প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন হয়? কিভাবে মানুষ এত ঔদ্ধত্যপূর্ন দুঃসাহস দেখাতে পারে? এর অনেক উত্তর আছে। একটা কারন হচ্ছে, স্রষ্টাকে দেখা যায় না। মৃত্যুকে দেখা যায়, কিন্তু এর পরের জগতটাকে দেখা তো দূরের কথা, কল্পনাও করা যায়না। তাই ধর্মকে প্র্যাক্টিস করতে হলে মানুষকে সেই পরিমান বিশ্বাস অর্জন করতে হয় আগে। যে শুধু একদিন জুমাহর নামাজ পড়ে, সে এই কাজটা যতটা করে বিশ্বাস থেকে, তার চেয়ে বেশি করে সামাজিকতা থেকে, ছোটবেলার অভ্যাস থেকে, শুক্রবারে তার বাবা বাসায় থাকে এই কারনে, নামাযে না গেলে মা বকবে এই কারনে। তার বিশ্বাস এখনো তাকে ৫বার নামাজ আদায় করাতে পারছেনা। আপনাকে যদি একজন ধর্মহীন মুসলমান এসে বলে যে- আমি আগে নামায পড়তাম, অনেকদিন ধরে পড়িনা। কই, আমার জীবন তো আগের মতই চলছে। স্রষ্টা তো আমাকে কোন শাস্তি দিচ্ছেন না। তাহলে নামাজ না পড়ে তো আমার কোন ক্ষতি হচ্ছেনা।
এই মানুষটিকে আপনি উত্তরে কি বলবেন ?! আপাত দৃষ্টিতে সাদা চোখে দেখলে এরকম মনে হয় যে ধর্ম ছাড়াই তো জীবন চলে যাচ্ছে। তাহলে ধর্মের কি দরকার? এত কষ্ট করে সারাজীবন ধরে প্রতিদিন ৫বার নামাজ পড়ার কি দরকার?
এই মানুষগুলো এবং আরো কোটি কোটি ধর্মহীন মুসলমানের সমস্যা হল , স্রষ্টা সম্পর্কে এদের এখনো ভালমতন ধারনা হয়নি। স্রষ্টা কিভাবে কাজ করেন, কিভাবে মহাজগতকে নিয়ন্ত্রন করেন এগুলো নিয়ে এরা কখনো চিন্তা করেনা। একজন সৃষ্টির পক্ষে তার স্রষ্টাকে কখনই পুরো জানা সম্ভব নয়। আপনার ঘড়িটা কি জানে আপনার নাম কি, আপনি ছেলে না মেয়ে,বা আপনি কোনদেশি ? আপনার ঘড়িটা একটা সৃষ্টি, তার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। একইভাবে মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি, তার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে যেটার বাইরে সে কখনই যেতে পারেনা। আমি আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে স্রষ্টাকে চিন্তা করার চেষ্টা করেছিলাম। ফলাফল খুব ভয়ঙ্কর হয়েছিল। ভয়ঙ্কর একধরনের অনুভূতি আমার হয়েছিল, আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা অসীম খাদের মধ্যে দিয়ে পড়ে যাচ্ছি। মানুষ অসীম কোন কিছুকে গ্রহন করতে পারেনা, আমিও পারিনি। আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার মস্তিষ্ক বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে আমাকে সেই বিচিত্র অনুভূতি থেকে সরে আসতে হয়েছে নিজের মঙ্গলের জন্যই।
স্রষ্টাকে নিয়ে অল্প একটু চিন্তা করলেই একজন মানুষ উপলব্ধি করতে পারে যে, তাঁর তুলনায় আমরা কত তুচ্ছ, কত নগন্য একটি প্রায় জড় পদার্থ। এই তুচ্ছবোধ থেকেই শুরু হয় তাঁর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পন, তাঁর প্রতি আনুগত্য, তাঁর ইচ্ছা কে নিজের ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দেওয়া, তিনি অনন্তকালের যে আনন্দের ও শান্তির জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটার জন্য চেষ্টা করা, বার বার তাঁর কাছে ক্ষমা ও সাহায্য চাওয়া, জীবনের প্রতিমূহুর্তে তাঁকে স্মরণ করা।
মানুষের আরেকটা সমস্যা হল, মানুষ আল্লাহর দয়া দেখতে ও বুঝতে পারেনা। মানুষ মনে করে এটাই আসলে নরমাল, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ মনে করে সে সবসময়ই ভাল থাকবে, তার কোন অসুবিধা হতেই পারেনা। আর যদি হয়ও, তখন সে ভেবে নেয় স্রষ্টা তার প্রতি অবিচার করছেন। বেশিরভাগ মানুষ এই চক্র থেকে বের হতে পারেনা ও বিশ্বাসের পরবর্তী লেভেলে যেতে পারেনা।
এই আর্টিকেল এ আল্লাহর একটি মাত্র নাম কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেটি "আর-রাহমান" . আল্লাহর অনেকগুলো গুনবাচক নাম আছে। আল্লাহ্ চান যে আমরা তাঁর নামগুলো বুঝি ও উপলব্ধি করি। আপনি যদি এই আর্টিকেল টি পড়ার পরে আর-রাহমান শব্দটি নিয়ে চিন্তা করেন, আপনি আরো গভীরভাবে তাঁকে উপলব্ধি করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
কুর'আনে বহুবার আর-রাহমান শব্দটি আছে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, আর-রাহমানির রাহীম...সহ বহুবার আছে। বিশ্লেষণের জন্য আমি বেছে নিয়েছি সূরা আর-রাহমানের প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতটি।
আয়াতদুটি হচ্ছে- ১) আর-রাহমান ২) আ'ল্লামাল কুর'আন
অর্থ এরকম হয়- ১) আর-রাহমান ২) কুর'আন শিখিয়েছেন
আল্লাহ্ এখানে একটি কাজ করেছেন। এই দুইটি আয়াত আসলে একটি বাক্য, যার অর্থঃ আর-রাহমান কুর'আন শিখিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ্ এটাকে মাঝখান থেকে ভেঙ্গে দিয়েছেন। তিনি একটি সম্পূর্ন বাক্যকে ভেঙ্গে দুটি বাক্য বানিয়েছেন।
সচরাচর এরকম করা হয় না। আপনি কি কখনো লিখবেন-
আমার বাবা। আমাকে খুব ভালবাসেন।
আপনি কি এভাবে লিখবেন?? না, আপনি লিখবেন না। আপনি লিখবেন- আমার বাবা আমাকে খুব ভালবাসেন। আপনি একটি বাক্যকে মাঝখান দিয়ে ভাঙ্গবেন না।
আল্লাহ্ কেন করলেন?? আল্লাহ্ কি চাচ্ছেন এখানে?
আল্লাহ্ চাচ্ছেন যাতে আপনি আর-রাহমান শব্দটি নিয়ে চিন্তা করেন। আপনি যেন আর-রাহমান পড়েই পরের আয়াতে না চলে যান। আপনি যেন খেয়াল করেন আল্লাহ্ এখানে গ্রামার ভেঙ্গেছেন, আপনি যেন নিজেকে প্রশ্ন করেন আল্লাহ্ কেন প্রচলিত গ্রামার ভেঙ্গেছেন। আপনি যেন চিন্তা করেন, আল্লাহ্ কেন একটি সূরা শুরু করলেন একটিমাত্র শব্দ দিয়ে। যদি এটি একটি পুরো বাক্য হত, আমরা বাক্যটি নিয়ে চিন্তা করতাম। আল্লাহ্ চেয়েছেন আপনি শুধুমাত্র আর-রাহমান শব্দটিকে বুঝেন, চিন্তা করেন, উপলব্ধি করেন, তারপর পরের আয়াতে যান।
আর-রাহমান শব্দটির বাংলা ও ইংরেজী অনুবাদ দাঁড়ায়-
পরম করুনাময়
The Most Merciful
The Beneficent
The Most Gracious
অনুবাদের একটি সমস্যা আছে। অনুবাদ তৈরী করার কারন হচ্ছে যাতে আমি আপনি সহজ দৈনন্দিন ভাষায় আমাদের মতন করে কুর'আন কে বুঝতে পারি। আমাদের জীবনে Beneficent, Gracious এই শব্দগুলো আমরা ব্যবহার করিনা। কাজেই আমরা যখন দেখি আর-রাহমান মানে হচ্ছে Beneficent, আমরা এটা নিয়ে আর খুব বেশি চিন্তা করিনা যেহেতু আমরা আরবি জানিনা, আর এইরকম খটমটে একটা অনুবাদ করাতে এখন ইংরেজীটাও বুঝিনা ! যদি এমন সব শব্দ দিয়ে কুর'আন অনুবাদ করা হয় যেই অনুবাদের মানেই আমরা বুঝিনা, তাহলে অনুবাদ আসলে খুব একটা সাহায্য করেনা।
বাকি রইল আরেকটি অর্থ- The Merciful. এটিরও একটা সমস্যা আছে। কারন আর-রাহমান আর Merciful আসলে এক জিনিস নয়। রাহ্মা আর Mercy দুটির অর্থ আলাদা। ব্যাখ্যা নিচে পাবেন।
রাহমান এসেছে আরবি "রাহমা" থেকে । রাহমা শব্দটির একটি অর্থ "মায়ের গর্ভ" . যখন একজন নারী গর্ভধারন করে, তখন তার জরায়ু বা ইউটেরাস কে আরবিতে রাহমা বলা হয় ।
গর্ভ? জরায়ু? এত কিছু থাকতে মায়ের জরায়ু কেন?!
মায়ের গর্ভ তার অনাগত শিশুর জন্য নিরাপদতম স্থান। এরচে নিরাপদ কোন স্থান তার শিশুর জন্য তৈরী করে দেওয়া সম্ভব নয়। মায়ের সাথে শিশুর কিছু সম্পর্ক আছে।
গর্ভের শিশুটি কি তার মা সম্পর্কে জানে ? উত্তর- না, জানে না। তার কোন ধারনা নেই কে তার মা।
মা কি তার শিশু সম্পর্কে জানে? উত্তর- হ্যা, সে জানে। যে কারোর চেয়ে ভাল জানে।
গর্ভের শিশুটি কি তার মাকে ভালবাসে? উত্তর- না। তার সে সময় এখনো আসেনি।
মা কি তার শিশুটিকে ভালবাসে যদিও সে তাকে দেখেনি? উত্তর- হ্যা। অত্যন্ত ভালবাসে।
মা কি তার গর্ভের শিশুটির সবরকমের যত্ন নিচ্ছে? উত্তর- হ্যা, সে নিচ্ছে।
গর্ভের শিশুটির পুরো জগত হচ্ছে তার মা। যদিও সে তার মাকে চেনেই না, কিন্তু তারপরো তার সম্ভাব্য সকল চাহিদা তার মা পূরন করে দিচ্ছে, এবং অত্যন্ত অত্যন্ত আদর যত্ন মায়া মমতা নিরাপত্তা ভালবাসার সাথে। শিশুটির কোন ধারনাও নেই তার মা তাকে কতটা ভালবাসে।
আপনাকে কেউ মারতে আসছে। আপনি দেখবেন, আপনার অজান্তেই আপনি আপনার হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছেন আত্মরক্ষার জন্য। এটা মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি বা ন্যাচারাল রিফ্লেক্স। কিন্তু আপনি দেখবেন, একজন মা সবসময় বাড়তি সচেতন তার পেটের ব্যাপারে। যেকোন একটা টেবিলের কোনা দিয়ে যাওয়ার সময়-ও তিনি তার পেটের উপর একটা হাত রাখবেন যাতে তার পেটে বিন্দুমাত্র কোন বাড়তি আঘাত না লাগে। কখনও পড়ে গেলেও তিনি সবার আগে তার পেটে হাত দিবেন সাথে সাথে। তার নিজের নিরাপত্তার চেয়ে শিশুটির নিরাপত্তা তার কাছে অনেক বেশি জরুরি। যারা মা হয়েছেন বা হবেন, তারা এই কথাগুলো খুব ভাল করে জানেন।
এই ধরনের একটা সম্পর্ক থেকে এসেছে রাহমা শব্দটি। আদর, মমতা, ভালবাসার নিবিড়তম একটা সম্পর্ক। এটাকে যখন অনুবাদ করা হয় Mercy বা করুনা হিসেবে, তখন একটা সমস্যা তৈরী হয় । এটা মূল ভাব থেকে সরে যায়। আমি আপনাকে উদাহরন দিচ্ছি। করুনা বলতে আমরা বুঝি যে, আসলে একজনের শাস্তি পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আপনি তাকে দয়া করে, করুনা করে, শাস্তি দিলেন না, তাকে শাস্তি থেকে রেহাই দিলেন, তাকে মাফ করে দিলেন।
আপনার কাজের ছেলেটা একটা প্লেট ভেঙ্গেছে। দামি জিনিস, আপনার খুব রাগ হচ্ছে। আপনি ঠিক করলেন তাকে একটা চড় দিবেন। তাকে ডাক দিয়ে সামনে আনার পর দেখলেন সে মাথা নিচু করে অপরাধীর মতন তাকিয়ে আছে ও ভয়ে একটু একটু কাঁপছে। আপনার করুনা হল। আপনি বললেন- যা, এরপর থেকে সাবধানে কাজ করবি। মনে থাকে যেন।
আপনি করুনা দেখালেন। আপনি Mercy দেখালেন। কিন্তু আপনি রাহমা দেখালেন না। কারন রাহমা ছিল উপরে মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্ক।
করুনা বা Mercy বলতেই আমরা আগে শাস্তির কথা ভেবে নেই, কারন শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়াটাই আমাদের কাছে করুনা। কিন্তু রাহমা শব্দের সাথে শাস্তির কোন সম্পর্কই নেই !!! এটি শাস্তির সম্পূর্ন বিপরীত, এখানে ভয়ের কোন ব্যাপার নেই, আতঙ্কের কোন ব্যাপার নেই।
যে আপনার সাথে রাহমা দেখায় , তার আচরন হবে অত্যন্ত নরম, অত্যন্ত নম্র, অত্যন্ত আন্তরিক, সে আপনাকে খুবই কেয়ার করবে, আপনার কথা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনবে, আপনাকে মন থেকে সাহায্য করবে, আপনার প্রতি সহমর্মিতা ও ভালবাসা দেখাবে। এরকম মানুষ সমাজে বিরল, কিন্তু আছে। আপনি রিকসা থেকে রাস্তায় পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছেন। আশেপাশের কেউ পাত্তাও দিল না। একজন আন্টি তার গাড়ি থামিয়ে আপনাকে তুলে নিলেন। আপনাকে সাহস দিলেন, সুন্দর করে কথা বললেন। আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করালেন। তারপর আপনাকে গাড়ি করে বাসায় নামিয়ে দিলেন। এটা হচ্ছে রাহমা ।
রাহমা শব্দটি দিয়ে আল্লাহ্ আমাদের ব্যবহার, সৌজন্য ও আন্তরিকতা শিখিয়েছেন। আপনি দেখবেন, আজকের পৃথিবীতে বড় বড় কোম্পানীগুলো ভাল ব্যবহার, আন্তরিকতা, সৌজন্যবোধ, এগুলোকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দেয়। একজন ডাক্তার যিনি আপনার সাথে খুব সুন্দর করে আন্তরিকভাবে কথা বলেন তার কাছে যেতেই আপনার সবচে ভাল লাগে, যদিও তিনি হয়ত দেশের সবচে বিখ্যাত ডাক্তার নন। আল্লাহ্ আমাদেরকে হাজার হাজার বছর আগেই এটি শিখিয়ে দিয়েছেন ।
যখন আল্লাহ বলেন তিনি হচ্ছেন আর-রাহমান, তিনি আপনাকে বলেন যে তিনি আপনাকে ভালবাসেন। তিনি আপনাকে কেয়ার করেন। তিনি জানেন যে আপনি একটি ক্ষুদ্র সৃষ্টি, আপনাকে তিনি প্রতি মূহুর্তে দেখে শুনে যত্ন করে রাখছেন। তিনি জানেন আপনার অনেক চাহিদা, তিনি সবগুলো পুরন করছেন। তিনি আপনাকে ভালবাসা, মমতা, নিরাপত্তা, সাহায্য, কেয়ার এসবের কথা বলেছেন আর-রাহমান এর মাধ্যমে। তিনি আপনাকে শাস্তি বা করুনা বা ভয়ের কোন কথা বলেননি। একজন মা যেমন কখনো তার সন্তানকে ত্যাগ করবেন না, আল্লাহ্ আপনাকে আমাকে কখনই তাঁর রাহমা থেকে বঞ্চিত করেন না। মায়ের তীব্র ভালবাসাও আল্লাহর ভালবাসার অনু পরিমানের ধারে কাছেও আসতে পারেনা। এমনকি যারা দিনের পর দিন আল্লাহকে অস্বীকার করে, আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তি, পীর, মাজার কে পূজা করে আল্লাহ তাদেরকেও খাওয়াচ্ছেন, পরাচ্ছেন, ভাল রাখছেন। যারা বলে যে নামাজ না পড়ে তো আমি ভালই আছি তারা এটা বুঝেনা যে সে আসলে তার নিজের যোগ্যতায় ভাল নেই, আল্লাহ্ এখনো তাকে দয়া করে যাচ্ছেন।
আপনি কি আল্লাহ্ সম্পর্কে সব জানেন? উত্তর- না, আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।
আল্লাহ কি আপনার সম্পর্কে জানেন ? উত্তর- হ্যা, তিনি জানেন। আপনার অনু পরমানু এমনকি প্রতিটি চিন্তা সহ।
আপনি কি আল্লাহকে ভালবাসেন? উত্তর- সেটা আপনার করা উচিত।
আল্লাহ্ কি আপনাকে ভালবাসেন ? উত্তর- হ্যা। আপনার কোন ধারনাও নেই।
আল্লাহ্ কি আপনার সব রকমের যত্ন নিচ্ছেন? উত্তর- হ্যা, প্রতিমুহূর্তে, প্রতিদিন।
রাহমান শব্দটির আরো ব্যাপার আছে। এটি রাহমান নয়, এটি হচ্ছে রাহমা--ন। এখানে একটা নূন আছে এবং একটা টান আছে। এটাকে আরবি তে বলা হয় " সিগাতুল মুবালাগা " . এটার মানে হচ্ছে যখন কোন কিছুর পরিমান সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, এরপর আর বাড়ানো সম্ভব নয়, এই অস্বাভাবিক প্রচন্ড পরিমানকে বলা হয় সিগাতুল মুবালাগা । উদাহরন দিচ্ছি।
আরবিতে পিপাসার্ত হচ্ছে "আতিশ" .কিন্তু আপনি যদি বলেন আপনি "আতশা--ন" তার মানে হচ্ছে যে এর চেয়ে বেশি আর এক বিন্দু পিপাসার্ত হলেই আপনি সাথে সাথে মরে যাবেন। এর চেয়ে বেশি পিপাসার্ত হওয়া সম্ভব নয়।
আল্লাহ্ বলেছেন, তিনি আর রাহমা---ন। অর্থাৎ এরচেয়ে বেশি দয়ালু হওয়া সম্ভব নয়, এরচে বেশি কোন দয়া হতে পারেনা, এরচে বেশি দয়া কেউ কোন সম্ভাব্য অসম্ভাব্য উপায়ে দেখাতে পারেনা। আর রাহমা---ন এর পূর্ন অনুবাদ হবে এরকম-
INCREDIBLY MERCIFUL, UNIMAGINABLY MERCIFUL, EXTREMELY MERCIFUL BEYOND IMAGINATION, UNLIMITED MERCIFUL
অকল্পনীয় দয়ালু, চিন্তা ক্ষমতার বাইরে দয়ালু, সর্বোচ্চ পর্যায়ের দয়ালু।
রাহমান শব্দটির আরো ভাষাগত ব্যাপার আছে। এটি একটি Present Continuous Tense.
'আমি খাই' আর 'আমি এখন খাচ্ছি' এক জিনিস নয়। রাহ্মার ক্ষেত্রেও একই জিনিস প্রযোজ্য। আপনার প্রতিবেশি শফিক সাহেব খুব দয়ালু মানুষ। কিন্তু তার মানে এই না যে তিনি এখন, এই মুহুর্তে দয়ালু। এই মুহূর্তে তিনি কোন দয়ার কাজ নাও করতে পারেন।
আর-রাহমান মানে হচ্ছে আল্লাহ্ এই মুহুর্তে তাঁর রাহ্মা দেখাচ্ছেন। এই মুহুর্তে তিনি আপনাকে ভালবাসা দেখাচ্ছেন। এই মুহুর্তে তিনি আপনার কথা চিন্তা করছেন। এই মুহুর্তে তিনি আপনার কথা খেয়াল রেখেছেন। এই মুহুর্তে তিনি আপনাকে নিরাপত্তা দিচ্ছেন। কালকে না, পরশু না, আজকে না, ঠিক এই মূহুর্তে।
এই মুহুর্তে আল্লাহ্ আপনাকে আমাকে এই পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষ জীব-জন্তু গাছ সহ প্রান এবং পৃথিবীর বাইরে আমাদের সৌরজগত, আমাদের মিল্কি ওয়ে, আমাদের গ্যালাক্সি ও এর বাইরের যাবতীয় কিছুর প্রতি ঠিক এই মুহুর্তে রাহমা দেখাচ্ছেন।
কিভাবে আপনি বের করবেন আল্লাহ্ আপনাকে কতটা ভালবাসা ও নিরাপত্তা দিচ্ছেন? আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি। আপনি আপনার জীবনের সমস্যাগুলোর কথা চিন্তা করা বন্ধ করেন। আমাদের এমন কেউ নেই যার জীবনে কোন সমস্যা নেই। পড়াশুনা, চাকরি, পরিবার, সন্তান, ক্যারিয়ার, টাকা পয়সা, ব্যবসা, সাস্থ্য, ভবিষ্যত সবকিছু নিয়ে আমরা সবসময় অভিযোগ করি। আমরা আল্লাহ্র রাহ্মা দেখতে পাই না আমাদের অগনিত অভিযোগের কারনে। আমি আপনাকে মানুষের একটা আজব সাইকোলজি বলব।
আমি যখন সেইন্ট যোসেফ স্কুলে পড়তাম (৯৬-০৩) সেখানে প্রতিদিন হাউজ ওয়াইফ আন্টিরা আসতেন বাচ্চাদের দিতে ও নিতে। তাদের একটা "ভাবী সার্কেল" ছিল। তারা সবাই সবার ভাবী, তাদের প্রতিদিনকার আলোচনার একটা বিষয় ছিল কার সন্তান কত খারাপ।
ভাবী ১- ভাবী আপনার ছেলেটা এত্তত্ত ভাল কি আর বলব। আমার ছেলেটা পড়তেই চায়না।
ভাবী ২- আরে না না ভাবী কি যে বলেন। আপনার ছেলেটা তো সোনার টুকরা। আমার ছেলেটা তো পড়াশুনা ছেড়েই দিয়েছে, এবারো সেকেন্ড হয়েছে। এভাবে কি হয় বলেন?
আমি ছোট থাকতে দেখেছি বাবা-মা রা নিজের সন্তানদের বিরুদ্ধে অগনিত অভিযোগ করতেই থাকে , করতেই থাকে। পড়ে না, খায় না, বেশি খায়, কথা কম বলে, কথা বেশি বলে, বেশি বাইরে ঘুরে, বেশি বাসায় বসে থাকে.........তাদের অভিযোগ কখনো থামে না। আমার বাবা আমাকে বলতেন- যা অমুকের পা ধোয়া পানি খা, দেখ্ যদি তোর কোন উন্নতি হয়।
আমি আপনাকে লিখে দিতে পারি, ঠিক এই রকম অভিযোগী অসন্তুষ্ট কোন মায়ের সন্তান যদি মরে যায়, সাথে সাথে তার কথার টোন পালটে যাবে। তিনি বাকী জীবন আর কোনদিনও বলবেন না তার সন্তানের কি কি দোষ ছিল। তিনি যা বলবেন তা হল- আহারে আমার বাবুটা, কত ভাল ছিল। একদম বিরক্ত করত না। এত লক্ষী একটা ছেলে ছিল। কত বকেছি ওকে, তাও কিছু বলত না কোনদিন। হায় আল্লাহ্ কেন আমার বাবুটাকে নিয়ে গেলা তুমি?
কেন মানুষ এমন করে ? গতকালকে পর্যন্ত যাকে বকাঝকা দেওয়া হয়েছে, আজকেই কেন তার প্রতি এত ভালবাসা?? উত্তর হচ্ছে- এটা বেশিরভাগ মানুষের স্বভাব। আমাদের যা কিছু আছে আমরা সেগুলোর মূল্য দেই না, আমরা সেগুলকে এপ্রিশিয়েট করি না। আমরা ধরে নেই এগুলো সবসময়ই থাকবে। সেজন্য আমরা এগুলো নিয়ে সবসময় কমপ্লেইন করতে থাকি। যেদিন এগুলো সত্যি সত্যি চলে যায় তখন আমরা এগুলোর মূল্য বুঝতে পারি। যার একটাও দাঁত নেই, সে জানে দাঁত কত দামী একটা জিনিশ।
আপনি আপনার জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু আপনি এটা নিয়ে ভাবেন না যে আল্লাহ্ আপনাকে কত হাজার হাজার সমস্যা থেকে উদ্ধার করছেন প্রতি মূহুর্তে। এবং প্রতিদিন। আপনার হয়ত হাত কেটে গেছে, কিন্তু আপনি এটা ভাবছেন না যে আপনার হাতটা ভেঙ্গে যেতে পারত, আল্লাহ্ আপনাকে রক্ষা করেছেন। আপনি হয়ত পরীক্ষায় ফেইল করেছেন তাই আপনার ভয়ঙ্কর মন খারাপ, কিন্তু আপনি খেয়াল করছেন না আপনার স্কুলের পাশের একটা অন্ধ লোককে যার কাছে পরীক্ষার কোন মূল্য নেই। আপনার বাবার সাথে আপনার সম্পর্ক ভাল না, কিন্তু আপনি চিন্তা করে দেখেন না যে, এখনো আল্লাহ্ আপনার বাবাকে জীবিত রেখেছেন, এবং তার সেবা করে আপনি আপনার জান্নাতের রাস্তা তৈরী করে নিতে পারেন। আপনি যদি খুব প্র্যাকটিসিং মুসলিম ও হন কিন্তু বাবা মায়ের সাথে ভাল আচরন না করেন, আপনি এখনো ইসলামে প্রবেশ করতে পারেননি। আপনার বাবা-মা আপনার জান্নাত। জান্নাতের দরজা বন্ধ রেখে আপনি জান্নাতে যেতে পারবেন না জীবনেও। তাদেরকে আপনি আপনার শ্রেষ্ট ব্যবহার দিতে বাধ্য। তারা কাফির হলেও। তারা মুশরিক হলেও। আপনার নিজের স্বার্থের জন্যই।
আপনি আর- রাহমান শব্দটা নিয়ে প্রতিদিন চিন্তা করুন। আজকে আল্লাহর কাছে থেকে আপনি কি কি ভালবাসা পেয়েছেন? এই মুহুর্তে আল্লাহ্ আপনাকে কিভাবে ভালবাসা দেখাচ্ছেন? আপনি কি তাঁকে ভালবাসেন? আপনি কি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ? তাহলে আপনি তাঁকে সেটা বলুন। আপনি বলুন- আল্লাহ্ আমার পক্ষে আপনার রাহ্মা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। তারপরো আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি আপনাকে ভালবাসি। আমার নিজের থেকে, আমার বাবা মা, স্ত্রী, সন্তান, সবকিছুর চেয়ে আমি আপনাকে বেশি ভালবাসি।
আর- রাহমান শব্দটি আমাদেরকে প্রতিদিন নামাজে উচ্চারন করতে হয়। এরপর যখন আপনি এই শব্দটি উচ্চারন করবেন, এই কথাগুলো মনে করবেন। আপনি যত বেশি কৃতজ্ঞ হবেন, আপনি আল্লাহর তত কাছে যেতে পারবেন। প্রত্যেকটি মানুষের জন্য স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শেখাটা অত্যন্ত জরুরী। আপনি নিজে জেনে উপলব্ধি করতে পারলে আপনিও আরেকজনকে জানাতে পারবেন।
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: