মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত প্রানী তার একটা কারন হল সেই একমাত্র প্রানী যে তার জ্ঞান মস্তিষ্কের বাইরেও ধরে রাখতে পারে। সে তার মনের চিন্তাকে অক্ষর নামের একটা জিনিস দিয়ে কাগজে লিখে রাখতে পারে, সেটাকে বই বানিয়ে পড়তে পারে। একটা বই একটা জানালার মতন। লেখক তাঁর মস্তিষ্কের একটা জানালা খুলে আপনাকে তাঁর চিন্তাগুলো দেখতে দেন, লেখক তাঁর অনূভুতি চিন্তাগুলোকে আপনার মস্তিষ্কে ট্রান্সফার করে দেন। প্রত্যেকটি মানুষের আবেগ আলাদা আলাদা। যেই লেখকের আবেগ আপনার আবেগকে স্পর্শ করবে, আপনার ভিতরে নানারকম অনূভুতি সৃষ্টি করবে, আস্তে আস্তে সেই লেখক আপনার প্রিয় হতে থাকবেন। আপনার প্রিয় লেখককে হয়ত আপনি জীবনেও দেখেননি, কিন্তু তাঁর লেখা পড়লেই আপনার মনে হয় তিনি আপনার সাথে কথা বলছেন, তিনি আপনার একজন আপনজন। বইয়ের এই অসাধারন কারনগুলোর কারনেই তথ্যপ্রযুক্তির এই শীর্ষযুগেও এখনো মানুষ বই পড়ে, বই কিনে, বইয়ের পাতার ঘ্রান নেয়, বই পড়ে হাসে, কাঁদে।
সাড়ে ১৪০০ বছর আগে পৃথিবীতে একটা বই এসেছিল যেটা কোন মানব সাহিত্যিক রচনা করেনি। সেটা আসলে বই হিসেবে আসেনি, সেটা এসেছিল "কথা" হিসেবে। এই কথাগুলোকে মানুষ কাগজে লিখে রাখার পর যে বইটা তৈরী হয় সেটার নাম কুর'আন। এই বইয়ে আল্লাহ্ মানুষের সাথে কথা বলেছিলেন, তাঁর কথাগুলো উচ্চারন করতেন তাঁরই মানবদূত মুহাম্মাদ(স) . এই কথাগুলো এসেছিল মহাজগতের বাইরে থেকে, এটা ছিল স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে একটি অকল্পনীয় যোগাযোগ। মহাবিশ্বের বাইরে জীবনের অস্তিত্ব আছে কিনা এ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের কোন শেষ নেই। মানুষ জানতে চায়-"এই গ্যালাক্সি বা এই মহাবিশ্বের বাইরেও কি জীবন আছে?" উত্তর হচ্ছে- হ্যা। যিনি এই মহাবিশ্ব বানিয়েছেন তিনি জীবিত, তিনি দেখেন, তিনি শোনেন, আর তিনি আমাদের সাথে কথাও বলেছেন। এই কথা হচ্ছে কুর'আন। আপনি শুধু এই জিনিশটা নিয়ে চিন্তা করুন কিছুক্ষন। কুর'আন কোন মানুষ, নাবি, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, ফেরেশতা...কারোর কথা না। এটা তাদের স্রষ্টার কথা। তাই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রানী হিসেবে মানুষের প্রথম কাজ হচ্ছে জানার চেষ্টা করা স্রষ্টা তাঁকে কি মেসেজ দিয়েছেন, কেন দিয়েছেন।
কুর'আনের ক্ষমতাটা আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। মনে করেন, আজকে নাসা-র স্পেস স্টেশনে কয়েক আলোকবর্ষ দূরের একটা গ্রহ থেকে কিছু দূর্বোধ্য কোড এল। সেই কোড পড়ে বিজ্ঞানীদের মাথা খারাপ হয়ে গেল। এটা এসেছে একটি এলিয়েন জাতির কাছ থেকে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমাদের চেয়ে ১ কোটি বছর এগিয়ে। তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চায় ও আমাদেরকে তাদের অকল্পনীয় সব প্রযুক্তি শিখিয়ে দিতে চায়। সারা পৃথিবীতে হুলুস্থুল কান্ড শুরু হয়ে গেল সাথে সাথে। সৃষ্টির স্মরনকালের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে এটা। তখন কেমন লাগত আমাদের? সম্মানিত, বিনীত, উত্তেজিত? মহান কোন জাতি আমাদের সাথে কথা বলেছে বলে আনন্দিত , শিহরিত ?
এবার ফোকাসটা এলিয়েন এর উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে আসুন মহাজগতের স্রষ্টার উপর। তিনি কোন এলিয়েন নন, তিনি আল্লাহ্, সকল প্রানের স্রষ্টা। একটু চেষ্টা করুন চিন্তা করতে যে এখন আপনার কেমন অনূভুতি হয়। এই অনূভুতির দরকার আছে। কারন এটাই একজন মুসলিমের অনূভুতি, এটাই হচ্ছে কুর'আন। এটা সরাসরি আল্লাহর কথা, যিনি আমাদের ডিজাইন করেছেন, যিনি Life , Time , Space নামের অকল্পনীয় জটিল জিনিসগুলো বানিয়েছেন। তিনি-ই কথা বলেছেন আমাদের সাথে। তিনি আমাদের মেসেজ পাঠিয়েছেন যাতে আমরা সেটা পড়ি, বুঝি, অনুধাবন করি। একজন মুসলিম ঠিক এরকমটাই মনে করে যখন সে কুর'আন পড়ে। সে আল্লাহর কথা শুনতে পায়। প্রত্যেকটি মুসলিম জানে তাঁর সাথে আল্লাহর একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, যে সম্পর্ক আমার জন্য ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
২৩ বছর ধরে পৃথিবীতে এমন একটা সময় এসেছিল যা পৃথিবী আর কোনদিন দেখবে না। ২৩ বছর ধরে স্রষ্টা পৃথিবীর সাথে স্বর্গের একটা জানালা খুলে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর কথাগুলো, চিন্তা ও আবেগগুলো পাঠিয়েছিলেন সম্মানিত স্বত্বা জীবরিল(আ) কে দিয়ে পৃথিবীর বুকে। মহান আল্লাহ্ তাঁর জ্ঞান অনুযায়ী তাঁর সময়মত তাঁর কথাগুলো পাঠিয়েছিলেন, যেই বাক্যটা যেখানে প্রয়োজন ঠিক সেখানেই তিনি দিয়েছেন, যে সূরাটা যেখানে থাকার কথা ঠিক তেখানেই আছে। কেমন ছিল সেই দিনগুলো যখন স্রষ্টা সরাসরি কথা বলতেন মানুষের সাথে ??? What amazing days those must have been when God spoke to man? Days of a direct connection between the Divine and man. The Qur'an is the link that still remains.
যে সময়ে কুর'আন নাযিল হয়, সে সময়ে আরবে লেখাপড়ার চল ছিল না। নাবি মুহাম্মদ(স)-ও ছিলেন নিরক্ষর। তাদের প্রধান সাহিত্য ছিল মুখে মুখে কবিতা রচনা। এগুলো সবই ঐতিহাসিক তথ্য। খুব অদ্ভূত একটা ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহ্ প্রথম যে কথাটি সেই নিরক্ষর সমাজে পাঠালেন সেটা ছিল-
" ইক্বরা বিসমি রাব্বী কাল্লাযী খ্বালাক"- পড় ! তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।
যে সমাজে পড়াশুনার চল নেই, সেখানে আল্লাহ প্রথম আদেশটি দিলেন পড়াশুনা করার জন্য। এরচেয়েও অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে, রাসূল(স) পুরো কুর'আন শিখেছিলেন শুনে শুনে ! আল্লাহ্ তাঁকে বলতে পারতেন- "শুনো, তোমার প্রভুর নামে" . সেটা আল্লাহ্ করেননি। আল্লাহ্ বললেন- পড়। কেন?!
আল্লাহ্ চেয়েছেন আমরা পড়াশুনা করি, আমরা জ্ঞান আহরন করি। সত্যি সত্যিই মুসলিমরা তাই করলেন তারপর থেকে। আল্লাহর দেওয়া কথাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা এরপর কয়েকশ বছর ধরে শাসন করে ফেললেন পুরো পৃথিবী। আবিষ্কার করলেন ক্যামেরা, দাবা, প্রসাধনী, সেচ-কাজ, ইঞ্জিন, সার্জিকাল যন্ত্র, অ্যানেসথেসিয়া, ফাউন্টেন পেন, নাম্বারিং সিস্টেম, এলজেবরা, ত্রিকোনমিতি, কার্পেট, ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, হাসপাতাল, কোমল পানীয়, প্লাস্টিক সার্জারী, ক্যালিগ্রাফী, আধুনিক রসায়ন( জাবির ইবন হাইয়ান), রবোটিক্স ( আল-জাযারি)...সহ অগনিত আবিষ্কার। জন্ম নিলেন শ্রেষ্ঠতম কিছু স্কলার। ইসলামের বানী ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর আনাচে কানাচে। সেই স্বর্ণযুগ আর নেই এখন। মুসলিমরা এখন নিপীড়িত, শোষিত। কিন্তু আগুন থেমে গেলেও যেমন আগুনের উৎস কাঠকয়লা রয়ে যায়, তেমনি মুসলিমদের সাফল্যের উৎসটা এখনো আছে। সেই বইটাই। কুর'আন। অবিকৃত, প্রত্যেকটি শব্দ। অবিকৃত ছিল, এখনো আছে, সামনেও থাকবে।
কারন আল্লাহ্ বলেছিলেন-
" অবশ্যই, আমিই কুর'আন নাযিল করেছি; আর আমিই এটা সংরক্ষণ করব, কোন সন্দেহ নেই" [http://quran.com/15/9]
তিনি তাই করলেন। কিভাবে করলেন সবাই জানে। কাগজ-কলম কিচ্ছু লাগল না। তাঁর কথা মানুষ মুখস্থ করে ফেলল কথা হিসেবেই। একজন নয়, দুইজন নয়। কোটি কোটি মানুষ। একই সিরিয়ালে, একই উচ্চারনে পর্যন্ত ! এটা না গদ্য, না পদ্য। প্রচলিত আরবি গ্রামার না। কেমন জানি অদ্ভূত ছন্দ লাইনে লাইনে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বই আর একটিও কখনো আসেনি। This is what happens when the Creator of the Universe is the Author.
সূরা নূর ২৪ নম্বর সূরা। এই সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতকে বলা হয় আয়াত আল নূর ( The Verse of Light). এখানে আল্লাহ্ তাঁর নিজের নূরকে একটা দৃশ্যের সাথে উপমা করেছেন। আমি চেষ্টা করেছি দৃশ্য এবং উপমা দুটোই ছবিসহ তুলে ধরার। আয়াতটাকে আমি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিয়েছি ব্যখ্যা করার সুবিধার জন্য। মানুষ কল্পনা করতে পারে, মানুষ বাহ্যিক চোখ ছাড়াও মনের চোখ দিয়ে অনেক কিছু দেখতে পারে, বুঝতে পারে। এই আর্টিকেল টা পুরো উপলব্ধি করতে হলে আপনার মনের চোখগুলোও একটু ব্যবহার করতে হবে। এটা হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া উপমা আর সাহিত্য। আপনি নিজেই বুঝবেন এটা কতটা শক্তিশালী সাহিত্য।
আয়াত আল-নূরঃ
[ اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ ۖ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ ۖ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِن شَجَرَةٍ مُّبَارَكَةٍ زَيْتُونَةٍ لَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ ۚ نُّورٌ عَلَىٰ نُورٍ ۗ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ ۗ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ]
[ http://quran.com/24/35]
[১]
"আল্লাহু নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্ "
Allah is the Light of the heavens and the earth
আল্লাহ্ হচ্ছেন স্বর্গ ও পৃথিবীর নূর/আলো।
আলো ছাড়া কোনকিছু দেখা যায় না। যখন কোন বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের রেটিনাতে পড়ে, তখন-ই আমরা সেটাকে দেখতে পাই। আলো হচ্ছে আমাদের "দেখার মাধ্যম" বা Means . আমাদের চোখে আলো না পড়লে আমরা কিছুই দেখতে পেতাম না। Perception of Vision= Light , দেখা= আলো। বাংলায় বলা হয় - " তার চোখের আলো/ জ্যোতি নিভে গেছে" - মানে সে অন্ধ হয়ে গেছে।
আল্লাহ্ এখানে বলছেন, আমরা যা কিছু দেখি, সব একমাত্র আল্লাহর কারনে। কারন তিনি হচ্ছেন "দেখার মাধ্যম" বা "নূর" . আমাদের চিন্তার জগত আর কল্পনার জগত পৃথিবী আর আকাশ আর মহাজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা এর বাইরে কিছু দেখতে, চিন্তা করতে, কল্পনা করতে পারি না। কারন আমরা মহাজগতেরই একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশ। Heaven & Earth দিয়ে মানুষের ক্ষুদ্র সীমারেখা বুঝিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ যে - এর চেয়ে বেশি আমাদের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব না।
ধরুন মাঝরাতে আপনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আপনি আবছা অন্ধকারে দেখলেন আপনার খাটের পাশে একটা ভয়ঙ্কর জন্তু বসে আছে। আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে আপনি বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে হেসে ফেললেন। মেঝেতে আপনার কম্বলটা স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। আপনি দেখেছেন, কিন্তু ভুল দেখেছেন। Your perception of light was wrong first. Then with real light, you understood the truth. প্রথমেও আপনি একটা কম্বল দেখেছেন, লাইট জ্বালিয়েও আপনি সেই একই জিনিস দেখেছেন। অথচ এই দুই দেখার মধ্যে ছিল আকাশ পাতাল পার্থক্য।
যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে, সে জানে যে সবকিছুর মূলে আছেন আল্লাহ্; সব ক্ষমতার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্; আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমরা পারি। এই বিশ্বাস নিয়ে যখন সে সবকিছু দেখে, সে সত্যিকার জিনিসটা দেখতে পায়। এটা হচ্ছে আসল দেখা,এটা হচ্ছে সত্যিকারের আলো। আল্লাহর প্রতি তাঁর এই ঈমানই তাঁকে প্রকৃত সত্যটা দেখতে ও বুঝতে সাহায্য করে।
যে আল্লাহ-কে বিশ্বাস করেনা, সে যাই দেখে সেটা নিয়ে শুধুই যুক্তি দাড়া করানোর চেষ্টা করে। সে বিগ ব্যাং থিওরি নিয়ে লাফায়, ডারউইনের মতবাদ নিয়ে লাফায়, বিশ্বজগত যে এমনি একদিন "হঠাৎ" করে এসে গেছে এগুলো নিয়ে তর্ক করে। সে-ও পৃথিবীর সবকিছু দেখে আর সবার মতই, কিন্তু তার এই দেখা হচ্ছে মিথ্যা দেখা। কারন দেখার মাধ্যম হচ্ছেন আল্লাহ্, আর তার ভেতরে সেই আলোই নেই !
[২]
"মাসালু নূরিহি কামিশকাতিন ফীহা মিস্বাহ ; আল মিসবাহু ফী যুজাজা "
The Parallel of His light is like a niche within which is a lamp, the lamp is within glass
" তাঁর নূরের তুলনাটা যেন অনেকটা এরকম যে- দেয়ালের একটি খাঁজের ( niche) মধ্যে একটি ল্যাম্প ( প্রদীপ) আছে, প্রদীপটি আছে কাঁচের ভিতর।"
প্রথমে আল্লাহ্ এখানে বলে নিয়েছেন, "তাঁর নূরের তুলনাটা "অনেকটা" এরকম..." . কেন আল্লাহ্ "অনেকটা" বললেন? সত্যি কথা হচ্ছে, আমরা সসীম সৃষ্টি হিসেবে কখনোই আল্লাহকে পুরোপুরি বুঝতে পারবনা, এটা কখনো সম্ভব না। তাই আল্লাহ্ আমাদেরকে সসীম একটা তুলনা দিয়েছেন তাঁর নূরের, যাতে আমরা অন্তত সেটুকু বুঝতে পারি।
আল্লাহ্ বলেছেন, তাঁর নূরের উপমা হচ্ছে দেয়ালের মধ্যে একটি "মিশকাত" , মানে = Niche/Indent in the wall.
Niche কথাটার মানে জানতে হবে। এটা একটা পুরোন দিনের আর্কিটেকচার স্টাইল যখন ইলেকট্রিক বাতি আবিষ্কার হয়নি। দেয়ালের মধ্যে যদি কোন অর্ধগোলাকৃতি বা চৌকোনা খাঁজ থাকে সেটাকে Niche বলা হয়। এটার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেটার মধ্যে একটা মোমবাতি বা ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলে সেই আলোটা পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু কিছু মাসজিদে এখনো এই Niche দেখা যায়। Niche কে বাংলায় খাঁজ/ কুলঙ্গি বলা হয়। পুরোন দিনের বাংলা বইয়ে পাবেন- কুলঙ্গিতে প্রদীপ জ্বলছে। বোঝার জন্য আমি একটা ছবি দিলাম।
তারপর আল্লাহ্ বলেছেন, সেই খাঁজ এ একটা "মিসবাহ" আছে। [ ফীহা মিসবাহ ]
মিসবাহ= ল্যাম্প।
মিসবাহ শব্দটা এসেছে "সুবহ" থেকে। সুবহ মানে সকাল ( সুবহে সাদিক) , আর Misbah= A Tool which gives light= Lamp.
সেই ল্যাম্পটা আছে একটা কাঁচের ভিতরে। [আল মিসবাহু ফী যুজাজা]
যুজাজা= স্বচ্ছ কাঁচ, Clear Glass.
[৩]
"আযযুজাজাতুকা আন্নাহা কাওকাবুন দুর্রি-উই ইয়ু কাদু মিন শাজারাতিম মুবারকাতিন যাইতুনা লা শারকিয়্যাতিন ওয়ালা গরবিয়্যাহ "
the glass as if it were a very bright shining star ; lit from [the oil of] a blessed olive tree, neither of the east nor of the west,
" কাঁচটা ঠিক যেন একটি অত্যন্ত চকচকে উজ্জ্বল নক্ষত্র, এবং ল্যাম্পটিকে জ্বালানো হয়েছে পবিত্র জলপাই গাছের তেল থেকে। এই গাছটা পূর্বের-ও নয়, পশ্চিমেরও নয়। "
আল্লাহ্ বলছেন, সেই ল্যাম্পের কাঁচটা হচ্ছে একটা অত্যন্ত চকচকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন জ্বলজ্বলে। আরবিতে কাওকাবুন= An excessively shiny star. প্রশ্ন হচ্ছে, কাঁচের ল্যাম্প কিভাবে নক্ষত্র হয়?
আল্লাহ্ আমাদের জন্য একটা দৃশ্য তৈরী করে দিচ্ছেন এখানে। ল্যাম্পটার চারদিকে একটা কাঁচের আবরন আছে। ল্যাম্পটা যখন জ্বলে, তখন এর আলো পরিষ্কার কাঁচের উপর উজ্জ্বল কিছু প্রতিফলন তৈরী করে। এটাকে বলা হয় লেন্স ফ্লেয়ার ( Lens Flare). তখন ল্যাম্পটাকে মনে হয় একটা বড় নক্ষত্র। এই ছবিতে কয়েকটা লেন্স ফ্লেয়ার দেখান হল
এরপর আল্লাহ্ বলছেন, ল্যাম্পটাকে জ্বালানো হয়েছে একটা অত্যন্ত পবিত্র জলপাই গাছের তেল থেকে। যে তেল পূর্বেও পাওয়া যায়না, পশ্চিমেও পাওয়া যায়না। কোন গাছে যদি শুধু পূর্বদিক থেকে আলো পড়ে, তাহলে গাছের অর্ধেক অংশে বেশি আলো পড়ে, অন্য অংশে কম আলো পড়ে। পশ্চিমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই গাছটা তেমন না। এই গাছটা এমন একটা জায়গার যেখানে কখনোই আলোর অভাব হয়না।
[৪]
"ইয়া কাদু যাইতুহা ইয়ুদি~~ উ ওয়ালাও লাম তামসাসহু নার "
whose oil would almost glow even if untouched by fire.
এই তেলটা এমন যে আগুনের সংস্পর্শ না পেলেও এটা প্রায় জ্বলে উঠতে চায়।
এতক্ষন আল্লাহ্ আমাদেরকে ল্যাম্পটার কথা বলেছেন। এবার আল্লাহ্ যে বিশেষ তেল দিয়ে ল্যাম্পটা জ্বলে সেটার বৈশিষ্ট্য বলছেন। এই তেলটা খুবই দাহ্যক্ষমতাসম্পন্ন, Highly flammable. দুইরকম তেল আছে। একরকম তেল হচ্ছে কেরোসিন। আপনি দেখবেন তেলের কুপিতে কেরোসিন তেল থাকে আর একটা ন্যাকড়ার সলতে থাকে। সলতেটা আস্তে আস্তে তেল শুষে শুষে পুড়তে থাকে।এগুলো হচ্ছে কম দাহ্য ক্ষমতার তেল। কিন্তু আধুনিক তেল যেমন পেট্রল, অকটেন এগুলো হচ্ছে অত্যন্ত দাহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। এই ধরনের তেলের আশেপাশে আগুন থাকলেও এই তেলগুলো জ্বলে উঠতে পারে। আল্লাহ্ আমাদেরকে বলছেন, সেই ল্যাম্পটার তেল হচ্ছে উচ্চ দাহ্য ক্ষমতাবিশিষ্ট, আগুন ছাড়াই এটা জ্বলে উঠতে চায়, আর আগুনের সংস্পর্শে আসলে তো কথাই নেই।
[৫]
" নূরুন আলা নূর "
Light upon light.
"নূরের উপর নূর"
এতক্ষন ধরে আল্লাহ্ ল্যাম্প এর বর্ননা দিলেন। সেটার কাঁচের বৈশিষ্ট্য বললেন, সেটার তেলের বৈশিষ্ট্য বললেন। সেই ল্যাম্পটা নিজে থেকেই জ্বলে উঠতে চায়। এবার সেটার উপর এসে পড়ল আরো অনেক আলো। এটার ব্যাখ্যা আপনি নিচে পাবেন।
[৬]
ইয়াহদি আল্লাহু লিনুরিহী মাইয়্যাশা~~ ঊ ; ওয়া ইয়াদরিবুল্লাহুল আমসালা লিন্নাস; ওয়াল্লাহু বিকুল্লি শাইয়িন আলীম।
Allah guides to His light whom He wills. And Allah presents examples for the people, and Allah is Knowing of all things.
"আল্লাহ তাঁর নূরের দিকে তাঁর যাকে ইচ্ছা, বা যে তাঁর কাছে চায়, পথ দেখিয়ে দেন। আর আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা ( Parable) দেন, আল্লাহ সব ব্যাপারে সব কিছু জানেন।"
আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা তাঁর নূরের দিকে পথ দেখিয়ে দেন। এখানে একটা শব্দ আছে মাইয়্যাশা= Whoever wants + Whoever He wants. এটা একটা শর্ত। যে আল্লাহর কাছে তাঁর আলো চায় আল্লাহ তাকে অবশ্যই তা দেন। কিন্তু আগে আপনাকে চাইতে হবে। আগে আপনাকে আল্লাহর দিকে এক পা এগুতে হবে। বাকী ব্যবস্থা আল্লাহ্ অবশ্যই করে দিবেন। কিন্তু আপনি সেই এক পা টুকু না এগুলে আল্লাহ্ আপনাকে তাঁর নূরের পথ দেখাবেন না।
আয়াত আল নূর এই পর্যন্তই। প্রথমেই আল্লাহ্ বলে নিয়েছেন এটা হচ্ছে আল্লাহর নিজের নূরের অনেকটা কাছাকাছি একটা উপমা। আপনার বোঝার সুবিধার জন্য আমি উপরের কথাগুলোর আবার একটা ছোট সারমর্ম দিচ্ছি, তারপর আমি আসল ব্যাখ্যাটা দিয়ে দিচ্ছি।
সারমর্ম-
আল্লাহ্ হচ্ছেন সবকিছু দেখার মাধ্যম। তাঁর নূর হচ্ছে অনেকটা একটা খাঁজের মধ্যে রাখা একটা ল্যাম্পের মতন, যেটার চারদিকে কাঁচের আবরন আছে। কাঁচটা খুবই চকচকে উজ্জ্বল, এটার মধ্যে দিয়ে আলো প্রতিফলিত হলে ঠিক একটা নক্ষত্রের মতন দেখায়। এই ল্যাম্পটা যে পবিত্র জলপাই গাছের তেল দিয়ে জ্বলে, সেই গাছ পূর্ব পশ্চিম কোথাও পাওয়া যায়না। আর এই তেলটা এত বেশি দাহ্য যে আগুন না পেলেও এটা প্রায় জ্বলে উঠতে চায়। ল্যাম্পের আলোর উপর আরো অনেক আলো এসে পড়ল। যে আল্লাহর কাছে তাঁর নূর চায় , আর যাকে আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, তাকে তাঁর নূরের দিকে পথ দেখিয়ে দেন । তিনি সব ব্যাপারে সবকিছু জানেন।
মূল ব্যাখ্যাঃ
খাঁজ/Niche:
আমাদের সবার শরীরে একটা করে খাঁজ বা Niche আছে। এটা হচ্ছে আমাদের বুকের খাচা বা Rib-Cage. আপনি খেয়াল করলেই দেখবেন মানুষের বক্ষপিঞ্জর আর ছবির খাঁজটির মধ্যে অনেকটাই মিল আছে। আমি তুলনামূলক একটা ছবি দিয়ে দিলাম।
Lamp:
আল্লাহ্ ল্যাম্পের উপমা দিয়েছিলেন। বুকের ভিতর একটি ল্যাম্প আছে মানুষের, তা হল আমাদের হৃৎপিণ্ড ( HEART) .
কাঁচের আবরনঃ
আল্লাহ্ ল্যাম্পের বাইরে একটা কাঁচের কথা বলেছিলেন। জন্মের পর আমাদের হৃৎপিন্ডের চারপাশেও একটি স্বচ্ছ আবরন থাকে । এটার নাম হচ্ছে ফিতরাহ । ফিতরাহ হচ্ছে "আল্লাহর প্রতি মানুষের একটা সহজাত বিশ্বাস" . এটা শরীরের কোন অঙ্গ নয়, এটা একটা Abstract জিনিস। আদম(আ) কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ্ তাঁর কোমর থেকে আপনাকে আমাকে আমাদের সবাইকে বের করেছিলেন। এটা আল্লাহ্ সূরা আরাফ এ রেকর্ড করে রেখেছেন এভাবে-
"স্মরন কর, যখন তোমার রব বনী আদমের কোমর থেকে তাদের বংশধরদের বের করলেন , তারপর তাদের কাছ থেকে সাক্ষ্য নিলেন এই জিজ্ঞেস করে- আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বলল- হ্যা, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। যাতে কেয়ামতের দিন তোমরা বলতে না পারো যে, নিশ্চয়ই আমরা তো এ ব্যাপারে অনবহিত ছিলাম ( আমরা তো কিছুই জানতাম না) । " [http://quran.com/7/172-173]
প্রত্যেকটি মানুষের আত্মাতেই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ছাপ জন্মগতভাবে এঁকে দেওয়া আছে। শেষ বিচারের দিন এ ব্যাপারে কেউ কোন অজুহাত দিতে পারবেনা। প্রত্যেকটি মানুষ জানে যে তার একজন স্রষ্টা আছে, তাকে একা ছেড়ে দিলে সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস নিয়েই বড় হয়ে উঠবে। এটার নাম-ই হচ্ছে ফিতরাহ।
আমরা যখন জন্ম নিয়েছিলাম তখন এই কাঁচটি(ফিতরাহ) ছিল সম্পূর্ন পরিষ্কার, কারন প্রত্যেকটি শিশু নিষ্পাপ। আস্তে আস্তে বড়ো হতে হতে, পাপ করতে করতে আমাদের হৃৎপিন্ডের বাইরের এই কাঁচটায় ময়লা পড়তে থাকে। ময়লা পড়তে পড়তে কাঁচটা ঘোলা হয়ে যায়। কাঁচের ভেতর যে ল্যাম্পটা ( Heart) থাকে সেটার আলো আস্তে আস্তে নিবুনিবু হয়ে আসে, মলিন হয়ে আসে। সেই মলিন আলো তখন আর ময়লা কাঁচ ভেদ করে বাইরে আসতে পারেনা। আমরা আস্তে আস্তে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যাই, পার্থিব জীবনের মোহ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই, আল্লাহকে ভুলে যাই। আল্লাহর কাছে যে একদিন সাক্ষ্য দিয়েছিলাম সেটা ভুলে যাই, আল্লাহর সামনে যে একদিন আবার দাঁড়াতে হবে সেটাও ভুলে যাই। অথবা ভুলে যাওয়ার ভান করি।
পবিত্র তেলঃ
আল্লাহ্ বলেছিলেন ল্যাম্পটা জ্বলতে একটা পবিত্র তেল লাগে।আমাদের হৃৎপিন্ডের ভেতর যে পবিত্র তেলটি আছে, এর নাম হচ্ছে আমাদের "রূহ" . সেটি পৃথিবীর কোন তেল নয়, পূর্ব পশ্চিম কোন প্রান্তেই এই তেল নেই, কারন এই তেলটি আসে একমাত্র সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা আমাদের মায়ের গর্ভে আমাদের প্রত্যেকের রূহ দিয়ে যান। রূহ এর কোন প্রতিশব্দ নেই। রূহ হচ্ছে রূহ। আত্মা, সত্বা, ব্যক্তিত্ব যাই বলা হোক না কেন কোনটিই রূহ এর প্রতিশব্দ নয়। রূহ হচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব, যেটি প্রত্যেকটি মানুষের আলাদা আলাদা। পৃথিবীতে একই চেহারার বহু মানুষ আছে। কিন্তু প্রত্যেকটি মানুষের রূহ আলাদা আলাদা। এই "রূহ" হচ্ছে আমাদের আসল পরিচয়, এটার কারনেই আপনি "আপনার" মতন, আমি "আমার" মতন, আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা স্বত্বা। মানুষের শরীর মরে যায়, কিন্তু রূহ কখনো মরে না। হৃৎপিন্ডের আলো জ্বালাতে রূহ নামের এই পবিত্র তেল লাগে। আমাদের অস্তিত্বকে আলোকিত করতে হলে তেল লাগে। রূহ হচ্ছে স্রষ্টার কাছ থেকে আসা সেই তেল। রূহ হচ্ছে আলোর তৈরী, A creature of light. আল্লাহ্ প্রথমেই বলেছিলেন তিনি হচ্ছেন পৃথিবী ও স্বর্গের আলো। আল্লাহর সাহায্য(Guidance) হচ্ছে নূর/আলো। কুর'আন হচ্ছে একটি আলো যা মানুষকে আলোকিত করে।
প্রত্যেকটি মানুষের রূহের ভিতরে আলোকিত হবার ক্ষমতা আল্লাহ্ জন্ম থেকেই দিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেকটি মানুষ স্রষ্টার দিকে ফিরে আসতে পারে যেকোন মূহুর্তে। এই Potential Light আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে দিয়েছেন। এই আলোর ধর্মই হল সে জ্বলে উঠতে চায়, খালি প্রয়োজন আরেকটু আলো। যখন স্রষ্টার কাছ থেকে Guidance ( Islam, Qur'an) আসে এবং কোন মানুষ তা নিজের ভেতরে গ্রহন করে নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করে, তখন তার নিজের মধ্যে আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসতে থাকে। সে অনুভব করতে পারে যে তার ভেতরের এত বছরের জমে থাকা পাপ, ময়লা, অন্ধকার দূর হয়ে যাচ্ছে। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে স্রষ্টার দেখানো পথের আলো। এরপর আল্লাহ তাকে আরো পথ দেখান, আরো আলোর দিকে নিয়ে যান। আলোর উপর আরো আলো ফেলেন। আর এইজন্যেই আল্লাহ্ বলেছেন-
নূরুন আলা নূর- LIGHT UPON LIGHT !
মানুষ শুধুমাত্র জৈবিক একটি প্রানী নয়। আমাদের জৈবিক অংশের পাশাপাশি আমাদের একটি স্পিরিচুয়াল অংশ আছে, এটা প্রতিটি মানুষ জানে। আমাদের শরীর মাটির তৈরী তাই সেটার ক্ষুধা তৃষ্ণা ও জৈবিক চাহিদাগুলো আমরা মাটির পৃথিবী থেকেই মিটাই। কিন্তু আমাদের রূহ মাটির তৈরী না, আমাদের রূহ পবিত্র আলোর তৈরী। আমাদের রূহ এর-ও ক্ষুধা আছে, সেটা হচ্ছে নূর/আলো। শরীরকে না খেতে দিলে সে অপুষ্টিতে ভুগে। রূহকে তার প্রয়োজন না মিটালে সেও অপুষ্টিতে ভুগে। তখন তার জীবনে পার্থিব সব কিছু থাকলেও তাঁর মনে হবে , কি যেন একটা নেই, কিসের যেন একটা শূন্যতা, অতৃপ্তি। এটার নাম Spiritual Hunger. তখন মানুষ বলা শুরু করে- I feel so empty inside, I feel so hollow.
রূহের এই অতৃপ্তি ও শূন্যতা দূর করার জন্যই আমাদের সবার প্রয়োজন স্রষ্টার আলো। স্রষ্টার সেই আলো যখন আমাদের হৃদয়ের আলোর সাথে মিশে যায়, তখন আমাদের হৃদয় নক্ষত্রের আলোর মতন আলোকিত হয়। যখন দেয়ালের খাঁজের ভেতর ল্যাম্প ঠিকমতন জ্বলে, তখন আলোকিত হয় সারা ঘর। যখন রূহ এর আলো দিয়ে আমাদের অন্তর কে আমরা জাগিয়ে তুলতে পারি, আমাদের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করতে পারি, তখন এর আলোয় আলোকিত হয় আমাদের জীবনের অন্ধকার অধ্যায়গুলো, দূর হয়ে যায় আমাদের জীবনের ভুলগুলো, আমরা আস্তে আস্তে স্রষ্টাকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি, আমরা তাঁর আরো কাছে যেতে পারি। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেকের ভেতর একটা করে সফটওয়্যার দিয়ে দিয়েছেন, যেটা তাঁকে চিনে। যদি আমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই, তখন আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর নূর দিয়ে সাহায্য করেন। তাঁর আলো এসে পড়ে আমাদের হৃদয়ের সফটওয়্যার এর উপর, আর তখনই সেটা আনলক হয়।
আল্লাহ্ বলেছিলেন ল্যাম্প এর বাইরে একটা পরিষ্কার কাঁচ আছে। ল্যাম্প থেকে কাঁচের মধ্য দিয়ে আলো বের হতে পারে বা ঢুকতে পারে। যদি কাঁচে ময়লা বা দাগ পড়ে তাহলে আলো যেতেও পারে না, ঢুকতেও পারেনা। প্রত্যেকটি পাপ, লোভ, হিংসা, অহংকার, পার্থিব মোহ, লালসা আমাদের হৃদয়ের কাঁচকে ঢেকে ফেলে ঠিক যেভাবে হারিকেন এর কাঁচে ময়লা জমলে ভিতরের আলো কমে আসতে থাকে। খারাপ কাজ করতে করতে, ধর্মকে অবহেলা করতে করতে একসময়ে আমাদের হৃদয়ের উপর এত বেশি পাপের আবরন জমে যায় যে তখন আমাদের ভিতরের আলো আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকে আর বাইরে থেকে স্রষ্টার আলো আর কোনভাবেই আমাদের ভিতরে ঢুকতে পারেনা। আস্তে আস্তে আমরা পরিনত হয়ে যাই মানুষের খোলসবিশিষ্ট অন্তঃসারশূন্য একটি জৈবিক প্রাণীতে। আমাদের সবার চারপাশেই এমন অনেক মুসলিম আছে যাদের এই অবস্থা। তারা হয়ত শেষ নামাজ পড়েছেন ১০ বছর আগে। তাদেরকে ধর্মের কথা বললেও কোন লাভ হয় না, কুর'আন শুনলে তাদের কোন ভাবান্তর হয়না, একবারো তাদের পরকালের কথা মনে পড়েনা । তাদের ভেতরটা পার্থিব জিনিসের মোহে এত বেশি কলুষিত হয়ে গেছে যে এই ময়লা দূর না করলে স্রষ্টার আলো কখনোই তাদের ভেতরে যাবেনা।
একটা ল্যাম্পকে ব্যবহার না করে শুধু ফেলে রেখে দিলেও কিন্তু এর কাচে ময়লা পড়ে যায়। যত দিন যাবে, ময়লা তত পুরু হয়ে পড়তে থাকবে। মানুষেরও ঠিক একই জিনিশ হয়। আপনার চারপাশে অনেক মুসলিম আছেন, যারা খুব চমৎকার ধরনের মানুষ। খুবই ভাল আচার আচরন, খুবই ফ্রেন্ডলী, হাসিখুশি, কারোর ক্ষতি করেন না। কিন্তু তিনি নামাজ পড়েন না। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে- " ভালমানুষ হয়ে থাকাটাই বড় ব্যাপার। ধর্ম যার যার ব্যাপার।" পাপ না করেও তিনি তাঁর হৃদয়কে ঢেকে ফেলেছেন স্রষ্টার প্রতি অবহেলা করে করে।
এজন্য আমাদেরকে সবসময় চেষ্টা করে যেতে হবে যাতে আমাদের হৃদয়ের কাঁচে ময়লা না জমে। আমরা যখন নামাজ পড়ি তখন স্রষ্টার আলো এসে আমাদের রূহের আলোর উপর পড়ে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে যে অনেক সময়ই আমরা নামাজ পড়ি রোবটের মতন যান্ত্রিকভাবে, আমরা কোন কিছু ফীল করিনা। কুর'আন শুনে আমাদের মনে কোন অনূভুতি আসেনা। এগুলো সবই প্রমান করে যে, নিশ্চয়ই আমাদের হৃদয়ের কাঁচে কোন ময়লা জমে আছে যার কারনে আমি স্রষ্টার আলো নিজের ভিতরে নিতে পারছি না। বেশিরভাগ সময়েই এটার কারন হচ্ছে পার্থিব কোন ব্যাপার। সেটা যতক্ষন আমরা মন থেকে সরাতে না পারব, আমাদের ময়লা দূর হবেনা।
যারা রিভার্ট করে ইসলামে আসেন, তারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর নূরকে বুঝতে পারেন। বহু মানুষ রিভার্ট হয় শুধুমাত্র কুর'আন পড়েই। কুর'আন পড়ে তাদের মনে হয় তাদের ভেতরে কি যেন একটা পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, তাদের ভেতরটা ইসলামের আলো দিয়ে ভরে যাচ্ছে।
আল্লাহ এইভাবেই অসাধারন উপমা করেছেন, উদাহরন দিয়েছেন আমাদেরকে, যেন আমরা চিন্তা করতে পারি, কল্পনা করতে পারি। এরপর আপনি যখন একটি কাঁচের ল্যাম্প দেখবেন, আপনি আপনার নিজের কথা চিন্তা করবেন। এরপর আপনি যখন কোথাও একটি ময়লা কাঁচ দেখবেন, আপনি চিন্তা করবেন যে আপনার হৃদয়ের কাঁচে কি কি ময়লা জমে আছে, কিভাবে আপনি সেগুলো পরিষ্কার করতে পারেন, . ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা মানুষকে প্রতিমূহুর্তে আল্লাহর কথা স্মরন করায়, প্রতিদিন আমাদের হৃদয়কে পরিস্কার করতে সাহায্য করে। আমাদের রূহগুলোকে জীবিত রাখে, আমাদেরকে জীবিত রাখে।
নূরুন আলা নূর- এই আলোর আয়াতটি আমার পুরো জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলাম যে এই আয়াতটা আল্লাহ্ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। আমার জীবনে বহু ভুল-ভ্রান্তি ছিল, এখনো আছে। ছোটবেলা থেকে আমি আর দশটা জন্মগত মুসলিমের মতন প্রথাগত উপায়ে বড় হয়েছিলাম। তারপর বড় হয়ে একটা সময়ে আমি নামধারী মুসলিমের মতন ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম। আমাকে বাসায় হুজুর দিয়ে কুর'আন রীডিং পড়তে শেখানো হয়েছিল, ব্যস ঐ পর্যন্তই ছিল আমার কুর'আন শিক্ষা। এরপর বহুবছর কেটে গেছে, আমি কুর'আন স্পর্শও করতাম না, কারন আমি কিছু বুঝতাম না। কিন্তু তারপরো মহান আল্লাহ্ আমাকে দয়া করেছেন। আমার কাছে প্রায়ই মনে হত আল্লাহ্ আমাদেরকে শুধু মুখস্থ করার জন্য আর দুলে দুলে সুর করে কিছুই না বুঝে তিলাওয়াত করার জন্য এই বইটা দেননি; কোন একটা বিশাল ঘাপলা আছে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিতে। আমি আল্লাহর কাছে দু'আ করেছিলাম একদিন এই বলে- O Allah ! I love you and your Book. I want to know the message of your Book. Please teach me your book. Please give me guidance and guide me to the straight Path "
এরপর কিভাবে আল্লাহ্ আমাকে পথ দেখিয়ে দিলেন তার কোন ধারনাও আমার নেই। আস্তে আস্তে আমি খুজে খুজে ভাল ভাল ইংরেজী অনুবাদ পেলাম। বুঝে কুর'আন পড়ে জীবনে প্রথমবারের মতন আমি বুঝতে পারলাম, আল্লাহর কথার চেয়ে শক্তিশালী কোন কথা হতে পারেনা, এরচেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন সাহিত্য হতে পারেনা। এক সময়ে আমার মনে হল, আমি আসলে কুর'আন পড়ি না, কুর'আন আমাকে পড়ে। কুর'আন পড়ে আমার মনে হয়েছে আমার ভিতরের জমে থাকা ময়লাগুলো দূর হয়ে যাচ্ছে আল্লাহর কথা দিয়ে। আমি আল্লাহর কাছে যতটুকু সাহায্য চেয়েছিলাম আল্লাহ্ তারচেয়ে কোটিগুন বেশি আমাকে সাহায্য করেছেন। তারপর আমি আয়াত-আল-নূর পড়ে দেখি হুবহু আমার সমস্যাটাই আল্লাহ্ আমার জন্য ১৪০০ বছর আগে লিখে রেখেছেন। তাই যে সাহিত্যিক তাঁর কথা দিয়ে অলৌকিক কোন উপায়ে আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ্।
মহাজগতের স্রষ্টা যখন কাউকে তাঁর আলো দিয়ে সাহায্য করেন, এরচেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারেনা। এরচেয়ে সুন্দর কোনকিছু আমার জীবনে এখনো পর্যন্ত ঘটেনি, ঘটার কথাও না।
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: