শফিক সাহেব ও তার স্ত্রী নিঃসন্তান দম্পতি। তাদের বিয়ে হয়েছে ২০ বছর, আজো তারা সন্তানের মুখ দেখেননি। জীবনে কোন কিছুর-ই তাদের কোন অভাব নেই, একমাত্র একটি সন্তান ছাড়া। তারা দুজনেই ধার্মিক মুসলিম, আল্লাহর কাছে বছরের পর বছর দু'আ করে যাচ্ছেন। বিয়ের ২৫ বছর পর তাদের একটি ছেলে হয়। মহান আল্লাহর প্রতি তারা ১০০ রাকাত নামাজ পড়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন। তাদের নিঃসঙ্গ জীবন স্বর্গীয় সুখে ভরে উঠল।
৫ বছর বয়সে ধরা পড়ে তাদের ছেলেটি লিউকেমিয়া( ব্লাড ক্যান্সার) রোগে আক্রান্ত। তারা তাদের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করলেন। দেশে, দেশের বাইরে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তারা তার চিকিৎসা করালেন। কোন লাভ হয় না। টানা দুই বছর চিকিৎসা করানোর পর ৭ বছর বয়সে ছেলেটি মারা যায়। কাঁদতেও ভুলে যান নিঃসন্তান দম্পতি। এ দুঃখের কি কোন সীমা আছে?
আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না শফিক সাহেব। তার দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার, যন্ত্রনা যেন বিস্ফোরিত হয় স্রষ্টার কাছে-
"আল্লাহ্! কি দোষ করেছি আমি জীবনে? কেন তুমি আমাকে এইভাবে কষ্ট দিচ্ছ? আমাকে কষ্ট দিয়ে তোমার কি লাভ???"
২.
শুভ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। চাকরিতে যাতায়াতের জন্য একটা মোটরবাইক তার খুব দরকার। ছোটবেলা থেকেই সে নিজে নিজে সংগ্রাম করে বড় হয়েছে, খুব প্রয়োজন ছাড়া কখনো সে তার সীমিত আয়ের বাবা-মার কাছে টাকা চায়নি । সে একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম, জীবনে যখন যা লাগে আল্লাহর কাছে চেয়েছে, আল্লাহ্ কিভাবে কিভাবে যেন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ২ বছর ধরে কয়েকটা টিউশ্যনি করে তিলে তিলে টাকা জমিয়ে সে একটা মোটরবাইক কিনে। ঠিক ১ সপ্তাহের মাথায় সেটা তার বাসার নিচ থেকে চুরি হয়ে যায়। চাবি হাতে শুন্য গ্যারাজে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকে শুভ। টপটপ করে তার চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে। কি প্রচন্ড কষ্ট করে সে টাকা জমিয়েছিল। কেমন একটা অভিমানে বিড়বিড় করে সে বলে- " আল্লাহ্, এত মানুষ থাকতে কেন আমারটাই ?? কি দোষ ছিল আমার ? "
এই উদাহরনগুলো আমাদের মতন "মুসলিমদের" বাস্তব জীবনের। যতক্ষন আমরা ভাল থাকি, আল্লাহর উপর আমাদের আস্থাও ভাল থাকে। যেই না আমাদের জীবনে কোন দুর্ঘটনা, দূর্যোগ, বিপর্যয় নেমে আসে, সাথে সাথে আমরা ভুলে যাই যে আল্লাহ্ হচ্ছেন আর-রাহমান ( অকল্পনীয় দয়ালু, সীমাহীন দয়ালু, চিন্তাক্ষমতার বাইরে দয়ালু). আমরা তখন ধরেই নেই যে আল্লাহ্ আমাদেরকে কষ্ট দিচ্ছেন, আমাদের উপর অবিচার করছেন, আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাসের ভিত আসলে খুব মজবুত কিছু নয়, টুকটাক ধাক্কা আসলেই আমরা আল্লাহর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলি।
এই আর্টিকেল এ আল্লাহর এমন একজন বান্দার কথা বলা হয়েছে যিনি তার সারা জীবনে এতো বেশি পরিমানে কৃতজ্ঞতার নমুনা রেখে গেছেন যে আল্লাহ্ নিজেই এই মানুষটির প্রশংসা করেছেন !! এই মানুষটি নবী আইয়ুব (আ), ইংরেজীতে ও বাইবেলে তাঁর নাম Prophet Job (Ayoub) । এই আর্টিকেল এর তথ্য গুলো নেওয়া হয়েছে কুর'আন এর আয়াত , ইমাম ইবন কাসীর এর বই "Stories of the Prophets" , এবং বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এর "Job" থেকে।
আল্লাহ্ পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবী পাঠিয়েছিলেন মানুষের কাছে। এর মধ্যে কুর'আনে আনুমানিক ২৯ জনের কথা আছে। কুর'আন মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য কোন এডভেঞ্চার বা থ্রীলার বই নয় বা এখানে আল্লাহ্ আপনাকে আমাকে ইতিহাসের গল্প বলেন নাই, খুব সোজা কথায় এটি একটি Instruction Manual. এটার প্রত্যেকটা লাইনে আল্লাহ্ আপনাকে আমাকে কোন না কোন Guidance দিয়েছেন। আপনি যদি এটা ব্যবহার করে সফলতা অর্জন করতে চান, আপনাকে প্রত্যেকটি লাইন পড়ে পড়ে চিন্তা করতে হবে যে সেখানে আল্লাহ্ "শুধুমাত্র আপনার জন্য" কি বলেছেন। কুর'আনের ২৯ জন নবীর জীবনের ঘটনাগুলোও আমাদের জন্য প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ন একেকটি চ্যাপ্টার। আপনাকে উপলব্ধি করতে হবে যে, তাঁদের ঘটনাগুলো কি কারনে আল্লাহ্ আপনাকে বলেছেন। আল্লাহ্ চেয়েছেন আপনি তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা নেন এবং সেটা আপনার জীবনে কাজে লাগান। আপনি যখন নবী আইয়ুব (আ) এর জীবনের ঘটনা পড়বেন, আপনি গভীরভাবে চিন্তা করে নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করবেন যে হুবহু ঐ ঘটনাটা আপনার জীবনে ঘটলে আপনি কি করতেন। তাঁর মতন আপনি কি পারতেন ধৈর্য্যের পরীক্ষায় পাস করতে ? ঈমান একদিনে ডেভেলপ করেনা। আপনি আগামীকাল সকালে ঘুম থেকে উঠে লাফ দিয়ে বলতে পারবেন না - " ইয়েস ! তাকওয়া এসে গেছে আমার ! " . আপনাকে প্রতিদিন একটু একটু করে ঈমানের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে হবে। আর এর জন্য আপনার প্রথম ও প্রধান গাইডলাইন হচ্ছে কুর'আন।
আইয়ুব (আ) রোমের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ইবরাহীম(আ) এর বংশধর ছিলেন। তাঁর প্রতি আল্লাহ্ এত খুশি হয়েছেন যে আল্লাহ্ নিজেই তার প্রশংসা করে বলেন-
Truly ! We found him patient. How excellent a slave ! Verily, he was ever oft-returning in repentance to Us. ( Ch 38:44)
এটা খুব সাধারন কোন ব্যাপার নয় যখন আল্লাহ্ নিজেই কারো সম্পর্কে বলেন - "নিঃসন্দেহে ! আমি তাকে পেয়েছি অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল হিসেবে। কি চমৎকার একজন বান্দাই না ছিল সে !! সে বার বার আমার কাছে তাওবা করে প্রত্যাবর্তন করত" (ভাবানুবাদ). যখন আল্লাহ্ নিজ থেকে কারোর প্রশংসা করেন তাঁর মানে সেই মানুষটি সাধারন মানুষের সীমার বাইরে কোন কাজ করে উদাহরন স্থাপন করে গেছেন।
আল্লাহ্ আইয়ুব (আ) কে ধন- সম্পদ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু দিয়েছিলেন। বাইবেলের তথ্য অনুযায়ী তাঁর ছিল ৭ ছেলে ও ৩ মেয়ে, ৭ হাজার ভেড়া, ৩ হাজার উট, ৫০০ গাধা ও ১০০০ অন্যান্য মেষপাল। আপনাকে আমি বলছি না এই তথ্য হুবহু বিশ্বাস করতে, কিন্তু এখান থেকে অন্তত আপনি কিছুটা হলেও তাঁর সম্পদের পরিমান সম্পর্কে ধারনা করতে পারেন। তিনি আল্লাহর একজন নবী ও অত্যন্ত কৃতজ্ঞ একজন বান্দা ছিলেন। জীবনের প্রতি মুহুর্তে তিনি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতেন সবকিছুর জন্য, আল্লাহর কাছে বারবার তাওবা করতেন, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন, ধৈর্য ধরতেন ও আল্লাহর শোকর আদায় করতেন। তিনি গরীব মানুষদের খাবার ও পোষাক দিতেন, দাস কিনে তাদেরকে মুক্ত করে দিতেন।
ইবলিসের হিংসাঃ
আইয়ুব (আ) এর প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি ইবলিসের কাছে ভাল লাগল না। সে নিজে আল্লাহকে অমান্য করেছে, কাজেই কেউ আল্লাহর প্রিয়পাত্র হোক এটা সে সহ্য করতে পারে না। নানাভাবে ছলে বলে কৌশলে সে আইয়ুব (আ) কে তাঁর ইবাদাত থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা শুরু করল। তাঁকে পৃথিবীর জীবনের নানারকম আনন্দময় লোভনীয় জিনিসের কথা বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকল। এতে কোন লাভই হোল না কারন আইয়ুব (আ) ছিলেন একজন সত্যিকারের আবদ-আল্লাহ ( আল্লাহর দাস) . এতে ইবলিস আরো বেশি বিরক্ত হয় ও তাঁকে আরো বেশি করে ঘৃনা করা শুরু করে।
ইবলিস আইয়ুব (আ) এর সম্পদ ধ্বংস করলঃ
ধূর্ত ও চতুর ইবলিস আল্লাহর কাছে আইয়ুব (আ) এর নামে অভিযোগ করল। তাঁর অভিযোগের বক্তব্যটা ছিল যে, যদিও আইয়ুব (আ) প্রতিমূহুর্তে আল্লাহকে স্মরন করেন, কিন্তু তিনি আসলে এসব ইবাদত মন থেকে করেন না, তিনি এসব শুধুমাত্র এই কারনেই করেন যাতে করে আল্লাহ্ তাঁর বিপুল সম্পদ কেড়ে না নিয়ে যান। তাঁর ইবাদত লোক দেখানো শো-অফ ছাড়া আর কিছুই না। ইবলিস এটাও আল্লাহকে বলল-
" আজকে তাঁর সম্পদ আছে, তাই সে তোমাকে স্মরন করে আল্লাহ্। তুমি তাঁর সম্পদ কেড়ে নাও, তুমি দেখতে পাবে যে তাঁর মুখে তোমার নাম আর স্মরণ হবে না। তুমি দেখবে তাঁর ইবাদত বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি আমাকে তাঁর সকল সম্পদ নষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা দাও, তারপর দেখো তাঁর কৃতজ্ঞতা কই গিয়ে ঠেকে। "
আল্লাহ্ সময়ের ঊর্দ্ধে, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। তিনি খুব ভাল করেই জানেন ইবলিশের মতলব কি। তিনি ইবলিশকে বললেন যে, আইয়ুব(আ) তাঁর সবচে কৃতজ্ঞ বান্দাদের একজন, তিনি কখনই সম্পদের লোভে বা লোক দেখানোর জন্য কোন ইবাদত করেন না। তারপরো ইবলিশকে একটা নমুনা দেখানোর জন্য তিনি ইবলিশের ইচ্ছাপূরন করলেন।
ইবলিশ মহা খুশি। সে তাঁর দলবল সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আইয়ুব(আ) এর হাজার হাজার পশু, দাস, ফার্ম ও অন্যান্য সব সম্পদ মূহুর্তের ভিতর ধ্বংস করে দিল। একজন বৃদ্ধ লোকের ছদ্মবেশ ধরে ইবলিশ আইয়ুব(আ) এর কাছে যেয়ে বলল- " তোমার তো সব কিছুই শেষ। কেউ কেউ বলে যে এটার কারন হচ্ছে তুমি অনেক বেশি দান করতে আর তুমি সারাক্ষন আল্লাহর ইবাদত করে তোমার সময় নষ্ট করতে। আবার অনেকে এটাও বলে যে আল্লাহ্ তোমার শত্রুদের খুশি করার জন্য তোমার সম্পদ নিয়ে গেছেন। যদি তোমার সম্পদ রক্ষা করার ক্ষমতা আল্লাহর থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি সেটা করতেন। "
কপর্দকহীন আইয়ুব(আ) শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন- " কোন কিছুই আমার না। আল্লাহর সম্পদ আল্লাহ্ নিয়ে গেছেন। আমি সামান্য কয়েকদিনের জন্য এগুলোর আমানতকারী ছিলাম মাত্র। তিনি যাকে ইচ্ছা দেন, আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা নিয়ে যান। " এ কথা বলে তিনি আল্লাহর কাছে সিজদা করলেন।
এবার আপনার পালা। আমি যতবার আপনাকে আইয়ুব(আ) এর ঘটনা বলব ততবার আপনাকে ভাবতে হবে যে এটা আপনার জীবনে ঘটলে আপনি কি করতেন। মনে করুন আপনার বাবা একটা ৫ তালা বাড়ি রেখে গেছেন আপনার জন্য। বর্তমান বাজার মূল্যে এটার দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা। এটার ভাড়া দিয়ে আপনি সচ্ছল জীবনা যাপন করেন ও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করেন। একদিন মাঝারি মাপের একটা ভূমিকম্প হল। অফিস থেকে ফিরে আপনি দেখলেন, আপনার আশেপাশের প্রত্যেকটি বাড়ি ঠিক আছে, শুধু আপনার বাড়িটিতে ফাটল ধরেছে ও আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে। মাথায় হাত দিয়ে আপনি বসে পড়লেন। আপনার চোখের সামনে সরকারের লোক এসে আপনার বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলল। নিঃস্ব ছাদহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে কি সেদিন আপনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতেন নাকি ভাবতেন আল্লাহ্ কেন আপনার উপর এত বড়ো অবিচার করলেন??
ইবলিস আইয়ুব (আ) এর সন্তানদের ধ্বংস করলঃ
ইবলিশ আইয়ুব (আ) এর অসাধারন ঈমান দেখে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। সে আল্লাহর কাছে গিয়ে আবার বলল- " আমি তাঁর সকল সম্পদ ধ্বংস করেছি, কিন্তু সে এখনো তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। সে আসলে তাঁর দুঃখ চেপে রেখেছে কারন এখনো তাঁর অনেকগুলো সন্তান আছে। তাঁর আসল পরীক্ষা শুরু হবে যখন তাঁর সন্তানগুলো থাকবে না। তুমি আমাকে তাঁর সন্তানগুলো কেড়ে নেবার ক্ষমতা দাও, তারপর দেখো সে কিভাবে তোমাকে অস্বীকার করে আল্লাহ্। "
আল্লাহ্ তাকে এটাও দিলেন। ইবলিশ তার দলবল নিয়ে তার শয়তানী শুরু করল। তারা আইয়ুব (আ) এর বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর ধ্বংস করে দিল। একদিন বাড়ি ফিরে আইয়ুব (আ) স্তব্ধ হতবাক হয়ে দেখেন, তাঁর মৃত ১০ ছেলেমেয়ে সহ পুরো বাড়িটি ভেঙ্গে ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে। ইবলিশ আবারো সৌম্য বৃদ্ধের বেশে আইয়ুব (আ) এর কাছে এসে মোলায়েম কন্ঠে বলল- " যেভাবে তোমার সন্তানরা মারা গেছে এটা খুবই দুঃখজনক। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু তোমার ইবাদতগুলোর যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছেন না তোমাকে। " এ কথা বলে ইবলিশ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল যে নিশ্চয়ই এখন আইয়ুব (আ) আল্লাহকে অভিশাপ ও অস্বীকার করা শুরু করবেন।
আইয়ুব (আ) ইবলিশকে নিরাশ করলেন। তিনি বললেন- " কখনো আল্লাহ্ দেন, আবার কখনো তিনি নিয়ে যান। কখনো তিনি আমাদের কাজের উপর সন্তুষ্ট হন, আবার কখনো অসন্তুষ্ট হন। একটা জিনিস আমার জন্য ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন, আমি আবার বিশ্বাসে অটল থাকব আর আমার স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। " একথা বলে আবার তিনি আল্লাহর কাছে সেজদা করলেন। রাগে ক্ষোভে ও চরম হতাশায় ইবলিশের নোংরা মন আরো কলুষিত হয়ে উঠল।
আবার আপনার পালা। আপনার বাসস্থান ও আয়ের উৎস বাড়িটি ভেঙ্গে পড়েছিল। তারপরো আপনি ধৈর্য্য ধরেছিলেন, আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলেন। একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে যাচ্ছিল আপনার। ফুটফুটে ৩টি বাচ্চা আছে আপনার। এদের মুখের দিকে তাকিয়ে অভাব অনটনেও আপনার জীবন মোটামুটি চলছিল। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বাস এক্সিডেন্ট এ আপনার ৩টি সন্তানই মারা যায়। প্রবল শোকে স্তব্ধ হয়ে আপনি টানা ৩ দিন বসে থাকেন তাদের কবরের পাশে। আপনার স্ত্রীকে মানসিক হাসপাতালে কড়া ঘুমের অসুধ দিয়ে রাখা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনি কি করতেন??? আপনি চিন্তা করুন, নিজেকে জিজ্ঞেশ করুন।
- ভাগ্যকে গালাগালি করতেন?
- আল্লাহ্ আপনার উপর চরম অবিচার করেছেন ভাবতেন?
- ধৈর্য্য ধরতেন ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেন?
ইবলিস আইয়ুব (আ) এর সুস্বাস্থ্য ধ্বংস করলঃ
ইবলিস আবার আল্লাহর কাছে গিয়ে বলল- " ও আল্লাহ্, তাঁর সম্পদ নেই, তাঁর সন্তান নেই, কিন্তু এখনো তাঁর সুস্বাস্থ্য আছে। আর যতক্ষন তাঁর সুস্বাস্থ্য থাকবে, সে সম্পদ ও সন্তানের আশায় তোমার ইবাদত করবে। আমাকে তাঁর শরীরের উপর ক্ষমতা দাও যাতে আমি সেটা নষ্ট করতে পারি। তারপর তুমি দেখবে যে সে তোমাকে অস্বীকার করে।
আল্লাহ্ ইবলিসকে একটা ফাইনাল শিক্ষা দিতে চাইলেন। তার ৩য় অনুরোধটাও রাখলেন। বললেন- "আমি তোমাকে ক্ষমতা দিচ্ছি, কিন্তু মনে রেখ, তুমি তাঁর চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধির উপর কোন ক্ষমতা পাবেনা, কারন সেখানে তার ঈমান আছে।"
নতুন ক্ষমতা পাওয়ামাত্র ধূর্ত ও কুটিল ইবলিস আইয়ুব (আ) এর শরীরকে আক্রমন করা শুরু করল। দিনের পর দিন তিনি অসহ্য যন্ত্রনায় পশুর মতন গোঙাতে থাকেন। তাঁর শরীরে পচন ধরা শুরু করল। দিনে দিনে তিনি শুধুমাত্র হাড় ও চামড়া বিশিষ্ট একটি জীবন্মৃত জীবে পরিণত হলেন। তাঁর শরীরে এমন কোন অঙ্গ ছিলনা যেটাতে অসুখ ছড়িয়ে পড়েনি। অকল্পনীয় অসহনীয় যন্ত্রনার মাঝেও আইয়ুব (আ) তাঁর বিশ্বাসে অটুট থাকলেন আর বার বার আল্লাহ-র দয়ার আশায় রইলেন। সকল আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব তাঁর ভয়ঙ্কর রোগ দেখে তাঁকে ছেড়ে চলে গেল। কেউ তাঁর প্রতি করুনা ও সহানুভূতি দেখালো না। একমাত্র তাঁর মমতাময়ী স্ত্রী তাঁর সাথে রইলেন ও দিনের পর দিন তাঁর সেবা করে গেলেন।
আইয়ুব (আ) এর দু'আঃ
ইবলিস হতাশার শেষ সীমায় পৌঁছে গেল। সে তাঁর সঙ্গীদের পরামর্শ চাইল। তারা তাকে বলল- " এই কি তোমার বুদ্ধি যা দিয়ে তুমি আইয়ুব (আ) কে ধ্বংস করতে পারছ না? অথচ তুমিই না আদমকে কুবুদ্ধি দিয়ে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিলে? কই আজকে তোমার সেই বুদ্ধি? "
ইবলিসের মাথায় নতুন বুদ্ধি এল। হাজার হাজার বছর আগে ঘটনাটা তাঁর মনে পড়ল। তার মনে পড়ল সে হাওয়া(আ) কে কিভাবে প্রতারনা করেছিল। সে মানুষের বেশ ধরে আইয়ুব (আ) এর স্ত্রীর কাছে গেল।
"তোমার স্বামী কোথায়?"- জিজ্ঞেস করল ইবলিস।
তিনি আঙ্গুল তুলে বিছানায় মৃতপ্রায় একটি আকৃতিকে দেখালেন। - "ঐ তো উনি, জীবন ও মৃত্যুর মাঝে লড়াই করছেন।"
ধূর্ত ইবলিস তাঁর স্ত্রীকে আগের সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল, যখন তাদের সব ছিল। সন্তান, স্বাস্থ্য, সম্পদ, সব। সে তাঁকে বোঝাল যে আল্লাহ্ দিনের পর দিন তাদেরকে কত কষ্ট দিচ্ছেন।
আর সহ্য করতে পারলেন না স্ত্রী। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। আইয়ুব (আ) কে বললেন-
" আর কতদিন তুমি আল্লাহর এই যন্ত্রনা সহ্য করবে? আমরা কি আজীবন এভাবেই নিঃস্ব হয়ে থাকব? কেন তুমি তাঁকে ডেকে আমাদের কষ্টের কথা বলনা ? কেন তুমি তাঁকে বলনা এসব দূর করে দিতে? "
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মৃতপ্রায় আইয়ুব (আ) . ক্ষীন নরম কন্ঠে বললেন- " নিশ্চয়ই ইবলিস তোমাকে কুবুদ্ধি দিয়েছে। তুমি আমাকে বল কতদিন আমার ধন-সম্পদ আর সুস্বাস্থ্য ছিল? "
- "৮০ বছর"- তিনি বললেন।
- " আর কতদিন ধরে আমি এভাবে ভুগছি?"
- "৭ বছর" - স্ত্রী বললেন।
আইয়ুব (আ) তাকে বললেন- " সেক্ষেত্রে আমি লজ্জিত আল্লাহর কাছে এই কষ্টের মুক্তি চাইতে। আমার দুঃখের চেয়ে আমার সুসময়ের পরিমান অনেক অনেক বেশি। আমার মনে হচ্ছে তোমার বিশ্বাস দূর্বল হয়ে গেছে আর তুমি আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট। আমি শপথ নিচ্ছি যে আমি যদি সুস্থ হই, আমি তোমাকে ১০০ বার আঘাত করব ! আজকে থেকে আমি তোমার হাত থেকে খাবার খেতে বা পান করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছি। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও, আল্লাহ্ সেটাই করবেন যা তিনি ভাল মনে করেন। "
একমাত্র সঙ্গী স্ত্রী ভগ্ন হৃদয়ে কাদঁতে কাদঁতে চলে গেলেন। সম্পূর্ন একাকী অসহায় অবস্থায়, আইয়ুব (আ) আল্লাহর কাছে দু'আ করলেন।
"স্মরন কর, যখন আইয়ুব তার মালিককে ডেকে বলেছিল, হে আল্লাহ্, আমাকে এক কঠিন অসুখে পেয়ে বসেছে, আমাকে তুমি নিরাময় কর, কেননা তুমিই হচ্ছ, দয়ালুদের সর্বশ্রেষ্ট দয়ালু। তারপর আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম, তাঁর যে কষ্ট ছিল তা দূর করে দিলাম, তাকে যে শুধু তার পরিবার পরিজনই ফিরিয়ে দিলাম তা নয়; বরং তাদের সবাইকে আমার কাছ থেকে বিশেষ দয়া এবং আমার বান্দাদের জন্য উপদেশ হিসেবে আরো সমপরিমান অনুগ্রহ দান করলাম।" ( 21: 83-84)
কিভাবে আইয়ুব(আ) সুস্থ হলেন আল্লাহ্ নিজেই তা বলেছেন-
" হে নবী, তুমি আমার বান্দা আইয়ুবের কথা স্মরণ কর। যখন সে তাঁর মালিককে ডেকে বলেছিল, হে আল্লাহ্, শয়তান তো আমাকে যন্ত্রনা ও কষ্টে ফেলে দিয়েছে। আমি বললাম, তুমি তোমার পা দিয়ে মাটিতে আঘাত কর। আঘাত করার পর যখন পানির একটি কূপ বেরিয়ে এল, তখন আমি আইয়ুবকে বললাম, এ হচ্ছে তোমার পরিষ্কার করার ও পান করার উপযোগী পানি। আমি তাঁর সাথে তাঁর পরিবার পরিজন ও তাদের সাথে একই পরিমান অনুগ্রহ দান করলাম, এটা ছিল আমার পক্ষ থেকে রহমত এর নিদর্শন ও জ্ঞানবান মানুষের জন্য উপদেশ। ( 38: 41-43)
আইয়ুব(আ) আল্লাহর নির্দেশ পালন করলেন। ৭ বছরের কষ্টের অবসান ঘটল মূহুর্তের মধ্যে। এর মধ্যে তাঁর স্ত্রী তাঁর কাছে ফেরত এলেন । নিজের বাড়িতে এসে তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি কোথায় এসেছেন। সবকিছু হুবহু আগের মতন। সন্তান, সাস্থ্য, সম্পদ সবকিছু আগের মতন হয়ে গেছে। এ কিভাবে সম্ভব! আবেগাপ্লুত বাকরুদ্ধ হয়ে তারা আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন।
ছোট একটি সমস্যা রয়ে গেছে। আইয়ুব(আ) শপথ করে বলেছিলেন তিনি সুস্থ হলে স্ত্রীকে ১০০ বার আঘাত করবেন। তিনি স্ত্রীকে আঘাত করতে চান না, কিন্তু শপথ যে রাখতেই হবে। এখন কি হবে?
আল্লাহর প্রিয় বান্দার সাহায্যে এগিয়ে এলেন আল্লাহ্ নিজেই। এক মুঠো নরম ঘাস দিয়ে স্ত্রীকে হালকা আঘাত করার নির্দেশ দিলেন আল্লাহ্। কি মহান তিনি, কি মহান তাঁর ভালবাসা।
"আমি তাকে বললাম, তুমি তোমার হাতে এক মুঠো তৃণলতা নাও আর তা দিয়ে তোমার স্ত্রীকে মৃদু আঘাত কর, তুমি কখনো শপথ ভংগ কোর না; নিঃসন্দেহে ! আমি তাকে পেয়েছি অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল হিসেবে। কি চমৎকার একজন বান্দাই না ছিল সে ! সে বার বার আমার কাছে তাওবা করে প্রত্যাবর্তন করত। " ( 38:44)
.........................................................................................................
মানুষের বিশ্বাসের লেভেল অনুযায়ী আল্লাহ্ তার পরীক্ষা নেন। আল্লাহ্ আইয়ুব(আ) এর ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরীক্ষা। নবী হলেও তিনি মানুষ ছিলেন, তাঁরও আমাদের মতই আবেগ অনুভূতি ছিল। আল্লাহ্ তাঁকে সবকিছু দিয়েছিলেন, তারপর তাঁর কাছ থেকে একে একে সব নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর ধৈর্য্য ও কৃতজ্ঞতায় কোনদিন কোন ফাটল ধরেনি। অকল্পনীয় পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর সবকিছু আবার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। The stronger the faith, the harder the tests, the greater the rewards.
আইয়ুব(আ) এর জীবনের ঘটনা গুলো আমার জীবনে একটি মিরাকল । এটি বইয়ের মাত্র ৪ পৃষ্ঠার একটি জীবনী, কিন্তু আমি আপনাকে বলব কিভাবে এটি আমার জীবনকে রাতারাতি পরিবর্তন করে দিয়েছে, কিভাবে এটি আমাকে গাইড্যান্স দিয়েছে। আমি আপনাকে প্রমান দিব। আমি আগেও বলেছি কুর'আনের যে আয়াতগুলো আমি আমার জীবনে যখনি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি, আমার জীবন পরিবর্তিত হয়ে গেছে। নবী আইয়ুব(আ) এই ঘটনাগুলো আমাকে পরিবর্তন করেছে সবচেয়ে বেশি পরিমানে।
নবী আইয়ুব(আ) এর ঘটনাগুলো আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। আমি অনেকবার চিন্তা করে দেখেছি কিভাবে তিনি জীবনের সবরকম পরিস্থিতিতে কৃতজ্ঞ হতে পেরেছিলেন। আমি ভেবেছি যে আমার প্রিয় পরিবার, ভাইবোন, বাড়ী, সম্পদ সবকিছু যদি আজকে ধ্বংস হয়ে যায় আমি কি পারতাম তাঁর মতন ধৈর্য্য ধরতে ও কৃতজ্ঞ হতে ? হয়ত আমি পারতাম না, কিন্তু আমি নিজেকে বুঝিয়েছি যে চেষ্টা করলে কিছুটা আমি নিশ্চয়ই পারব। হয়ত আইয়ুব(আ) এর মতন পারবনা, কিন্তু তাঁর ১% হলেও তো পারব। তাঁর ঘটনাগুলো পড়ার পর এগুলো আমার মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যেকোন জঘন্যতম পরিস্থিতিতেও আল্লাহর উপর কৃতজ্ঞ হওয়া যায়। কারন নবী আইয়ুব(আ) এর চেয়ে কঠিন পরীক্ষায় পড়া কারোর পক্ষে সম্ভব না। আস্তে আস্তে আমি চেষ্টা করেছি "আমি কি চাই" , "আমার কি কি দরকার" " আমার কি কি সমস্যা" এসব বাদ দিয়ে "আল্লাহ্ আমাকে কি কি দিয়ে যাচ্ছেন" এটার কথা চিন্তা করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে।
কষ্টের মধ্যেও কৃতজ্ঞ হলে কি লাভ হয় সেটার প্রমান আমি পাই ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ আর ২৫ তারিখে। এই ঘটনাটি আমার জীবনের একটি মিরাকল। কিন্তু আপনার কাছে এটা শুধুমাত্র একটা গল্প। আপনি হয়ত আমার অনুভুতির ১% গ্রহন করতে পারবেন, কিন্তু আমি চাই আপনি এটা জানুন।
জানুয়ারি মাসে ২১৫০ টাকা দিয়ে আমি গ্যালারী এপেক্স থেকে একটা স্যান্ডেল কিনি। আমার আম্মা আমাকে ২০০০ টাকা দেন, ১৫০ টাকা আমি যোগ করি। এত দামী স্যান্ডেল এর আগে আমি কখনো আমার জীবনে পরিনি। ঘটনার শুরু ২৪শে ফেব্রুয়ারী দুপুরে। স্যান্ডেলটা পরে আমি যোহরের নামাজ পড়তে যাই। দামি জুতা আমি সবসময় মাথার সামনে রাখি, সেদিন সামনে জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে আমার পেছনের বাম পাশে বাক্সে রাখি। রাখার সময় মনটা একটু খুঁতখুঁত লাগছিল, কিন্তু আমার করার কিছু ছিলনা। নামাজ শেষে দেখি আমার প্রায় নতুন স্যান্ডেলটি নেই। মাসজিদ থেকে জুতা আমি অনেক হারিয়েছি। কিন্তু সেদিন আমার অত্যন্ত খারাপ লাগল, কারন ঘটনাটিতে আমার অসতর্কতা দায়ী।
অনেকক্ষন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম মাসজিদে। আমার নবী আইয়ুব(আ) এর কথা মনে পড়ল। আমি দুইটি দু'আ একসাথে পড়লাম- ইন্নালিল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ। আমি নিজেকে বুঝালাম যে, অবশ্যই এটাতে আমার জন্য কোন ভাল কিছু আছে।
আমি যে বাসায় থাকি এটা আমাদের পারিবারিক হাসপাতাল। এখানে আমার বাবা ও আমি শিশু চিকিৎসক, আর আমার মা গাইনোকলোজিস্ট। দুপুরে আমি ১টি রোগী দেখে দিলাম আর একজনের মাথায় কয়েকটা সেলাই করে দিলাম, আমাকে তারা ৮০০ টাকা দিয়ে গেল। আমি আল্লাহর প্রতি আবারো কৃতজ্ঞ হলাম যে তিনি কত দ্রুত আমার ক্ষতিপূরন করে দিচ্ছেন। কিন্তু তখনো আমি তারঁ প্ল্যান বুঝিনি।
বিকালে আমি পাখির খাবার কিনে আনি ৩০০ টাকার। ৮০০ টাকা থেকে আবার আমার ৫০০ টাকা হয়ে যায়। সেদিন বাকি দিন আর ২৫ তারিখ সারাদিন আমার ঘুরে ফিরে স্যান্ডেলটির কথা মনে হতে থাকে। নিজের অসতর্কতার জন্য নিজের উপর আক্ষেপ হয়। মানসিক শান্তির জন্য আমি নিজে নিজেই চিন্তা করি যে- যে চোর স্যান্ডেলটি নিয়েছে তার সন্তান হয়ত অসুস্থ, সে হয়ত এটা বিক্রী করে তার অসুধ কিনেছে। আমি আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনাও করি যেন তিনি চোরটিকে ক্ষমা করে দেন।
২৫ তারিখ সকালে আমার বাবা ঢাকার বাইরে চলে যান। রাত ১০টায় আমার মা আমাকে জানান যে, এক্ষনি একটা সিজার অপারেশন হবে, নবজাতকটি জন্মের পর আমি একা "বেবী ম্যানেজ" ( নাড়ী কাটা সহ আনুসঙ্গিক চিকিৎসা) করতে পারব কিনা। আমি বহুবার এ কাজ করেছি, কিন্তু সাথে আমার বাবা ছিলেন সবসময়। একমাত্র সেদিন আমি একা একা কাজটি করি।
কাজ শেষ করে আমি উপরে বাসায় চলে আসি। আমার মা রাত ১টায় আমাকে একটি খাম দিলেন। সাধারনত জন্মের পর একটি নবজাতককে ম্যানেজ করার জন্য আমার মা আমাকে সবসময় ১ হাজার টাকা করে দেন। আমি খাম খুলে দেখি সেখানে ১৫০০ টাকা। আমি মা-কে বলেছি যে এখানে বেশি টাকা আছে। তিনি আমাকে বললেন যেহেতু আমি একদম একা ছিলাম, তাই তিনি আমার সম্মানী একটু বাড়িয়ে দিয়েছেন।
টাকাটা টেবিল এ রেখে একটু চিন্তা করলাম আমি। কয়েক মূহুর্ত পর ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার মতন চমকে উঠলাম আমি। স্যান্ডেল চুরির ৩৬ ঘন্টার মাথায় আমার কাছে ২৩০০ টাকা এসেছে, এর মধ্যে আমি ৩০০ টাকা খরচ করেছি, ২ হাজার টাকা আছে। স্যান্ডেলটা কেনার জন্য জানুয়ারী মাসে আমার মা আমাকে ঠিক ২ হাজার টাকা দিয়েছিলেন !
আপনি বলতেই পারেন এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা, কোনভাবে মিলে গেছে। সেদিনের আগে ও পরে আজকে পর্যন্ত আমি বহু নবজাতক ম্যানেজ করেছি। একমাত্র সেদিন বাদে আর কোনদিন আমি ১ হাজার টাকার কাজের জন্য ১৫০০ টাকা পাইনি। জীবনেও না। সামান্য একটা স্যান্ডেলের জন্য আমি কিছুটা কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি ধৈর্য ধরেছিলাম ও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করেছিলাম। আল্লাহ্ আমার কষ্ট দেখেছিলেন, তিনি আমার কৃতজ্ঞতা দেখেছিলেন। আল্লাহ্ এমনভাবে আমাকে সেটার প্রতিদান দিলেন যা আমি কোনভাবেও কল্পনা করতে পারিনি।
কুর'আনে আল্লাহ্ বহুবার আমাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে বলেছেন, ধৈর্য ধরতে বলেছেন। আপনি যেকোন পরিস্থিতিতে কৃতজ্ঞ হতে শিখুন। আপনি চেষ্টা করুন, আপনি পারবেন। এটা কুর'আনের শিক্ষা। কুর'আন শুরুই হয়েছে "আলহামদুলিল্লাহ" দিয়ে ( সকল প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা, বিনয়, নম্রতা, ভালবাসা, শ্রদ্ধা আল্লাহর জন্য) . দিনে রাতে হাঁচি, কাশি টয়লেট সহ যাবতীয় কাজে আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়ে দিয়েছেন।
[] যদি তোমরা বিশ্বাসী হও আর কৃতজ্ঞ হও, তাহলে তোমাদের শাস্তি দিয়ে আল্লাহর কোন লাভ আছে কি?
What can Allah gain by your punishment, if you are grateful and you believe? ( 4:147)
[] যে-ই আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য মুক্তির পথ বের করে দিবেন। আর তাঁকে এমন যায়গা থেকে রিযিক দিবেন যা তার কল্পনারও বাইরে। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। অবশ্যই আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন। (65: 2-3)
[] "মনে পড়ে তোমাদের প্রভু বলেছিলেন, তোমরা যদি একবারও কৃতজ্ঞ হও, শুধুই একবার, তাহলে আমি তোমাদেরকে দিতেই থাকবো, দিতেই থাকবো, দিতেই থাকবো।" (১৪:৭)
[] "আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়ভীতি, ক্ষুধা, কখনোবা তোমাদের জান-মাল ও ফসলাদির ক্ষতি সাধন করে; তাই যারা ধৈর্য্যধারন করে তাদেরকে সুসংবাদ দাও। " ( ২:১৫৫)
[] "No disaster strikes except by permission of Allah . And whoever believes in Allah - He will guide his heart. And Allah is Knowing of all things." ( 64:11)
[] " তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তা তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই সবচে ভাল জানেন, তোমরা জান না।" (২:২১৬)
হয়ত আল্লাহ্ নবী আইয়ুব(আ) এর মতন আমাদের পরীক্ষা নেবেন না কোনদিনও। কিন্তু আপনি নিজের বিশ্বাসকে তাঁর মতন করে প্রস্তুত করুন। আপনি সরাসরি আল্লাহ্ ও নবীদের কাছ থেকে গাইডলাইন নিন।পার্থিব জীবনে আল্লাহ্ অবশ্যই আমাদের সবার পরীক্ষা নিবেন, কিন্তু সেটা আমাদেরকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়, আমরা ধৈর্য্য ধরে কৃতজ্ঞ হয়ে তাঁর আরো কাছে যেতে পারি কিনা সেটারই সুযোগ দেন আল্লাহ্। আমরা সবাই তাঁর কাছ থেকেই এসেছি, শুধুমাত্র তাঁর কাছেই আমরা ফেরত যাব একদিন। তাঁর চেয়ে আপন আমাদের আর কেউ নেই, তাঁর চেয়ে বড় বন্ধু আমাদের আর কেউ নেই। আপনি যদি আপনার চরম দুর্দিনেও কৃতজ্ঞ হতে পারেন তাহলে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আল্লাহও আপনাকে এমন এক দিনে স্মরণ করবেন যেদিন কেউ কারোর কাজে আসবে না। কেমন হবে সেই মূহুর্ত টা যদি হাশরের ময়দানে আল্লাহ আপনাকে ডেকে বলেন- " আমার বান্দা ! তুমি অসাধারন একজন কৃতজ্ঞ বান্দা ছিলে । আজকে আমি আল্লাহ্ তোমার উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট । "
এর বেশি কি কিছু চাওয়ার আছে আমাদের???
" ও আল্লাহ, আপনি আমাকে এবং আমার বাবা-মা কে যে অনুগ্রহ করেছেন, তা উপলব্ধি করে কৃতজ্ঞ হবার সামর্থ্য দিন। যে সৎকাজগুলো আপনাকে খুশি করে, সেগুলো করার সামর্থ্য দিন। আমার সন্তানদেরকে সৎ হতে দিয়েন। আমি ক্ষমা চাই, আমি এখন আপনার অনুগতদের একজন। " (কু’রআন ৪৬:১৫)
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: