Sunday, October 18, 2015

কারবালা বিপ্লব-১

হিজরী ৬০ সালের কথা ৷ কয়েক দিন মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে, এজিদ তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ৷ মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজসিংহাসন ঘিরে চলছে আনন্দ ফুর্তি এবং উত্স্বের সমারোহ ৷ কিন্তু এজিদের চোখে মুখে চিন্তার ছায়া, দৃষ্টির গভীরে লুকিয়ে থাকা উদ্বেগের নিশানা মাঝে মধ্যেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশের প্রচ্ছন্ন চাঁদের মত প্রকাশিত হচ্ছে ৷ প্রয়াত বাবার সতর্কবাণী ঘন ঘন তাকে আঘাত করে চলেছে ৷ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আমিরে মুয়াবিয়া এজিদকে চারজন ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছিলেন, এদের মধ্যে তিনজনকে তুমি ছলচাতুরী, লোভ কিংবা হুমকি দিয়ে বাগে আনতে সক্ষম হলেও হোসাইন বিন আলীকে তুমি তা পারবে না কারণ হোসাইন প্রতিপালিত হয়েছে এক পবিত্র পরিবেশে, স্বয়ং বিশ্বনবীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ৷

অপরদিকে মদিনা শরীফের প্রশাসক ওলিদ তার খাস কামরায় বসে নানা চিন্তায় মশগুল ছিল ৷ এমন সময় কাসেদ এসে এজিদের একখানি পত্র ওলিদের কাছে হস্তান্তর করলো ৷ তাতে লিখা ছিল, ‘এজিদ ইবনে মোয়াবিয়ার পক্ষ থেকে মদিনার প্রশাসক ওলিদ ইবনে ওতবার প্রতি.........৷ আপনাকে অবহিত করা হচ্ছে যে, আমিরে মুয়াবিয়া ইহধাম ত্যাগ করেছেন এবং মৃত্যুর পূর্বে তিনি আমাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছেন ৷ আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে হলেও মদিনার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিশেষ করে হোসাইন বিন ‍আলীর আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে হবে ৷
নির্দেশ পাবার পর মদীনার শাসক ওলীদ ইবনে ওতবা ইমামকে তার গৃহে দাওয়াত করে যখন মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর এবং এজিদের চিঠির প্রসঙ্গ টেনে বললো তার আনুগত্য স্বীকার করে নিতে,তখন ইমাম বলেছিলেন যে 'তুমি তো নিশ্চয়ই চাও যে আমি গোপনে নয় বরং সর্বসমক্ষে তার বাইয়াত গ্রহণ করি ?' ওলিদ বেশ আনন্দের সাথে বলেছিল-'হ্যাঁ,ঠিক তাই' ৷ ইমাম হোসাইন ( আ ) তখন বলেছিলেন ,'তাহলে কাল আমি লোকজন নিয়ে তোমার কাছে আসি ৷' একথা শুনে নবী পরিবারের প্রকাশ্য শত্রু মারওয়ান ইবনে হাকাম হাঁক মেরে বললো 'হে ওলীদ ! হোসাইনকে যেতে দিও না ৷ তাহলে তার আর নাগাল পাবে না ৷ এখানেই তার শিরোচ্ছেদ করো ৷' হোসাইন ( আ ) বললেন , 'কাকে তুমি ভয় দেখাচ্ছো ৷ নবী পরিবারের কেউই কোনোদিন ‍এজিদের মতো একজন ফাসেকের বাইয়াত গ্রহণ করতে পারে না ৷ একথাটাই কাল সকালে জনগণের সামনে পুনরাবৃত্তি করতে চাই আমি ৷' এই বলে শান্ত চিত্তে তিনি ওলীদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ৷

সুনসান নিরব নিস্তব্ধ রাতে ইমাম হোসাইন ( আ ) গেলেন পূত-পবিত্র একটি জায়গায় ৷ জায়গাটি আর কিছু নয়, তাঁরই প্রিয় নানা রাসূলে খোদা ( সা ) এর মাযার ৷ বিনীত শ্রদ্ধাময় প্রশান্ত অনুভূতি নিয়ে তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন , 'হে আল্লাহর রাসূল ( সা ) ! আমি তোমার প্রিয়তম কন্যা ফাতেমা ( সা ) র সন্তান হোসাইন ৷ একজন অত্যাচারী বর্তমানে চাচ্ছে আমি যেন তার বাইয়াত গ্রহণ করি ৷ কিন্তু এ কাজ আমি কক্ষনোই করবো না.........৷ কারণ এ কাজ তোমার সম্মান ও মর্যাদার সম্পূর্ণ বিরোধী ৷'

ইমাম ফজরের নামায রাসূলে খোদার পবিত্র মাযারের পাশেই আদায় করলেন ৷ ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠলো মদীনা ৷ মদীনার সূর্যালোক হোসাইনের জন্যে ব্যাপক স্মৃতিবহ ৷ তাঁর মনে পড়ে যায় , নবীজী ( সা ) তাঁকে এবং তাঁর ভাই হাসানকে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে যেতেন এবং মিম্বারে বসে তিনি বলতেনঃ ' হাসান এবং হোসাইন হলো বেহেশতে যুবকদের সর্দার ৷' সেই মদীনার দিকে ইমাম হোসাইন তাঁর শেষ দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন ৷ দিনটি ছিল হিজরী ৬০ সালের রজব মাসের আটাশ তারিখ ৷

ইমাম হোসাইন ( আ ) তাঁর স্বজন-পরিজনদের সঙ্গে নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন ৷ রওনাকালে তিনি তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনে হানিফার উদ্দেশ্যে একটি অসিয়্যতনামা লিখলেন ৷

ঐ অসিয়্যতনামায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তাঁর রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠানোর পর লিখেছেনঃ
 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ৷ এটি হোসাইন ইবনে আলীর অসিয়্যত ৷ আমি এখন মদীনা ছেড়ে যাচ্ছি ৷ আমার এই মদীনা ত্যাগ শান্তির অন্বেষায় নয় , না কোনো ভয়-ভীতির কারণে ৷ বরং আমার এই সফরের উদ্দেশ্য হলো আমার নানাজী হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) এর দ্বীনের সংস্কার করা ৷ আমি যেখানেই থাকি না কেন , জনগণকে সত্যের পথে ন্যায়ের পথে আসতে অনুপ্রাণিত করবো এবং অন্যায় ও অসত্‍ পথে ধাবিত হওয়া থেকে বিরত রাখবো ৷'

মক্কায় ইমাম হোসাইন ( আ ) এর সপরিবার আগমন-বার্তা প্রচার হয়ে গেল ৷ মক্কাসহ বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা ইমামকে আরেকবার দেখার জন্যে ছুটে আসতে লাগলো ৷ ইমামের পবিত্র চেহারা ছিল নানা নবীজীর চেহারার মতো আর বক্তব্যও ছিল তাঁরই মতো ৷ তাই ইমামকে দেখলে কিংবা তাঁর বক্তব্য শুনলে রাসূলের ( সা ) কথা , রাসূলে খোদার চেহারা সবার কল্পনায় ভেসে উঠতো ৷ ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণে ইমামের অস্বীকৃতির খবর জনগণকে তাঁর প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট করেছিল ৷ বিশেষ করে ইয়াযিদের শাসন স্বেরাচারী শাসন , তার শাসনের সাথে আল্লাহর আইনের কোনো সম্পর্ক নেই-এই মর্মে তাঁর কাছে কুফা থেকে অসংখ্য চিঠি এবং বার্তাবাহক আসতে শুরু করলো ৷
কুফার লোকজন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি সোলায়মান ইবনে সারাদ এর বাসায় এসে সমবেত হয় এবং সোলায়মান তাদের কাছ থেকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে ,তারা হোসাইন ইবনে আলীর সহযোগিতায় বিশ্বস্ততার পরিচয় দেবে ৷ সবাই একবাক্যে স্বীকার করলোঃ 'ইমামের সন্তান ইমাম হোসাইন ইবনে আলীকে সার্বিক সহযোগিতা করবো ৷'

ইমাম প্রথম প্রথম এইসব চিঠির কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না ৷ কিন্তু চিঠির সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছে গেল ৷ জনগণ ইয়াযিদের অত্যাচার আর কপটতার ব্যাপারে তাঁর কাছে অভিযোগ করতে লাগলো ৷ তাই তিনি শেষপর্যন্ত ভাবলেন যে জনগণকে সাহায্য করার ব্যাপারে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে ৷ এই কর্তব্য বোধ করেই তিনি প্রথমে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্যে তাঁর দূত হিসেবে মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠালেন ৷ সে সময় কুফায় আঠারো হাজার মানুষ মুসলিমের আনুগত্য স্বীকার করে ৷

কিন্তু ইয়াযিদ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে রক্তপিপাসু ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে কুফার শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় ৷ তার নিয়োগের ফলে কুফায় থমথমে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ৷ শহরের পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যায় ৷ কুফার প্রতিশ্রুত অধিবাসীরা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে হোসাইন ( আ ) এর দূত মুসলিমকে একাকী রেখে চলে যায় ৷ অবশেষে মুসলিম শহীদ হন ৷*

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This
Previous Post
Next Post

0 comments: