উম্মে আনমার দাস বেচাকেনা করলে কী হবে? তার নিজের জন্যও এটা দাসের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তাই সে একজন বলিষ্ঠ ও ছটপটে দাস খুঁজছিল। দাস কেনার জন্য আনমার একদিন বাজারে গেল। শত শত দাস উঠেছে বাজারে। এদের মধ্যে একজনকে আনমারের খুব পছন্দ হলো। দাসটি ছিল বেশ জোয়ান ও শক্ত-সমর্থ। দাসটির নাম খাব্বাব। তাকে বেশ ভদ্র ও বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছিল। তাই দাসটিকে পেয়ে আনমার যারপরনাই খুশি হলো।
বিক্রেতার দাবি মিটিয়ে আনমার খাব্বাবকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। সে দাসটিকে তরবারি তৈরির কলাকৌশল শেখানোর পরিকল্পনা নিল। তাই তাকে মক্কায় একজন কর্মকারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো। খাব্বাব ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান। তাই তিনি অল্পদিনের মধ্যেই তরবারি বানানো শিখে ফেললেন। হযরত খাব্বাবের বুদ্ধিমত্তা ও গুণের কারণে আনমার যারপরনাই খুশি হলো। দাসটির সাহস, যোগ্যতা ও ন্যায়নিষ্ঠা আনমারকে বিস্মিত করল।
তখন ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগ। ইসলামের দাওয়াত প্রচারের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। মহানবী (সা) অতি গোপনে দীনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা তাঁর সাথী হয়েছেন তাঁরাও অতি সাবধানে মানুষকে দীনের দাওয়াত দিচ্ছেন। ইসলাম প্রচারের এ খবর হযরত খাব্বাবের কানে এসে পৌঁছল। আর যায় কোথায়? তাঁর মন ছিল সত্যের প্রতি অনুরাগী। তাই হযরত খাব্বাব (রা) আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি চুপি চুপি মহানবী (সা)-এর কাছে গিয়ে তাঁর মনের বাসনা খুলে বললেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। ইসলাম কবুল করার ফলে বদলে গেল হযরত খাব্বাবের জীবন। দীনের পরশ তাঁকে সত্যের প্রতি আরও বেশি আকুল করে তুলল। খোদায়ী দীনের স্পর্শ পেয়ে তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। এখন তাঁর একটাই ভাবনা। আল্লাহর কথা কিভাবে প্রচার করা যায়। কিভাবে ইসলামের আলো পথহারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। তিনি কামারশালায় কাজ করেন। আর ফাঁকে ফাঁকে শুধু আল্লাহর চিন্তায় মগ্ন থাকেন।
খাব্বাব (রা) নিজে থেকে না বললেও তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর চাপা থাকল না। বাতাসের বেগে তা মক্কার সবখানে ছড়িয়ে পড়ল। এ খবর মনিব আনমারের কানেও গেল। দাস ইসলাম কবল করেছে! আনমারের মাথায় আগুন ধরে গেল। তাই ইসলামবিরোধী আনমার বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। ক্ষণিকের মধ্যেই আনমার তার দলবলসহ কামারশালায় গিয়ে হাজির হলো। সেখানে পেয়ে গেল খাব্বাবকে। আর যায় কোথায়? প্রচণ্ড রাগ ও উত্তেজনায় কাঁপছে আনমার। সে হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
: তুই না কি মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছিস, বল, জবাব দে?
: হ্যাঁ করেছি, জবাব দিলেন খাব্বাব।
এমনিতেই আনামর ছিল বেশ উত্তেজিত। মুখের ওপর খাব্বাবের জবাব শুনে সে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো রেগে গেল। আনমার রাগতস্বরে বলল,
: তোর এত বড় সাহস? আমার কেনা গোলাম হয়ে তুই আমার ধর্ম ত্যাগ করেছিস? তুই নাস্তিক হয়ে গেছিস? বলতে বলতে খাব্বাবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আনমার। তার দলের লোকেরা কামারশালার হাতুড়ি ও লোহার পাত দিয়ে হযরত খাব্বাবকে পেটাতে লাগল। গায়ে যত শক্তি ছিল তা দিয়ে খাব্বাব (রা)-কে এলোপাতাড়ি মারতে লাগল। ফলে আঘাতের পর আঘাতে খাব্বাবের দেহ ক্ষতবিক্ষত হলো। তাঁর শরীরের চামড়া ছিঁড়ে গেল। মাথা কেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল। টাটকা খুন ঝরতে জরতে খাব্বাবের দেহ প্রায় অবশ হয়ে পড়ল। অত লোকের শত আঘাত তিনি আর সইতে পারছিলেন না। ফলে একসময় জ্ঞান হারালেন। সেদিন তো এভাবেই কেটে গেল। মারের এই ধাক্কা সামলাতে তাঁকে যে কী কষ্ট পেতে হয়েছে তা বর্ণনা করাও কঠিন। তারপর থেকে আরও বহুবার খাব্বাবকে অনেক জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। মার খেয়েছেন, জীবনেরও হুকমি এসেছে। তারপরও হযরত খাব্বাব (রা) দীনের স্পর্শ ত্যাগ করেননি।
অনেক সময় মনিবের লোকেরা তাঁকে পশুর মতো করে টেনে-হিঁচড়ে মরুভূমিতে নিয়ে যেত। ভর দুপুরে মরুভূমি আগুনের ফুলকি ছড়াত। আর এ সময় দুশমনরা হযরত খাব্বাবকে তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে রাখত। কখনও তাঁর শরীরে লোহর বর্ম পরানো হতো। ফলে তিনি নড়াচড়া করতে পারতেন না। মাঝে মাঝে ফুটন্ত বালুতে উপুড় করে শুইয়ে খাব্বাবকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ফেলে রাখা হতো। ফলে গরমে তাঁর চামড়া পুড়ে যেত। অনেক সময় গরমে ঘাম ঝরতে ঝরতে খাব্বাব(রা) অবশ হয়ে যেতেন। তখন তৃষ্ণায় তাঁর বুক ফেটে যেতে চাইত। তিনি পানি চেয়ে চিৎকার করতেন। এতে কাফেররা খুশি হতো। তারা হায়েনার মতো কপট হাসি হেসে খাব্বাবকে উপহাস করত। এক ফোঁটা পানি তো দিতই না, বরং তারা খাব্বাবকে উদ্দেশ্য করে বলত,
: বোঝ মজা। মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করার শাস্তি বোঝ। এবার মাথা ঠিক হয়েছে তো? তা হলে ইসলাম ত্যাগ কর। নতুন ধর্ম ত্যাগ করলে তোকে ছেড়ে দেব। পানি, খাবার সবই পাবে। শুধু বল, আমি মুহাম্মদের ধর্ম ছেড়ে দিলাম।
হযরত খাব্বাব (রা) দুশমনদের কথা শুনে আরও দৃঢ় হন। তাঁর মুখে তখন জোরে জোরে ধ্বনিত হতো মহান আল্লাহর নাম। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে একসময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। তারপর আবারও জ্ঞান ফিরে এলে আল্লাহকেই ডাকতে থাকতেন। হযরত খাব্বাবের ওপর দিনের পর দিন ধরে চলত এ ধরনের নির্যাতন। উম্মে আনমারের বদমেজাজিও অত্যাচারী এক ভাই ছিল। সে ছিল আরও নিষ্ঠুর। সে প্রতিদিন খাব্বাবের কামারশালায় যেত। এসেই উত্তপ্ত লোহার পাত তুলে চেপে ধরত খাব্বাবের মাথায়। এতে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে খাব্বাবের জ্ঞান হারিয়ে যেত। হুঁশ ফিরে এলে তাঁকে আবারও নির্যাতন করা হতো। তারপরও তিনি দমে যাননি। কোনো অত্যাচারকেই খাব্বাব পরোয়া করতেন না। হযরত খাব্বাব ছিলেন অতিশয় দরিদ্র। তবে তাঁর মন ছিল সত্যের সম্পদ ও সৌন্দর্যে ভরপর। তিনি ছিলেন পাহাড়ের মতো দৃঢ়চেতা ও অনড়। মহান আল্লাহকে ভালবেসে তিনি আরও ইস্পাত কঠিন হয়ে ওঠেন। তিনি একাই কাফের কুরাইশতের সাথে লড়াই করেছেন। তাদের অন্যায় ও অসত্য অহমিকাবোধকে রুখে দাঁড়িয়েছেন। কাফেরদের শত নিপীড়নের মুখেও মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে তিনি মাথা নত করেননি, সত্যের পথ থেকে একচুলও নড়েননি। হযরত খাব্বাব (রা) আমাদের জন্য তাই অনন্য আদর্শ হয়ে আছেন।
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: