Tuesday, October 20, 2015

স্ত্রীর কাছে লেখা আনোয়ার পাশার শেষ মর্মস্পর্শী চিঠিটি

গাজী আনোয়ার পাশা ঐ সকল তুর্কী বীর মুজাহিদদের মধ্যে একজন, যারা আজীবন ইসলামের জন্য শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে লড়ে গেছেন। অবশেষে তিনি রাশিয়ার বলশেভিকদের বিরুদ্ধে জিহাদে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি শাহাদাতের মাত্র একদিন পূর্বে তাঁর স্ত্রী নাজিয়া সুলতানার নামে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। নাজিয়া পরবর্তীতে সে চিঠি তুরস্কের সংবাদ পত্রে প্রকাশ করেন। সেই পত্রটি এতই হৃদয়স্পর্শী, মর্মভেদী এবং শিক্ষণীয় যে,প্রত্যেক নওজোয়ান তরুণের তা দেখা উচিৎ। চিঠিটি নিচে দেওয়া হলোঃ
" মহান আল্লাহ তা'আলা তোমার হেফাজতকারী। তোমার লেখা সর্বশেষ পত্রটি এই মুহূর্তে আমার সামনেই আছে। মনে রেখো, তোমার এ চিঠি আজীবন আমার অন্তরে গেঁথে থাকবে। তোমার সে মায়াবী প্রিয় মুখটি আজ আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তোমার হাতের লেখা পত্রটি প্রতিটি লাইনের অক্ষরে অক্ষরে তাকালেই তোমার আঙ্গুলগুলো নাড়া-চাড়ার দৃশ্য আমার দু চোখে ভেসে উঠে, যেগুলো এক সময় আমার চুল নিয়ে খেলা করত। মাঝে মাঝে তাঁবুর প্রকোষ্ঠ ও বিষণ্ণ পরিবেশে তোমার চেহারা আর নয়নযুগল ভেসে ওঠে।
হায়! তুমি লিখেছ- আমি কিনা তোমায় ভুলে বসে আছি, তোমার ভালবাসার কোন মূল্য আমি দেইনি। তুমি বলেছ, আমি তোমার প্রেমময় হৃদয়কে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দূরদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আগুন আর রক্তের খেলায় মেতে আছি। আমি মোটেও ভাবছিনা যে, এক হতভাগী নারী আমার বিরহে নিস্তব্ধ রজনীতে অস্থির হয়ে আছে, আর আকাশের তারা গুনছে। তুমি আরও বলেছ যে, আমি নিছক তরবারীর প্রতিই আসক্ত ও অনুরক্ত। কিন্তু এ কথাগুলো লেখার সময় কেন তুমি ভেবে দেখনি যে, তোমার এ শব্দগুলো যা তুমি নিঃসন্দেহে খাঁটি ভালবাসার টানে লিখেছ- আমার অন্তরকে কি নিদারুণ বীভৎসতায় রিক্তাক্ত করে দেবে। আমি তোমাকে কি করে বোঝাব যে, পৃথিবীতে আমি তোমার চেয়ে অধিক কাউকে ভালবাসি না। তুমিই আমার সকল প্রেম ও ভালভবাসার আদিঅন্ত। ইতিপূর্বে আমি কখনো কাউকে ভালবাসিনি। তুমিই, তুমিই আমার অন্তরকে ছিনিয়ে নিয়েছ।
তবুও কেন আজি আমি তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এত দূরে? হে প্রাণ প্রিয়া! এ প্রশ্ন তুমি অবশ্যই করতে পার। তাহলে শুন! ধন-সম্পদের মোহে আমি তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। ক্ষমতার লিপ্সা কিংবা মসনদের স্বপ্নেও আমি আজ এত দূরে নই।যেমনটি শত্রুরা আমার নামে রটিয়েছে। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে অর্পিত কর্তব্যের টানেই কেবল আমি তোমার থেকে পৃথক হয়েছি। জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর চেয়ে বড় কোন ফরজ কর্তব্য হতে পারে না। এটা এমনই মহিমাময় ফরয, যার প্রতিজ্ঞা করলেই মানুষ জান্নাতুল ফিরদাউসের উপযুক্ত হয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ! আমি কেবল তা প্রতিজ্ঞাতেই সীমাবদ্ধ রাখি নাই বরং নিখুঁত বাস্তবতায় তা পরিণত করেছি। তোমার বিরহ ব্যথা আমাকে সর্বক্ষণ পীড়া দেয়,কিন্তু এই বিরহে আমি সীমাহীন আনন্দিত। কেননা শুধুমাত্র তোমার ভালবাসাই আমার প্রতিজ্ঞা ও সংকল্পের পথে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল। আল্লাহ তা'আলার নিকট হাজারো শোকর যে, এই পরীক্ষায় আমি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছি। আমি আল্লাহ তা'আলার মুহাব্বাত ও নির্দেশকে নিজের ইচ্ছা ও চাহিদার উপর প্রাধান্য ও অগ্রগণ্য করার অভিজানে সফল হয়েছি। এ জন্য তোমার আনন্দিত হওয়া উচিৎ। কেননা তোমার স্বামী এত মজবুত ঈমানের অধিকারী যে, স্বয়ং তোমার ভালবাসাকেউ আল্লাহর ভালবাসার পথে কুরবানী করতে পারে।
তোমার উপর তরবারীর জিহাদ ফরয নয়। তবে তুমি জিহাদের বিধানের আওতামুক্ত নও। নারী কিংবা পুরুষ কোন মুসলমানই জিহাদের বিধানের বাইরে নয়। তোমার জিহাদ হুলো তুমিও নিজের চাহিদা ও ভালবাসাকে আল্লাহ তা'আলার ভালবাসার উপর প্রাধান্য দিবে না। স্বামীর সঙ্গে আন্তরিক ভালবসাকে আরও প্রগাঢ় করবে। স্মরণ রাখবে-এই কামনা কখনো করবে না যে, তোমার স্বামী জিহাদের ময়দান হতে অক্ষতাবস্থায় তোমার ভালবাসা ও আদরের কোলে ফিরে আসুক। এই কামনা হবে নিজের স্বার্থের জন্য,যা আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয়। সর্বক্ষণ এই দু'আ করবে যেন আল্লাহ তা'আলা তোমার স্বামীর জিহাদকে কবুল করেন। তাকে হয় বিজয়ীবেশে ফিরিয়ে আনুক নতুবা শাহাদাতের অমীয় সুধা পানে ধন্য করুক। তুমি জান, আমার এই ঠোঁট কখনো নাপাক মদ স্পর্শ করেনি বরং তা আল্লাহর জিকির ও তিলাওয়াতে সতেজ ছিল।
প্রিয় নাজিয়া! আহ! সে মুহূর্তটি কতইনা মোবারক ও মহীমাময় হবে,যখন এ শীর ( যাকে তুমি অত্যন্ত চমৎকার বলতে) দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হবে( যা তোমার দৃষ্টিতে কোন যোদ্ধার দেহ ছিল না,ছিল এক লাবণ্যময় প্রিয়দর্শী পুরুষের দেহ)। এই মুহূর্তে আনোয়ারের সবচে প্রবল ইচ্ছা ও বাসনা হলো শহীদ হওয়া এবং হযরত খালিদ বিন অলীদের(রা) সঙ্গে হাশরের ময়দানে উত্থিত হওয়া। এ দুনিয়ার তৃপ্তি ও প্রাপ্তি যেহেতু ক্ষণস্থায়ী,সেহেতু মৃত্যুকে ভয় পাওয়া কোনো মানে আছে কি? মৃত্যু যখন সুনিশ্চিত,তাহলে মানুষ কেন বিছানায় শুয়ে মরবে? শাহাদাতের মৃত্যু,মৃত্যু নয়,বরং প্রকৃত জীবন,অনাদী অনন্ত কালের জীবন।
নাজিয়া! তোমার প্রতি আমার প্রথম ওসিয়ত হল আমি শহীদ হলে, তোমার দেবর,আমার ছোট ভাই নূরী পাশার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে। তোমার পরে আমার সর্বাধিক প্রিয় পাত্র হল নূরী। আমি চাই আমার আখেরাতের যাত্রার পর থেকে নিয়ে আজীবন সে বিশ্বস্ততার সাথে তোমার খেদমত করুক।
আমার দ্বিতীয় ওসিয়ত হলো- তোমার যত সন্তান জন্ম হবে তাদের সকলকে আমার জীবনের ইতিহাস শুনাবে এবং তাদেরকে ইসলাম ও দেশের জন্য জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় পাঠিয়ে দিবে। যদি তুমি আমার এই ওসিয়তকে রক্ষা না কর,তবে স্মরণ রেখো, জান্নাতে আমি তোমার থেকে পৃথক থাকব।
আমার তৃতীয় ওসীয়ত হলো- মুস্তফা কামাল পাশার সাথে সবসময় সুন্দর আচরণ করবে। সাধ্যমত তার সাহায্য করবে। কেননা,এই মুহূর্তে আল্লাহ তা'আলা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অর্জন তার উপরই ন্যস্ত রেখেছেন।
প্রিয়া! এবার তাহলে বিদায়! কেন যেন আমার মন বলছে যে, এ চিঠিই তোমার প্রতি আমার শেষ চিঠি। এর পর আর কোন চিঠি লেখার সুযোগ হবে না। কী আশ্চর্য্য! আগামী কালই শহীদ হয়ে যাব। দেখো,ধৈর্য্য হারাবে না। আমার শাহাদাতের পর পেরেশান ও ব্যাকুল হওয়ার স্থলে খুশি ও আনন্দিত হবে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাস্তায় আমাকে কবুল করেছেন,এটা তোমার জন্য গৌরবের বিষয়। নাজিয়া! এখন বিদায় নিচ্ছি। আমার কল্পনা ও স্বপ্নের জগতে তোমাকে আলিঙ্গন করছি। ইনশাআল্লাহ,জান্নাতে দেখা হবে। তারপর কখনো বিচ্ছিন্ন হবো না।"
এখানে স্মর্তব্য, এই পত্র লেখার সময় মুস্তফা কামাল পাশা কেবলমাত্র ইসলামের একজন সাধারণ মুজাহিদ হিসেবে খ্যাত ছিলেন।তখনো তিনি তুরস্কে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, যা তাকে পরবর্তীতে জগদ্বিখ্যাত প্রবাদপুরুষে পরিণত করেছিল, এর কিছুকালে পরেই তিনি এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যার কারণ আজ তিনি ইসলামের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত হন।

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This
Previous Post
Next Post

0 comments: