১। গত বছরের আগষ্টে ফ্লোরিডায় ছিলাম আমার মেয়ের কাছে। প্রতিবেশীরা বেশীরভাগ মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিক, এদের সবাই Florida Institute of Technology (FIT) তে মাষ্টার্স অথবা পিএইচডি করছে নিজ নিজ দেশের সরকারের খরচে। সবাই পরিবার নিয়ে বসবাস করছে, সবার পরিবারে ৩/৪ জন করে সন্তান। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছেঃ সৌদী আরব, লিবিয়া, ইরাক, কুয়েত, ওমান, ইউএই, জর্দান, ও কাতার এর। এদের কয়েকজনের সাথে গল্প করতে যেয়ে বেশ কিছু তথ্য পেলাম তাদের পড়াশুনার বিষয়ে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। সবার সাথে সময় নিয়ে একান্তে আলোচনায় প্রাপ্ত তথ্যের সারাংশ দাড়ালোঃ
[ক] সবচেয়ে ভালো আছে (সরকারী আর্থিক সহায়তা বিবেচনায়) সৌদী আরব, কুয়েত, ইউএই, ও ওমান এর ছাত্ররা।
[খ] মাঝামাঝি অবস্থানে আছে জর্দানের ছাত্ররা–তাদের জন্য সরকারী বরাদ্দ উপরের দেশের তূলণায় কম। এর পরেও ফ্লোরিডা’র হিসেবে ভালো।
[গ] সবচেয়ে দৈন্য-দশায় ও কষ্টে আছে ইরাক ও লিবিয়ার ছাত্ররা। তাদের সরকারী টাকা-প্রাপ্তির স্পীড দিনে দিনে গতি হারাচ্ছে। টাকা আসছে অনিয়মিত। আশংকায় তাদের দিন কাটছে। খাওয়ার খরচ বাঁচাতে এরা অধিকাংশ সময় মসজিদে যেয়ে খেয়ে আসে (মসজিদের খাবার ফ্রি)।
[ঘ] আবার ইরাক ও লিবিয়া - এ দুই দেশের ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে সমস্যায় আছে লিবিয়ান ছাত্ররা। সত্যিই খুব দৈন্য-দশায় পড়েছে এরা। লিবিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে তার সাথে আবার একান্তে বসলাম, আলাপ করে জানতে পেলাম লিবিয়ার বেশ কিছু Internal চিত্র। তাই নিয়ে এ লেখা। খসড়া করে পোষ্ট দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। গতকাল লিবিয়া নিয়ে নুতন এক প্রতিবেদন পড়েই মনে হলো – পোষ্ট দেয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি, আর আমার লেখাও ইতিহাস হয়নি এখনো ।
২। ০১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে কর্নেল গাদ্দাফি যখন King Idris এর কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহন করে, তখন লিবিয়া ছিলো আফ্রিকার অন্যতম এক দরিদ্র দেশ। সাত লক্ষ বর্গমাইল অধ্যূষিত দেশটি’র জনসংখ্যা মাত্র ৬ মিলিয়ন (১৪০টি ট্রাইব), আর পৃথিবীর তেল-রিজার্ভ এ ১০ম স্থানের অধিকারী। এর পরেও গাদ্দাফীর ক্ষমতা নেয়ার প্রাক্কালে দেশটি কেন এত গরীব ছিলো, সে ইতিহাসের বিস্তারিত পাঠে যাচ্ছি না। লিবিয়া’র Per Capita GDP ছিলো $293 (1960), $472 (1969), $12,812 (1979), $5,882 (1989), $7,064 (1999), $10,574 (2009) – এসবই বিশ্বব্যাংক এর রিপোর্ট অনুযায়ী। ১৯৬৯ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত ছিলো কর্নেল গাদ্দাফি’র শাসনকাল, যিনি কিনা পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে লৌহ-মানব, Dictator, এবং আরো অনেক কিছু। এখন ২০১৪ সালে Per Capita GDP এসে দাড়িয়েছে $7,942 তে। বিশ্বব্যাংক এর তথ্য অনুযায়ী আশি’র দশকে লিবিয়া পৃথিবীর একটি সমৃদ্ধশালী দেশ ছিলো; এমন কি, ছিলো অনেক উন্নত দেশের তূলনায়ও Wealthy । আর এসবই হয়েছিলো গাদ্দাফি’র আমলে।
৩। কিন্তু ২০১১ সালে NATO’র হস্তক্ষেপের পর থেকেই লিবিয়া’র অর্থনীতির সেই সমৃদ্ধশালী অবস্থায় ভাটা পড়ে। লিবিয়া হয়ে যায় একটি FAILED STATE এর
পর্যায়ে। তেলের উৎপাদন ক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে পড়ে। ছাত্রদের বৃত্তি
বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। ভার্চুয়ালী লিবিয়াতে এখন দুইটি সরকার, দুইটি
পার্লামেন্ট, দুজন প্রধান নির্বাহী, দু’টি সেনাবাহিনী, আর অসংখ্য ছোট ছোট
জংগীদল। দেশটির পশ্চিম দিকে ইসলামী মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রিনে, রাজধানী
ত্রিপলী তাদের হাতে। অন্যদিকে, দেশের পূর্বদিকে রয়েছে বিরোধী-রাজনীতিবিদদের
নিয়ন্ত্রনের সরকার, ত্রিপলী থেকে ৭০০ মাইল দূরে WWII খ্যাত TOBRUK শহরকে
কেন্দ্র করে তারা দেশ পরিচালনায় সচেষ্ট। দেশের দক্ষিনভাগ হয়ে গেছে কিছু
উপজাতি-নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি যেন
কারো হাতেই নেই। মিশর, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া সহ পশ্চিমাদেশের দূতাবাস লিবিয়া
ছেড়ে গেছে আরো আগেই। দেশে খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, হত্যাসহ অরাজকতার কোন
কিছুর অভাব নেই। এই হচ্ছে এককালের সমৃদ্ধশালী লিবিয়ার বর্তমানের চেহারা।
এখানে যে সব পরিস্থিতির কথা বলেছি, মনে হলো তারই স্বরুপ যেন আমেরিকায়
স্কলারশীপ নিয়ে মাষ্টার্স/পিএইচডি করতে যাওয়া ছাত্রদের “মলিন মুখ” এ দেখেছি। একটু ঘনিষ্ট কথা-বার্তায় গাদ্দাফী-শাসনকালের কথা শুনে আমি একেবারে হতবাক। বেদুইনদের মরুভূমির ছেড়া তাবু থেকে এনে অত্যাধুনিক ব্যবস্থা-সম্বলিত বিল্ডিং এ আবাসিত করা, আয়ের ব্যবস্থা না হলে পরিবার-প্রতি মাসিক খরচের টাকা দেয়া, বিয়ে-শাদীর খরচ দেয়া, সর্বোপরি দেশ-ব্যাপী অত্যাধুনিক চিকিৎসা-ব্যবস্থা এবং বিনা-মূল্যে উচ্চ-শিক্ষাসহ রিসার্চ এর ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরী করা – সব কিছুই তো গাদ্দাফিই করে দিয়েছিলো। আমেরিকায় উচ্চ-শিক্ষার জন্য আসা এই ছাত্ররা তাদের পড়াশুনা ও স্বাস্থ্য-বীমার টাকা ছাড়াও মাসে ১৮০০ থেকে ২৪০০ ডলার মাসোহারা পেতো। বিবাহিতদের জন্য বরাদ্দ ছিলো আরো বেশী।
৪। লিবিয়া’র বর্তমান এ অবস্থার জন্য কি কি কারণ এবং কারা দায়ী, তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। আমার মনে হয়, এ গবেষণায় চমকপ্রদ অনেক তথ্য বের হয়ে আসবে যা অনেক দেশের জন্য একটি বড় শিক্ষনীয় বিষয় হতে পারে; বহিঃশক্তির দ্বারা এভাবে একটি সমৃদ্ধশালী দেশের করুণ পরিস্থিতিতে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে লিবিয়া যেন একটি মডেল।
আমার এ লেখার এই স্বল্প-পরিসরে সে গবেষণা সম্ভব নয়। তবে লিবিয়া’র সেই
পিএইচডি’র ছাত্র (যিনি লিবিয়ার একটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক বটে) এর সাথে
সার্বিক আলোচনায় একটা বিষয় খুব পরিস্কার আমার কাছে। আর তা হলোঃ নিজ দেশের মানুষ যদি অর্থের লালসায় এবং ক্ষমতার লালসায় অন্য দেশের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়, দেশকে বিক্রী করে দেয়, সে ক্ষেত্রে সেই দেশ ধ্বংসের পথে চলে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না, ঠেকাতে পারবে না দেশের মানুষের দুর্বিষহ অবস্থানের পৌছে যাওয়াকে বন্ধ করা। অনেক শিক্ষিত লিবিয়ানরা নিজেরাও জানে না, কেন বা কিভাবে কিছু মানুষ গাদ্দাফি’র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলো। তারা “ভদ্রলোক” হয়ে অসহায়ের মতো বসে দেখছিলো নিজেদের সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের ধ্বংসের লীলাখেলা। কেউ কেউ পশ্চিমাদের ক্রীড়নক হয়ে পড়লো। আর এখন একান্তে ধূসর মরুভূমির দিকে তাকিয়ে শুধু নিজেদের বোকামী’র কথা ভেবে স্বপ্নের সেই গনতন্ত্রের কথাই ভাবছে, যা গাদ্দাফীও তাদের কে দিতে পারেনি।
৫। লিবিয়া’র এখন যে অবস্থা, তাতে বিদ্রোহী পার্টির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে
অনেকগুলোতে পৌচেছে। এতে আমেরিকার জন্যও সমস্যা তৈরী হয়ে গেছে। পশ্চিমা
বিশ্বের Time-Plan ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমারা এখন তেল থেকে তাদের Investment
তুলে নেয়ায় ব্যস্ত (ঠিক যেমনটি হয়েছে/হচ্ছে কুয়েত/ইরাক এর ক্ষেত্রে)।
দেশটির Infrastructure, যা গাদ্দাফী দিয়ে গিয়েছিলো–তা প্রায় ধ্বংশপ্রাপ্ত।
দুই গ্রুপের মধ্য থেকে উঠে আসা ৩য় দলটি (General Khalifa Hifter) এখন
আমেরিকা/CIA এর পছন্দের। General Khalifa Hifter
১৯৮০ সালে গাদ্দাফীর রোষানলে পড়ে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ভার্জিনিয়া’র
Langley-তে, যা CIA Headquarters এর কাছেপিঠেই। সিআইএ এর প্রশিক্ষন ও
অর্থায়নে মোট ৬০০ জনকে প্রস্তুত করা হয়। ১৯৯৬ সালেই এই জেনারেল চেষ্টা করেছিলো গাদ্দাফীকে হটিয়ে দিতে, কিন্তু সে মিশন ব্যর্থ হয়। এ কথা আজ দিবালোকের মতই স্পষ্ট, ১৯৯১
সাল থেকেই আমেরিকা গাদ্দাফীকে অপসারনের প্রস্তুতি নিতে থাকে, আর
রিগ্যান-প্রশাসনের কাছে এ প্রচেষ্টা একসময় PRIORITY ONE হয়ে দাড়িয়েছিলো।
৬। অদূর ভবিষ্যতে লিবিয়া আবার মিডিয়া’র টপ-লাইন এ চলে আসবে। লিবিয়ার
‘আল-কায়েদা’র অংগ Ansar-Al-Sharia মূলতঃ NATO’র সহায়তায় সংগঠিত, আর General
Hifter এদের সাথে এক হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করছে, সেও NATO/আমেরিকার
সহায়তায়। এরই মধ্যে লিবিয়ায় আমেরিকান এ্যাম্বাসাডর হত্যার পিছনে
Ansar-Al-Sharia এর হাত ছিলো – এ তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় খোদ NATO/America
এক উতকট ঝামেলায় পড়ে গেছে। যাই হোক, General Hifter এখনো আমেরিকার লজিষ্টিক
সাপোর্ট ও এয়ার-সাপোর্ট পাচ্ছে একটাই কারণে, আর তা হচ্ছে পশ্চিমা
অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে General Hifter এর গ্রহনযোগ্যতা অনেকের
চেয়ে অনেক বেশী।
৭। একটা প্রশ্ন এসে যায়, আমেরিকা কেন গাদ্দাফী-বিরোধী হয়ে উঠলো?
NATO’র
হিসেবেঃ
[ক] গাদ্দাফী বিদেশী অর্থ-লগ্নীতে স্থানীয়দের স্বার্থকে উর্ধে
স্থান দিতে চেয়েছিলো,
[খ] গাদ্দাফী’র UNITED STATES OF AFRICA ক্যাম্পেইন, যা ভবিষ্যতে
এই রিজিওনে আমেরিকার স্বার্থ-বিরোধী হতে পারতো,
[গ] অন্যদিকে রিজিওনার এই কনসেপ্ট বাস্তবায়ন হলে অন্যতম নেতা
হিসেবে আফ্রিকার নিয়ন্ত্রন গাদ্দাফীর হাতে চলে যেতো – যা আমেরিকার স্বার্থ
রক্ষায় এক বড় বাঁধা হয়ে দাড়াতো।
আমেরিকা গাদ্দাফীকে থামাতে ২০১১ সালে সর্ব-প্রথম লিবিয়া’র ৩০ বিলিয়ন ডলার আটক করে। এ টাকা গাদ্দাফী রেখেছিলো “প্রস্তাবিত” African IMF ও African Central Bank এর মূল তহবিল হিসেবে।
Reference:
1. CIA Factbook on Libyan Economy (1960 ~ 2006)
2. “Libya: From Africa’s Richest State Under Gaddafi, to
Failed State After NATO Intervention”, issued by Global Research Dated
19 October 2014
3.
“Libya edges closer to economic collapse as currency dives”, by Reuters.com, Dated: 01 June 2015
4.“Libya”, Authors: Sahar Rad, Samia Mansour
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: