১.
বাংলাদেশে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে কোনো
বিভেদ নেই, ছিল না আগেও। এখানে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গাও কোনোকালে হয়েছে বলে
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। বরং শিয়া সম্প্রদায়ের নানা প্রভাব যেমন মর্সিয়া,
কারবালার জারি, পুঁথি ও ইমামতি বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রবল। ধর্মীয় শাখাগত বা
সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত (Sectarian conflict and Violance)) কতটা
ভয়াবহ রক্তাক্ত রূপ নিতে পারে তা আমরা ইরাকে দেখছি, ইয়েমেনে ও পাকিস্তানে
দেখছি। এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যায়নিস্ট মিত্র একটি
পক্ষকে মদদ দেয় এবং এই ধর্মীয় দ্বন্দ্ব অল্প কিছু দিনের মধ্যে রাজনৈতিক
অংশীদারিত্বের আন্দোলনে পরিণত হয়। শিয়া ও সুন্নিদের পারস্পরিক বিশ্বাস নষ্ট
হওয়ায় উভয়পক্ষ বহিরাগতদের শরণাপন্ন হয়। শুরু হয় টিকে থাকার রক্তাক্ত লড়াই।
ফতোয়ার মাধ্যমে গোঁড়াগোষ্ঠী শিয়াদের ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় এবং তাদের
রক্ত কথিত জিহাদীদের কাছেও হালাল হয়। এর জবাবে নিজেদের জীবন বাঁচাতে অস্ত্র
হাতে নিতে বাধ্য হয় শিয়া মুসলমানরাও। হয় মারো, না হয় মরো (Kill or Be
Kiled)। অতএব হোসেনী দালানের এই হামলাকে অতিরিক্ত কাভারেজ দিয়ে প্রচার করে
দেশের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলা উচিত হবে না। বরং এটিকে ক্ল্যাসিফাইড
করে দ্রুত সমাধান করতে হবে। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত
স্থাপন করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে সন্ত্রাসীরা ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার
চিন্তা করতেও সাহস না পায়।
বাংলাদেশে সৌদি আরবের ধর্মনীতি তথা
ওয়াহাবি ও ইবনে তাইমিয়ার রক্তাক্ত মতাদর্শের সমর্থক গোঁড়া শ্রেণীর কাছে
শিয়ারা উত্তম মুসলিম বলে এখনো বিবেচিত নয় (প্রকৃতপক্ষে শিয়াদের অমুসলিম
বলার অধিকার এরা রাখে না, কারণ তাঁরা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করে এবং
মহানবী (সা.)-কে শেষ নবী ও রাসূল বলে স্বীকার করে।)। এই সাম্প্রদায়িক
ধর্মান্ধরা সাধারণত কওমী ও আলীয়া মাদরাসার শিক্ষক, তাদের মগজধোলাইকৃত
শিক্ষার্থী এবং ওয়াজ, খানকাহ ইত্যাদির মাধ্যমে তৈরিকৃত অনুসারীগণ। সব কওমী
আলেম শিয়াদের অমুসলিমভাবে তা নয়, ইদানিং অনেক বিচক্ষণ আলেম মুসলিম ঐক্যের
কথাও বলছে দেখেছি। তো যা বলছিলাম,এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ চার মাযহাবী অথবা
লা মাযহাবী ও আহলে হাদীসের সৌদি আরবপন্থীরা শিয়াদের উপর তাকফির (কাফির
ঘোষণার প্রক্রিয়া) করলে তা বাংলাদেশে ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিতে পারে। তাই
মিডিয়ার উচিত হবে না ঘন ঘন শিয়া ও সুন্নি শব্দ ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক
বিভাজনকে উস্কে দেয়া। এখন প্রত্যেকদিন যদি পত্রিকার প্রথম পাতায় “শিয়াদের
তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা” (যদিও সেটি মিছিলের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল) এই
সংবাদ হয় তবে তা মনোজগতে একটি বিভাজন রেখা এঁকে দেবে। কারণ এই ঘটনা ইরাকের
তিকরিত, কারবালায় ঘটে শুনে বাংলাদেশিরা অভ্যস্ত, বাংলাদেশে তথা ঢাকায় এটি
নতুন। ইরাকের ঘটনা দেখে অনুপ্রাণিত ঘুমন্ত সুন্নি নামধারী সাম্প্রদায়িক
সংকীর্ণ অথবা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ওঁৎপেতে থাকা অপগোষ্ঠী এ ঘটনার
পুনরাবৃত্তি ঘটাতে উত্সাহিত হতে পারে। অতএব এই ঘটনা ফলাও করে প্রচার ও
সম্প্রচার জাতীয় স্বার্থে সীমিত করতে হবে। অন্যথায় এ বিভাজন বাংলাদেশের
জাতীয় ঐক্যের জন্য কাল হয়ে যেতে পারে। সিরিয়ায় এই যে রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ এর
প্রাথমিক কারণের একটি কিন্তু শিয়া ও সুন্নি দ্বন্দ্ব-এ কথা ভুলে গেলে চলবে
না। ইরাকেও তাই। এসব ভুলে গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ কিন্তু খারাপ হয়ে যেতে
পারে। আন্তর্জাতিক শত্রুর দল বাংলাদেশের দিকে কুনজর কিন্তু অনেক আগে থেকেই
দিয়েছে। দেশিয় অনুচরদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভাবে এতদিন তা পেরে ওঠেনি।
এখন তাদের সে সুযো দেয়া যাবে না।
৩.
শিয়া ও সুন্নি প্রতিশব্দদ্বয় কেবল
বাংলাদেশ পরিচিত নয়। এটি সমগ্র পৃথিবীর গণমাধ্যমে বহুল ব্যবহৃত দুটি শব্দ।
মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত বোঝাতে শিয়া ও সুন্নি শব্দযুগলকে গণমাধ্যমে আনবেই
ইহুদীবাদী ও পশ্চিমা মিডিয়া। এর মাধ্যমে ওরা Divide and Rule নীতি কার্যকর
করে। বাংলাদেশের ঘটনায় ইতোমধ্যেই 'শোক জানিয়ে' টুইট করেছে আমেরিকান
দূতাবাস। এটি খারাপের পূর্বাভাস। আমেরিকা জানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে
কারবালায়, কূফায়, করাচিতে কারা বোমা হামলে করে। তাদের অস্তিত্ব প্রিয়
বাংলাদেশে নেই অথচ সেই “ধরনের হামলা” হিসেবে এদেশের সাংবাদিকগোষ্ঠী সংবাদ
প্রচার করছে। অথচ তাদের উচিত ছিল এই ঘটনায় ঐক্যবদ্ধ একটি এজেন্ডা সেট করে
ঘটনার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবকে ডিফোকাস করা। সেটি করতে তারা ব্যর্থ
অথবা ইচ্ছে করেই করেনি। আমরা যেন ইরাকের গাড়িবোমা হামলার নিউজগুলো
বাংলাদেশে টেনে আনতে ইচ্ছুক। আমাদের সাংবাদিগোষ্ঠ কে বুঝতে হবে, যদি এদেশে
কথিত “সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের” আগুন জ্বলে তবে আমাদের হাউজগুলোও জ্বলবে।
মাথার উপর দিয়ে ড্রোন উড়ে গেলে টিভিতে বা পত্রিকায় নিজেদেও রঞ্জিত বা
অতিরঞ্জিত সংবাদ দেখার মানসিকতা আর থাকবে না। অতএব এখনই সাবধান হতে হবে
আমাদের।
৪.
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের শিয়া সম্প্রদায়ের
নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল উজমা খামেনেয়ী। তিনি এ
বছর আশুরা তথা ১০ মহররমের আগেই অভিমত দিয়েছেন যে, ১০ মহররমে কারবালার
ট্রাজেডির কথা স্মরণ করে নিজেকে রক্তাক্ত করা ইসলামসম্মত নয়। এরমানে
শিয়াদের রক্তাক্ত করার ব্যাপারটা অতোটা গুরুত্বপূর্ণ না। তারপরও কেউ রক্ত
ঝরাতে চাইলে তাকে স্বেচ্ছায় রুগীদের বা হাসপাতালে রক্ত দিতে বলেছেন ইরানি
আলেমরা। এমন শান্তিপূর্ণ চমৎকার ফতোয়ার পরেও শিয়াদের প্রতি বিদ্বেষ রাখা
জুলুম। তদুপরি কেউ তাজিয়া মিছিল করে শোক প্রকাশ করতে চাইলে তাতে হামলা করা
কোনোক্রমেই ইসলাম সম্মত নয়। যদি ইসলামের নাম করে কেউ এটা করে সেটি ইয়াজেদি ও
উমাইয়া ইসলাম, আল্লাহপাক কর্তৃক মনোনীত মহানবী (সা.) এর ইসলাম নয়। অতএব এই
হামলার সাথে সুন্নি ইসলামকে সম্পৃক্ত করে সংবাদ করা বন্ধ রাখতে হবে।
মিডিয়ায় শিয়া সুন্নি সম্প্রীতি কথা তুলে ধরতে হবে।
৫.
হামলার পরে ইরানি সংবাদমাধ্যম রেডিও
তেহরানের সংবাদ ভালো করে দেখেছি। সেখানে একবারও চেষ্টা করা হয়নি আইএস বা আল
কায়েদা সংশ্লিষ্টতা দেখানোর। এটিই বুদ্ধিমানের কাজ। সেক্টেরিয়ান
দ্বন্দ্বকে প্রশমিত রাখার উত্তম উপায় ঘটনাকে আড়ালে নিষ্পত্তি করা।
জনসম্মুক্ষে এলেই তা গণবিদ্বেষের উদ্ভব ঘটাতে পারে। রাশিয়া ইরানের মাধ্যমে
শিয়াদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক
অঙ্গনে ইরান ও রাশিয়ার ব্লকে। শিয়াদের আক্রমণের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে
বাংলাদেশের দূরত্ব তৈরি হলে তা রাশিয়ার সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি করবে। সুতরাং এই
ঘটনাকে অতটা বৃহৎ ক্রাইসিস হিসেবে প্রকাশ না করে গোপনে সর্বাধিক গুরুত্ব
দিয়ে সমাধানের চেষ্টা চালাতে হবে। এই ঘটনা নিয়ে মাতামাতি বন্ধ করতে হবে।
শিয়া-সুন্নি বিভেদ তৈরি হতে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ইমেজকে
নষ্ট করা যাবে না। শিয়া-সুন্নি, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান,
সাঁওতাল-বাঙাল সবাই মিলেই আমরা বাংলাদেশি। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির
দৃঢ় বন্ধন কেউ ছিঁড়তে পারবে না। জাতীয় স্বার্থে শিয়া-সুন্নি বিভাজনের হীন
চক্রান্ত রুখে দিতে হবে। তবেই বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হবে।
লেখক: মুক্ত সাংবাদিক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাাঙ্গীরনর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: