্ট বেশি, সেটাকে আমরা নিজেদের পছন্দ মতন মডিফাই করে ফেলি। আমরা ইসলাম মানব কিন্তু দাড়ি রাখবনা, কারন আমাদের ভাল লাগেনা, খ্যাত লাগে। আমরা ইসলাম মানব কিন্তু নিয়ম মতন হিজাব করব না, কারন তাহলে সুন্দর সুন্দর জামা পরে ঘুরা যাবেনা।
আসুন একটু পেছন দিকে ফিরে তাকাই-
ইবরাহীম (আ) কে আল্লাহ বলেছিলেন- তোমার একমাত্র বাচ্চা আর স্ত্রী কে জনমানবহীন মরুভূমিতে ফেলে দিয়ে আস। উত্তরে তিনি কিন্তু বলেন নাই- আল্লাহ, আমি ইসলামের সব ভালবাসি, একমাত্র এই নিয়মটি ছাড়া।
আল্লাহ তাকে বলেছিলেন- তোমার ছেলেকে আমার জন্য কুরবানী কর তো ।
তিনি কিন্তু বলেন নাই- আল্লাহ ! এই নিয়মটি বাদে ইসলাম একদম পারফেক্ট।আমার ছেলেটাকে কি জবাই না দিলেই নয় !!?
তিনি সানন্দে তা করেছিলেন । সানন্দে।
SLAVE! SLAVERY !
আপনি পারবেন ? নিজেকে জিজ্ঞেশ করুন।
আমাদের প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নেই। এটাই দাসত্ব।
একজন দাস কে কখনই বলে দিতে হবে না যে নামাযের সময় হয়েছে। আযান হবে, ঠিক সে মাসজিদে চলে যাবে। সেটা ভোর ৬টা হোক আর রাত ৮টা হোক। সে যাবেই। একজন আল্লাহর দাসকে বলে দিতে হবে না- সিগারেট খেও না, এটা হারাম। সে খুব ভাল করেই এটার থেকে দূরে থাকবে। একজন আল্লাহর দাস কে কখনোই বলে দিতে হবে না- এই টাইট জামাটা পোরনা, এই মেকাপ গুলো লাগিওনা। সে নিজে থেকেই তাকে এমন করে ঢেকে রাখবে যে কোন পুরুষ চাইলেও তাকে দেখে আনন্দ মিটাতে পারবেনা।
আপনি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখেন, প্রতিদিন ৫ বার করে সপ্তাহে ৩৫ বার আল্লাহ আমাদের ডাকেন মাসজিদে। গত সপ্তাহে ৩৫ বারের মধ্যে আপনি কতবার গিয়েছেন তার ডাকে সাড়া দিতে?
হাস্যকর ব্যাপার কি, আমরা কিছু করি আর না করি, আমরা চাওয়ার বেলায় চাই জান্নাতুল ফেরদৌস, সর্বোচ্চ জান্নাত। যেখানে মুহাম্মদ(স) থাকবেন, অন্যান্য নবীরা থাকবেন, সেখানে তাদের সাথে আমাদের থাকার কথা চাওয়ার আগে আপনি চিন্তা করে দেখেন রাস্তার ফকির যদি ওবামাকে চিঠি লিখে যে- আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চাই !- সেটা কেমন শুনাবে।
আমরা কি আদৌ কোন চেষ্টা করি ???
আল্লাহর পূর্ন দাস হতে হলে আমাদেরকে আমাদের মিথ্যা "প্রভু" গুলোকে বাদ দিতে হবে। আমাদের চিন্তাকে আরো পরিশোধিত করতে হবে। না, মুসলমানরা সরাসরি কোন মূর্তি পূজা করে না, কিন্তু তারা যেটা করে সেটা আরো বিপজ্জনক। তারা অদৃশ্য সব জিনিসকে সেই সময়গুলো দিয়ে দেয়, যেটা তাদের আল্লাহকে দেবার কথা ছিল।
দেখে নিন-
[] ভালবাসার মানুষকে মানুষ বলে- তুমি তো আমার জীবন। আমার জীবন মরন সব-ই তো তোমার জন্য।
[] বাবা মা সন্তানকে বলে- বাবা, আমাদের জীবনে আর কে আছে তুমি ছাড়া ?
[] চাকরির জন্য- এই চাকরিটা আমার জীবন-জীবিকা ভাই। এটা গেলে আমি শেষ।
একটা ভাল চাকরি, টাকা, বাড়ী, গাড়ি, বড়ো ডিগ্রী, ভালবাসা, ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা, বিদেশে সুখের একটা জীবনে জন্য আমরা আমাদের ধর্মকে বিক্রি করে দিচ্ছি। আমরা কেন বারবার ভুলে যাই যে একদিন আমরা উলঙ্গ হয়ে মায়ের পেট থেকে অসহায় হয়ে বের হয়েছিলাম, আবার একদিন আমাদেরকে উলঙ্গ অসহায় করে সস্তা সাদা কাপড়ে পেচিয়ে আমাদের আত্মীয়রা একটা গর্তে পুতে রেখে চলে আসবে আর এক সপ্তাহ পর ভুলে যাবে।
সেই অন্ধকার একাকী জীবনটার জন্য কি আমরা কিছু নিয়ে যাচ্ছি পৃথিবী থেকে ?
" হে আল্লাহ ! আপনি আমার সৃষ্টিকর্তা। আমি তো আপনার কাছ থেকেই এসেছি, আমি তো আপনার কাছেই ফেরত যাব। আমাকে পার্থিব জীবনের মোহ থেকে মুক্তি দিন। আমাকে সাহায্য করুন। আমাকে যে উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন তা করার মতন শক্তি ও বুদ্ধি দান করুন। আমাকে সরল পথ দেখান। আমি একমাত্র আপনার-ই পরিপূর্ন দাসত্ব করি। আমি একমাত্র আপনার কাছেই আত্মসমর্পন করলাম। আমার জীবন, আমার অস্তিত্ত, আমার মৃত্যু, সব-ই একমাত্র আপনার জন্য। আমার তো অস্তিত্ব ছিল না। আপনি-ই অসীম করুনায় আমাকে গভীর যত্নে সৃষ্টি করেছেন।আমাকে সাহায্য করুন হে আমার মালিক। যাতে কবরের অন্ধকার দিনগুলোতে আমি আপনার দয়া পেতে পারি। আমি জানি আমি আমার সর্বশক্তি দিয়েও সেই জীবন টা কল্পনা করতে পারবনা, আমাকে আপনি সেই ক্ষমতা দেন নাই, এটা আমি জানি। আপনি আমাকে দয়া ও করুনা করুন। আমীন"

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This
Previous Post
Next Post

0 comments: