Monday, October 12, 2015

বনু সাফিকা ও আবু বকরের খেলাফত লাভ সুন্নি সোর্স থেকে সংগ্রহীত

বনু সাফিকা ও আবু বকরের খেলাফত লাভ -রাসুল সাঃ এর ওফাতের পর কিছু আনসার সাহাবী তাঁদের নিজেদের মধ্য থেকে খলীফা নির্বাচনে প্রবৃত্ত হন। বনী সাফিকার ঝোপ-ঝাড় আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁরা সমবেত হন। সাদ ইবনে উবায়দা (রা:) যিনি খাযরাজ গোত্রের প্রধান ছিলেন, তিনি অসুস্থ অবস্থায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি আনসার সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বল্লেন:
“ওহে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা যে গুণাবলীর অধিকারী তা অন্য কোনো গোত্র ধারণ করে না। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মক্কা নগরীতে তেরোটি বছর তাঁর গোত্রকে ইসলাম ধর্মের দিকে আহবান করেছিলেন। তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই তাঁকে বিশ্বাস করেছে। আর যারা তাঁকে বিশ্বাস করেছে, তারা জেহাদ করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক ছিলেন না। আল্লাহ্ তা’লা যখন তোমাদেরকে মুসলমান হওয়ার সম্মান দান করেন, তখন তিনি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (দ:) ও তাঁর আসহাবকে রক্ষা করার এবং জেহাদ দ্বারা দ্বীন ইসলামকে প্রচার-প্রতিষ্ঠা করার সৌভাগ্যও দান করেন। তোমরাই শত্রুদেরকে পরাভূত করেছ। তোমাদের তরবারির ভয়েই আরবের কৃষকেরা মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ্ (দ:) বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার আগে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এখন নেতৃত্ব করার অধিকার তোমাদেরই রয়েছে। এই অধিকার তোমরা অন্য কাউকে দেবে না।”
অধিকাংশ আনসার সাহাবী সেখানে উপস্থিত ছিলেন; তাঁরা সবাই বল্লেন, “আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা আপনাকে খলীফা নির্বাচন করলাম, আল্লাহ্ আপনাকে সাহায্য করুন!” কিন্তু আনসারদের মধ্যে আউস্ গোত্র একে পছন্দ করলেন না। তাঁরা তাঁদের নেতা উসাইয়াদ ইবনে হুদাইরের আশপাশে সমবেত হলেন।
অপর দিকে মুহাজির সাহাবীগণও আনসারের দুইটি গোত্র থেকে খলীফা নির্বাচনকে পছন্দ করেন নি। কেননা, সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডে কোরাইশ গোত্র-ই ছিল সবচেয়ে অভিজাত ও মহাসম্মানিত। তাই মুসলমানদের মধ্যে বড় ধরনের একটা বিতর্ক অত্যাসন্ন হলো।
এমনি একটি সংকটময় মুহূর্তে জীবন রক্ষক হযরত খাজা খিজির (আ:)-এর মতো হযরত আবু বকর (রা:), হযরত উমর (রা:) এবং হযরত আবু উবায়দা (রা:) বিতর্ক স্থানে উপস্থিত হন। সেই সময় জনৈক আনসার উঠে দাঁড়িয়ে ভাষণ দান করছিলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কে সাহায্য করেছি। মোহাজিরদেরকে আশ্রয় দিয়েছি। খলীফা আমাদের মধ্য থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।”
পক্ষান্তরে, রাসূলুল্লাহ্ (দ:) সব সময়ই তাঁর ডানে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) ও বাম পাশে হযরত উমর ফারুক (রা:)-কে রাখতেন। হযরত আবু উবায়দা (রা:) সম্পর্কে তিনি বলতেন, “এই উম্মতের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি।” যখন এই তিনজন একত্রে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন, তখন মনে হলো যেন রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-ই পুনরুত্থিত হয়ে আগমন করেছেন। সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাঁদের বক্তব্য শ্রবণের অপেক্ষায় রইলেন। হযরত আবু বকর (রা:) বল্লেন:
“এই উম্মতের লোকেরা ইতিপূর্বে মূর্তি পূজা করতো। আল্লাহ্ তা’লা তাদের মাঝে একজন রাসূল (দ:) প্রেরণ করেন যাতে তারা আল্লাহর-ই এবাদত করেন। কাফেররা নিজেদের পিতৃপুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করাকে কষ্টকর মনে করেছিল। আল্লাহ্ তা’লা মোহাজিরদেরকে ঈমানদার তথা বিশ্বাসী হওয়ার সম্মান নসীব করেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর সাথী ও দুঃখের ভাগীদার হয়ে যান। দ্বীনের শত্রুদের অত্যাচার-নিপীড়ন তাঁরা তাঁর সাথে ভাগাভাগি করে সহ্য করেন। তাঁরাই হক্ক সোবহানাহু ওয়া তা’লার প্রাথমিক এবাদতকারী। এ কারণেই খলীফা তাঁদের মধ্য থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে তাঁদের অংশীদার কেউই হতে পারে না। তাদের এ অধিকার হরণ করা নিষ্ঠুর আচরণ হবে নিঃসন্দেহে। ওহে আনসার! দ্বীন ইসলামের প্রতি তোমাদের খেদমতকেও অস্বীকার করা যায় না। আল্লাহ্ তা’লা তাঁর নবী (দ:) এবং দ্বীনকে সাহায্য করার জন্যে তোমাদের পছন্দ করে নিয়েছেন। তিনি তাঁর রাসূল (দ:)-কে তোমাদের মাঝে প্রেরণ করেছেন। প্রাথমিক মোহাজির হওয়ার সম্মান লাভকারীদের পরে তোমাদের চেয়ে অধিক মূল্যবান আর কেউ নেই। তোমরা-ই রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কে অনুসরণ করেছ। তাঁকে সাহায্য করার গর্ব ও সম্মান তোমাদের-ই প্রাপ্য। কেউই এতে দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। তবুও সমস্ত আরববাসী কুরাইশ বংশীয় কাউকে খলীফা পদে অধিষ্ঠিত দেখতে চায়, আর কাউকেই তারা দেখতে চায় না। কেননা, সবাই জানে যে বংশ-মর্যাদা ও গুণাবলীতে কুরাইশ বংশই আরবীয়দের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আর তাদের ভূমিও আরবের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। আমাদেরকে আমীর তথা আদেশকর্তা হতে দাও, তোমরা হবে আমাদের উজির ও উপদেষ্টা। তোমাদের উপদেশ ও পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত বা কাজ করা হবে না।”
অতঃপর হযরত উমর ফারুক (রা:) বল্লেন, ‘ওহে আনসার সম্প্রদায়! রাসূলে পাক (দ:) তাঁর অসুখের সময় তোমাদের জিম্মাদারী আমাদের কাছে ন্যস্ত করেছেন। যদি তোমরা হুকুম দেয়ার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার অবস্থায় থাকতে, তাহলে আমাদেরকে তিনি তোমাদের জিম্মাদারীতে রেখে যেতেন।”
এ সব কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম কী বলবেন তা বুঝতে না পেরে গভীর চিন্তামগ্ন হলেন। তাঁদের মধ্যে হোবাব বিন মুনযির উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করলেন, “আমাদের থেকে একজন এবং তোমাদের থেকে একজন আমীর নির্বাচন করা যেতে পারে।” এতে হযরত উমর ফারুক (রা:) জবাব দিলেন, “একই সময়ে দুইজন আমীর থাকতে পারে না। রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর একই গোত্রভুক্ত না হলে আরবীয় সর্বসাধারণ খলীফাকে গ্রহণ কিংবা মান্য করবে না। হোবাব এর প্রতিবাদ জানিয়ে বল্লেন, “হে আনসার! আরবীয় সর্বসাধারণ তোমাদের তরবারির মাধ্যমে এই ধর্মকে গ্রহণ করেছে। তাই এ অধিকার থেকে কেউ যেন তোমাদেরকে বঞ্চিত না করতে পারে!”
উবায়দা ইবনে জাররাহ্ (রা:) হুঁশিয়ার করলেন এ কথা বলে, “হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা-ই এ দ্বীনের প্রারম্ভিক খেদমতগার। সতর্ক হও যাতে তোমরা এর প্রথম বিনষ্টকারী না হও!” এ ধরনের বাদানুবাদের মুহূর্তে বশীর ইবনে সা’দ বিন নু’মান বিন কা’ব বিন খাজরাজ (রা:) নামের খাজরাজ গোত্রভুক্ত জনৈক আনসার সাহাবী উঠে দাঁড়িয়ে বল্লেন, “ওহে মুসলমানবৃন্দ! হযরত রাসূলে খোদা (দ:) কুরাইশ গোত্রভুক্ত। তাই খলীফা তাদের মধ্য থেকে হওয়াই যথাযথ। এটাই সঠিক হবে। হ্যাঁ, আমরাই প্রাথামিক পর্যায়ে মুসলমান হয়েছিলাম। ইসলামের খেদমতে নিজেদের জান-মাল কোরবানি করার সম্মান আমরাই লাভ করেছি। অথচ আমরা তা করেছি এ কারণে যে, আমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (দ:)-কে ভালোবাসি। আমরা এ খেদমতের বিনিময়ে কোনো বৈষয়িক প্রতিদান প্রত্যাশা করি না।” হোবাব জিজ্ঞেস করলেন, “হে বশীর! তুমি কি তোমার জেঠাত ভাইয়ের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ?” জবাবে বশীর বল্লেন, “আল্লাহর নামে শপথ, আমি মোটেই ঈর্ষাপরায়ণ নই। আমি শুধু কুরাইশদের হক্কের (অধিকারের) ওপর কারো পদদলন দেখতে চাই না।”
ওই সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) বল্লেন, “আমি এই দুইজন ব্যক্তিকে মনোনীত করছি তোমাদের জন্যে, তাদের যে কাউকে তোমরা পছন্দ করতে পারো।” তিনি হযরত উমর (রা:) ও হযরত উবায়দা (রা:)-কে দেখিয়ে এ কথা বল্লেন। কিন্তু তাঁরা উভয়ই পিছু হটে গিয়ে বল্লেন, “রাসূলে খোদা (দ:) যাঁকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন তাঁর মোকাবেলায় কে দাঁড়াতে পারে? এতে উচ্চস্বরে তর্ক-বিতর্ক আরম্ভ হলো এবং বিশৃংখলা দেখা দিলো।
এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারুক (রা:) হযরত আবু বকর (দ:)-কে উদ্দেশ্য করে বল্লেন, ”রাসূলুল্লাহ (দ:) আপনাকে নামাযে তাঁর খলীফা নিয়োগ করেছিলেন যা ইসলামের ভিত্তিস্তম্ভ। তিনি আপনাকে আমাদের সামনে স্থান দিয়েছেন। আপনার হাত সামনে বাড়ান। আমি আপনাকে খলীফা হিসেবে পছন্দ করেছি। হযরত উবায়দা (রা:)-ও অনুরূপ করতে যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এমনি সময়ে বশীর (রা:) সামনে লাফিয়ে পড়ে হযরত আবু বকর (রা:)-এর হাত মোবারক ধরলেন এবং সবার আগে আনুগত্যের বায়াত হলেন। তিনি বল্লেন, “আপনি-ই আমাদের নতুন খলীফা।” হযরত উমর ফারুক (রা) এবং হযরত উবায়দা (রা:)-ও আনুগত্যের বায়াত হলেন। সমগ্র আউস গোত্র ও তার নেতা উসাইয়াদ ইবনে হুদাইর এসে নতুন খেলাফতকে মেনে নিলেন। তাঁদেরকে দেখে খাজরাজ গোত্র-ও আনুগত্যের বায়াত হলো।
যদি আবু বকর (রা:), উমর (রা:) এবং আবু উবায়দা (রা:) ওই সময় ঘটনাস্থলে না পৌঁছুতেন, তবে সা’দ ইবনে উবায়দা (রা:)-কে খলীফা হিসেবে মেনে নেয়া হতো, যা আউস্ ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জন্ম দিতো। অপর দিকে কুরাইশ গোত্র-ও এর বিরোধিতা করতো যার দরুণ মুসলমান সম্প্রদায় বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়তো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) এই বিপদ দূর করে দেন। তাঁর খলীফা হওয়ার ফলে ইসলাম একটা বড় ধরনের সংকট থেকে রক্ষা পায় এবং মুসলমান সম্প্রদায়ও দ্বিধা-বিভক্তি থেকে বেঁচে যায়।
সোমবার দিন খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পরে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) মঙ্গলবার দিন মসজিদে নববীতে গমন করেন এবং সেখানে সমস্ত সাহাবায়ে কেরামকে সমবেত করেন। মিম্বরে আরোহণ করে তিনি প্রথমে হামদ ও সানা পাঠ করেন এবং তার পরে এই ভাষণটি দেন: “ওহে মুসলমান সম্প্রদায়! আমি তোমাদের শাসনকর্তা ও রাষ্ট্রপতি হয়েছি। তবু আমি তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নই। যদি আমি ভাল কাজ করি, তাহলে আমাকে সাহায্য করো। আর যদি আমি ভুল করি, তবে আমাকে সঠিক পথ-প্রদর্শন করো। সংশোধন করাটা বিশ্বস্ততা। মিথ্যা বলাটা বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের মধ্যে দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। আমি তার হক্ক বা অধিকার সংরক্ষণ করবো। আর যে ব্যক্তি নিজ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, সে আমার কাছে দুর্বল। কেননা, আমি তার দ্বারা হরণকৃত অন্যান্যদের অধিকার তারই কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসবো, ইনশা’আল্লাহ্ তা’লা। তোমাদের কেউই যেন জিহাদকে অবহেলা না করে। যারা জেহাদ পরিত্যাগ করবে, তারা ঘৃণিত হয়ে যাবে। আমি যতোক্ষণ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (দ:)-কে মান্য করবো, শুধু ততোক্ষণই তোমরা আমাকে মান্য করবে। যদি আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (দ:)-কে অমান্য করি এবং সত্য, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হই, তবে আমাকে অনুসরণ করার আর কোনো দরকার-ই তোমাদের থাকবে না। উঠে দাঁড়াও, আমরা এক সাথে নামায আদায় করবো। আল্লাহ্ তা’লা তোমাদের সকলকে আশীর্বাদধন্য করুন।”
অতঃপর তাঁরা রাসূলে করীম (দ:)-এর শেষকৃত্য সংক্রান্ত সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দলে দলে নারী, পুরুষ, শিশু ও গোলাম-বর্গ সকলে ওই ঘরে প্রবেশ করে জামাত ব্যতিরেকেই কেবল ব্যক্তিগতভাবে সালাত-সালাম পাঠ করে বেরিয়ে আসেন। বুধবার রাতের অন্ধকারে তাঁরা মহানবী (দ:)-কে ওই ঘরে সমাধিস্থ করেন।
’কাসাস-এ-আম্বিয়া’ গ্রন্থের ৪১০ পৃষ্ঠায় আরো লেখা আছে:
রাসূলে খোদা (দ:) যতোদিন তাঁর যাহেরী জিন্দেগীতে ছিলেন, ততোদিন ওহী (ঐশী প্রেরণা) তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং উম্মত তথা মুসলমান সম্প্রদায়ও আল্লাহ্ তা’লার বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছিলেন। তাঁর বেসালের পরে আর ওহী অবতীর্ণ হয় নি। তবু অধিকাংশ সাহাবা-ই কুরআন মজীদকে তাঁদের স্মৃতিতে গেঁথে ফেলেছিলেন। আর যে সব বিষয় কুরআন মজীদে প্রকাশ্যভাবে ব্যাখ্যা করা হয় নি তা সুন্নাতে সানিয়্যা তথা রাসুলুল্লাহ্ (দ:)-এর কথা, কাজ ও তাঁর সম্মতিতে অন্যদের কৃত কর্মের অনুসরণে সম্পাদিত হচ্ছিল। তবে সুন্নাতে সানিয়্যা ও হাদীস শরীফগুলো সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতিপটে পুরোপুরিভাবে আঁকা ছিল না। কেননা, তাঁদের কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন ব্যবসা-বাণিজ্যে; আর কেউ কেউ তদারকি করছিলেন তাঁদের খেজুর বাগান ও ক্ষেত-খামার। এমতাবস্থায় তাঁদের পক্ষে মহানবী (দ:)-এর সমস্ত সোহবত লাভ করা সম্ভব হয় নি। যাঁরা কোনো একটি সোহবত পেতেন, তাঁরা অন্যান্যদের সে সোহবতে শ্রুত বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত করতেন। ফলে হাদীস শ্রবণ করেন নি এমন ব্যক্তি ওগুলোর শ্রোতাদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে জানতে সক্ষম হতেন। বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কে সমাধিস্থ করতে সাহাবায়ে কেরামকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস্ শরীফকে অনুসরণ করেই তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (দ:) যে ঘরে বেসালপ্রাপ্ত হন সেখানে তাঁকে সমাধিস্থ করেন। অনুরূপভাবে, তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তাঁরই রেখে যাওয়া সম্পত্তি বণ্টন করার ক্ষেত্রেও সাহাবায়ে কেরাম প্রচুর কষ্ট স্বীকার করেন। আবারো হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)-ই নিম্নোক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত করেন: “আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ:) কোনো উত্তরাধিকার রেখে যান না”। ফলে এই হাদীস অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মুসলমান সম্প্রদায়ের মাতা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) বলেন, ‘যখন রাসূলুল্লাহ্ (দ:) বেসালপ্রাপ্ত হন, তখন মোনাফেকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আরবীয়রাও ইসলামদ্রোহী হয়ে যায়। আনসারবৃন্দ এর থেকে দূরে সরে থাকেন। আমার পিতার ওপরে যে বোঝা বা মসিবত এসে পড়ে তা পাহাড়ের ওপরে পড়লে নিশ্চয় পাহাড় চুরমার হয়ে যেতো। এমনি ছিল অবস্থা, যেখানে বিভেদ-বিভক্তি দানা বাঁধতো সেখানেই আমার পিতাকে উপস্থিত হতে হতো এবং তা মিটমাট করে দিতে হতো।”
যখন সাহাবায়ে কেরাম এমন কোনো বিষয়ের সম্মুখীন হতেন যা তাঁদের অজ্ঞাত, তখন তাঁরা সুন্নাতে সানিয়্যাতে এর সমাধান খুঁজতেন। যদি সমাধান তাতে না পাওয়া যেতো, তবে তাঁরা রায় (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) কিংবা কেয়াস্ (তুলনা দ্বারা অনুসন্ধান) পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ, তাঁদের জ্ঞাত কোনো বিষয়ের সাথে কেয়াস বা তুলনা করে অজ্ঞাত বিষয়াটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতেন। এটাই এজতেহাদের দ্বার উম্মুক্ত করে। যদি আসহাবে কেরাম ও অন্যান্য মুজতাহিদদের এজতেহাদ কোনো বিষয়ে একমত হতো, তবে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকতো না। এজতেহাদের এই ঐকমত্যকে এজমায়ে উম্মত বলে। এজতেহাদ প্রয়োগের জন্যে প্রয়োজন ছিল গভীর জ্ঞানী হওয়া। এই গভীর জ্ঞানী আলেমদেরকেই মুজতাহিদ বলে। যদি মুজতাহিদদের কৃত এজতেহাদ একে অপরের সাথে না মিলতো, তবে প্রত্যেক মুজতাহিদের জন্যে নিজ এজতেহাদ অনুসরণ করা ওয়াজিব হতো।
খেলাফতের নির্বাচনটিও এজতেহাদের বিষয় ছিল। এমন কিছু হাদীস্ শরীফ ছিল যেগুলোতে ঘোষিত হয়েছিল যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:), হযরত উমর ফারুক (রা:) হযরত উসমান যিন্নুরাইন (রা:) এবং শেরে খোদা হযরত আলী মোরতজা (ক:) খলীফা হবেন। কিন্তু তাঁদের খেলাফতের সময়কাল স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয় নি। রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এ কথা বলেন নি, “আমার বেসালের পরে অমুককে খলীফা নিয়োগ করো।” তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে সাহাবায়ে কেরামের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। খেলাফতের নির্বাচনে আসহাবে কেরাম কর্তৃক কৃত এজতেহাদ একে অপরের সাথে মিলে নি। এ ক্ষেত্রে তিনটি ভিন্ন প্রকৃতির এজতেহাদ ছিল:
প্রথমটি ছিল আনসারদের রায়; তাঁরা বলেন যে, “ইসলামের সর্বাধিক খেদমতকারী ব্যক্তি-ই হবেন খলীফা। আরবীয় সম্প্রদায় আমাদের তরবারির ছায়ায় মুসলমান হয়েছিলেন। তাই খলীফা আমাদের মধ্য থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।”
দ্বিতীয় প্রকৃতির এজতেহাদ ছিল অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামের গৃহীত পদ্ধতি; তাঁরা বলেন যে, “খলীফাকে উম্মতের মাঝে বিধি-বিধান প্রয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। আরবীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও ক্ষমতাশালী গোত্র ছিলো কুরাইশ। তাই খলীফা কুরাইশ গোত্রভুক্ত হওয়াই উচিৎ।”
তৃতীয় প্রকার এজতেহাদ ছিল হাশেমীদের রায়; তাঁরা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর আত্মীয় স্বজনদের মধ্য থেকেই খলীফা নির্বাচন করতে হবে।
তিনটি এজতেহাদের মধ্যে সঠিক এজতেহাদটি ছিল দ্বিতীয়টি। হ্যাঁ, আনসার সাহাবাবৃন্দ দ্বীন ইসলামের ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন সত্য। অপর দিকে রাসূলে আকরাম (দ:)-এর আত্মীয়-স্বজনের মর্যাদার ব্যাপারটিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবুও খেলাফত তো ছিল না কোনো আরাম কেদারা যা অতীতের খেদমতের জন্যে উপহারস্বরূপ দেয়া যেতো। এটা ওয়ারিশী সম্পত্তিও ছিল না যে ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া যেতো। দ্বিতীয় এজতেহাদটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুরাইশের হাতে খেলাফত ন্যস্ত করা হয় এ কারণে নয় যে রাসূলুল্লাহ্ (দ:) ওই গোত্রভুক্ত, বরং এ কারণেই যে সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডে কুরাইশ গোত্র ছিল সম্মান, ক্ষমতা, প্রভাব ও মর্যাদার জন্যে সুপ্রসিদ্ধ। কেননা, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, বিশ্বস্ততা ও সামাজিক শৃংখলা বিধান করার জন্যেই খেলাফতের কার্যকারিতা ছিল। আর এ কাজ করতে কর্তৃত্বের প্রয়োজন ছিল। খলীফার কর্তব্য হলো ফিতনা-ফ্যাসাদ ও বিদ্রোহ দমন/প্রতিরোধ করা, শান্তি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, জেহাদ পরিচালনা করা এবং শৃংখলা বজায় রাখা, যাতে মুসলমান সমাজ তাঁদের বিষয়াদি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহজে সুসম্পন্ন করতে সক্ষম হন। এগুলো করতে ক্ষমতার প্রয়োজন।
খেলাফত নির্বাচনে সাহাবায়ে কেরাম যে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন, তা হলো মুসলমান গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন। কুরাইশ গোত্রের দশটি শাখার একটি হাশেমী গোত্রকে করা সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় যতো অধিক সংখ্যক মানুষ জড়িত হবে, ততোই শক্তিশালী হবে সরকার। এই কারণেই কুরাইশ গোত্রের নেতৃস্থানীয় কাউকে নির্বাচন করা জরুরি ছিল। আর নির্বাচিত ব্যক্তিকে কেবল গোত্রীয় পরিচয় ও বংশ মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ হলে চলবে না, বরং ইসলামের দৃষ্টিতেও উচ্চ মকামের অধিকারী হতে হবে। কুরাইশ গোত্রের মধ্যে তখন শ্রেষ্ঠ ছিল বনী উমাইয়া বংশ এবং তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবু সুফিয়ান ইবনে হরব। তবু ওহুদ জেহাদে মুসলমানদের প্রতি তাঁর দ্বারা কৃত ক্ষতি তখনো একদম বিস্মৃত হয় নি। ইতিমধ্যে তিনি একজন খাঁটি ও দৃঢ় বিশ্বাসী মুসলমানে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্য মুসলমানগণ তাঁকে পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারেন নি। ফলে হিজরতের সময় গুহাতে রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর সাথী, প্রাথমিক সময়কার মুসলমান ও অন্যান্যদেরকে মুসলমান হতে উদ্বুদ্ধকারী এবং রাসূলুল্লাহ্ (দ:) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ইমাম হযরত আবু বকর (রা:)-এর সমকক্ষ আর কেউই ছিলেন না। সবাই তাঁর পক্ষে রায় দেবেন এটাই ছিল নিশ্চিত। উপরন্তু, যেহেতু খলীফা নির্বাচনে সকল সাহাবা ঐক্যবদ্ধভাবে সমর্থন করাটা ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেহেতু আনসার সাহাবাদের নিজেদের মধ্যে খলীফা নির্বাচনের প্রচেষ্টা বিশৃংখলার জন্ম দিতো। অতএব, হযরত আবু বকর (রা:) ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এই বিপদকে মোকাবেলা করে মুসলমান সমাজকে মহা একটা ফিতনা থেকে রক্ষা করেন।
এই সময় হযরত আলী (ক:) তাঁর স্ত্রী হযরত ফাতেমা (রা:)-এর ঘরে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবু বকর (রা:)-এর মেয়ের জামাই যুবাইর, মিকদাদ, সালমান, আবু যর এবং আম্মার ইবনে ইয়াসের প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-গণও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের এজতেহাদ তৃতীয় দলটির সাথে মিলে যায়। তাই হযরত আব্বাস (রা:) হযরত আলী (রা:)-এর কাছে এসে হাত বাড়িয়ে তাঁর খেলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু হযরত আলী (ক:) ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছিলেন যে হযরত আবু বকর (রা:) খলীফা হয়ে গিয়েছেন, তাই তিনি এই প্রস্তাব অস্বীকার করেন। আবু সুফিয়ান (রা:) বলেন, “আপনার হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আনুগত্য স্বীকার করবো। যদি আপনি ইচ্ছা করেন, তবে আমি সর্বত্র অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেবো।” হযরত আলী (ক:) এ প্রস্তাবকেও নাকচ করে দেন এ কথা বলে, “ওহে আবু সুফিয়ান! ইসলামী জাতির মধ্যে কি আপনি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চান?”
অতএব, এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে মুসলমানদের মধ্যে একটা সম্ভাব্য ফিতনা বা বিবাদের ব্যাপারে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) ও হযরত আলী (ক:) উভয়ই শংকিত ছিলেন। প্রথমাবস্থায় সাকিফার ঝোপ-ঝাড়ের আশ্রয়কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে না ডাকার কারণে হযরত আলী (ক:) একটু ব্যথিত হয়েছিলেন। হযরত মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী (রহ:)-এর “মুসামারাত” গ্রন্থে এবং হামিদ বিন আলী ইমাদী (১৭৫৭ খৃষ্টাব্দ)-এর “দাও’উস্ সাবাহ্” গ্রন্থে কৃত ব্যাখ্যানুযায়ী, হযরত আবু উবায়দা (রা:) হযরত আলী (ক:) যে ঘরে অবস্থান করছিলেন, সেখানে গমন করেন। হযরত আবু বকর (রা:) ও হযরত উমর (রা:) কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত বক্তব্য-বিবৃতি তিনি হযরত আলী (ক:)-এর কাছে বর্ণনা করেন [এ সকল দীর্ঘ ও কার্যকর ভাষণ ’কাসাসে আম্বিয়া’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে]। হযরত আলী (ক:) সেগুলো মনোযোগ সহকারে শোনেন। এ সব বক্তব্য এতো আকর্ষণীয় ছিল যে, তা তাঁর মজ্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুভূতি তিনি লাভ করেন। তিনি বল্লেন,“ওহে আবু উবায়দা! খলীফা হওয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা ’আমর-ই-মা’রূফ’ (সৎ কাজের আদেশ)-এর প্রতিবাদ করার জন্যে অথবা কোনো মুসলমানকে সমালোচনা করার খেয়ালে আমি এ ঘরের কোণায় বসি নি। রাসূলে খোদা (দ:)-এর বিচ্ছেদ জ্বালায় আমার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে এবং আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছি।” পরবর্তী সকালে তিনি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে সবাইকে অতিক্রম করে হযরত আবু বকর (রা:)-এর কাছে গিয়ে আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তার পর বসে পড়েন। খলীফা তাঁকে বলেন, “আপনি আমাদের কাছে পবিত্র ও সম্মানিত। যখন আপনি রাগান্বিত হন, তখনো আল্লাহকে ভয় করেন। যখন আপনি খুশি হন, তখন খোদা তা’লাকে ধন্যবাদ জানান। আল্লাহ্ প্রদত্ত পদমর্যাদার অতিরিক্ত কিছু দাবি যে ব্যক্তি করেন না, তিনি কতো মহান ও সৌভাগ্যবান! আমি খলীফা হতে চাই নি। তবু আমাকে তা গ্রহণ করতে হয়েছে পাছে কোনো ফিতনা জাগ্রত হয়। এ দায়িত্ব পালনে আমার বিশ্রাম নেই। আমার ওপর একটা ভারী বোঝা ন্যস্ত করা হয়েছে। এটা বহন করা শক্তি আমার নেই। আল্লাহ্ আমায় শক্তি দান করুন! আল্লাহ্ তা’লা আপনার কাঁধ থেকে এই বোঝা নামিয়ে দিয়েছেন। তাই আপনাকে আমাদের প্রয়োজন। আমরা আপনার শ্রেষ্ঠত্ব ও উন্নত গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।”
হযরত আলী (ক:) ও যুবাইর (রা:) বলেন যে, খেলাফতের জন্যে হযরত আবু বকর (রা:) অন্যান্যদের চেয়ে অধিক যোগ্য ছিলেন। তাঁরা আরো বলেন যে খলীফা নির্বাচন সম্পর্কে তাঁদেরকে না জানানোর জন্যে তাঁরা প্রথমাবস্থায় দুঃখিত হলেও পরে তাঁরা এর দরুণ অনুতপ্ত হন। খলীফা তাঁদের ক্ষমা করেন। অতঃপর হযরত আলী (ক:) মসজিদে নববী থেকে প্রস্থানের অনুমতি চেয়ে উঠে দাঁড়ান। হযরত উমর ফারুক (রা:) তাঁকে বিনয় সহকারে বিদায় দেন। বিদায় নেয়ার মুহূর্তে হযরত আলী (ক:) বলেন, “আমার এখানে আসায় দেরি হওয়াটা খলীফার বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে নয়; আর এখন এখানে আসাটাও ভয় হতে নিঃসৃত নয়।” সকল হাশেমী হযরত আলী (ক:)-এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে খলীফার আনুগত্য স্বীকার করে নেন। ফলে একটা মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
খেলাফত নির্বাচনের পুরো সময় হযরত আবু বকর (রা:) ও হযরত আলী (ক:) উভয়ই অত্যন্ত তৎপর এবং জ্ঞানসমৃদ্ধ ভূমিকা পালন করেন। সাকিফার ঝোপ-ঝাড়ের আশ্রয় কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সভায় সেই দিন হযরত আলী (ক:)-কে না ডাকাটাই সৌভাগ্যময় ছিল। কেননা, তিনি যদি সেই দিন ওখানে থাকতেন, তবে হাশেমীদের অংশগ্রহণ দ্বারা আনসার ও মুহাজিরদের তর্ক-বিতর্ক দ্বিগুণ আকার ধারণ করতো, যার দরুন পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যেতো। খেলাফত নির্বাচন সংক্রান্ত এজতেহাদগত পার্থক্য সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য করা উচিৎ নয়। সাহাবায়ে কেরাম হলেন শ্রেষ্ঠ মুসলমান। তাঁদের প্রত্যেকেই নক্ষত্র সমতুল্য যা মানুষদেরকে হেদায়াত দানে সক্ষম । তাঁদের কাছ থেকেই কুরআন মজীদের অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকেই শত-সহস্র হাদীস শ্রুত হয়েছে। আর তাঁদের মাধ্যমেই আল্লাহ্ তা’লার আদেশ-নিষেধ শিক্ষা করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে তাঁদের আচরণ যাচাইয়ের মানদণ্ড বানানো আমাদের জন্যে অশোভনীয় হবে। হ্যাঁ, ভুল করা মানুষেরই স্বভাব। মুজতাহিদগণও ভুল করতে পারেন। কিন্তু মুজতাহিদগণ ভুল করলেও সওয়াব পেয়ে থাকেন; ভুল না করলে দশটি এবং ভুল করলে একটি সওয়াব পান।
প্রত্যেক সাহাবী-ই দ্বীন ইসলামের স্তম্ভ। তাঁদের মধ্যকার মতভেদসমূহ তাঁদের এজতেহাদ হতে নিঃসৃত ছিল। একে অপরকে সমালোচনা করলেও তাঁরা একে অপরের মূল্যায়ন-ও করতেন। যদি হযরত যুবাইর (রা:) তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে ব্যক্তিগত পছন্দকে অগ্রাধিকার দিতেন, তাহলে তিনি তাঁর শ্বশুর হযরত আবু বকর (রা:)-এর সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন না। খেলাফত নির্বাচনে হযরত আবু বকর (রা:)-এর সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থক ছিলেন হযরত ওমর ফারুক (রা:)। আবার তিনি-ই হযরত আলী (ক:)-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। একদিন তিনি হযরত আলী (ক:)-কে একটা প্রশ্ন করেন এবং হযরত আলী (ক:) তার উত্তর দেন। এতে হযরত উমর ফারুক (রা:) বলেন, “হযরত আলী (ক:)-এর অনুপস্থিতিতে জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া থেকে আমি আল্লাহর হেফাযত চাই।” হযরত আলী (ক:) সব সময় বলতেন, “রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর পরে এই উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে উপকারী হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) এবং হযরত উমর ফারুক (রা:)।”
খেলাফত নির্বাচনের এক মাস পরে হযরত আবু বকর (রা:) মিম্বরে আরোহণ করেন এবং বলেন, “আমি এই খলীফার দায়িত্ব হতে পদত্যাগ করতে চাই। যদি রাসূলে খোদা (দ:)-এর পদাংক অনুসরণ করতে আমাকে তোমরা দেখতে চাও, তবে তা সম্ভব নয়। কারণ, শয়তান তাঁর কাছে আসতে পারতো না। উপরন্তু, তাঁর প্রতি ওহী (ঐশী প্রত্যাদেশ) নাযেল হতো।” প্রিয় পাঠক! এ ধরনের মহান ব্যক্তিত্বদের হৃদয়ে কি রাষ্ট্রীয় পদ ও ক্ষমতার মোহ বিরাজ করতে পারে? তাঁদের প্রতি বিষোদগার করা কি কোনো জিহ্বার পক্ষে শোভনীয়?
প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, হযরত ফাতেমা যাহরা (রা:) তাঁর পিতার বিচ্ছেদ বেদনায় এতোই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে তিনি ঘর থেকে বেরুতে পারেন নি। এমতাবস্থায় হযরত আলী (ক:)-কেও বাসায় থাকতে হয়েছে তাঁকে শান্ত্বনা দেয়ার জন্যে। তাই তিনি ঘন ঘন খলীফার সোহবতে যেতে পারেন নি। তবে হযরত ফাতেমা (রা:)-এর বেসালপ্রাপ্তির পরে তিনি খলীফার দরবারে গমন করতেন এবং তাঁকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন।
’কাসাসে আম্বিয়া’ হতে উদ্ধৃত উপরোক্ত ঘটনাবলীর বর্ণনা প্রমাণ করে যে হযরত আলী (ক:) ও অপর ছয় জন সাহাবী হযরত আবু বকর (রা:)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন নি মর্মে শিয়া অভিযোগটি ভিত্তিহীন। হযরত আবু বকর (রা:)-কে না মেনে সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্যের বিরোধিতা করা ও এ সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করা শুধু ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণই নয়, বরং তা সাহাবায়ে কেরামকে প্রদত্ত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর এই আদেশটিরও খেলাফ যা ঘোষণা করে- “ঐক্যবদ্ধ হও এবং মতবিরোধ এড়িয়ে চলো” (আল হাদীস)। হযরত আলী (ক:) ও ছয়জন সাহাবী এবং নারীকুল-শ্রেষ্ঠ মা ফাতেমা যাহরা (রা:) এই আদেশ মান্য করেন নি ও দ্বীন ইসলামকে অমান্য করেছেন বলাটা তাঁদেরকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ তো নয়ই, বরং তাঁদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপপ্রয়াসই। তাঁদের প্রতি আরোপিত এই বিতর্ক এতোই মারাত্মক যে এটা দ্বীন ইসলামের মধ্যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে এবং পৃথিবীর অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত আগত লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে বিচ্যুতির অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আহলে সুন্নাতের সাথে মতভেদ সৃষ্টি করে যারা লক্ষ লক্ষ মুসলমানের রক্ত ঝড়িয়েছে এবং ইসলামের ক্ষতি সাধন করেছে কেবল হুরুফী শিয়াদের এই মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনী পড়ে, তারা-ই দ্বীন ইসলামের অগ্রগতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। আহমদী ও কাদিয়ানী সম্প্রদায় দ্বীনের যে ক্ষতি সাধন করেছে তা তো সবার সামনেই দৃশ্যমান। দ্বীন ইসলামের জ্ঞানের আলো দ্বারা উদ্ভাসিত ও ঈমান দ্বারা পূর্ণ হৃদয়সম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে কি এ কথা বলা সম্ভব যে হযরত আলী (ক:)-ই এই মহা ফিতনা-ফ্যাসাদের একমাত্র কারণ।

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This
Previous Post
Next Post

0 comments: