Tuesday, September 1, 2015

ফাযায়েলে দুরুদের একটি ঘটনার ব্যাপারে আহলে হাদীসদের চরম মিথ্যাচার Part 4

ফাযায়েলে দুরুদের উক্ত ঘটনার উপর মৌলিকভাবে চারটি অভিযোগ করা হয়। অভিযোগ গুলোর প্রত্যেকটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আমাদের তথাকথিত তাউহীদবাদী ভাইদের প্রথম অভিযোগ হলো, এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় নবীজী স. গায়েব জানেন। তিনি গায়েব না জানলে তাদের বিপদের কথা কীভাবে জানলেন? তাদের প্রশ্নটা খুবই চটকদার। অল্পতেই অশিক্ষিত মুসলমানকে ধোকা দেয়ার জন্য যথেষ্ট। একটা বিষয় লক্ষ্য করে থাকবেন, আমাদের এই তথাকথিত তাউহীদবাদী ভাইয়েরা অন্যদেরকে কাফের-মুশরিক ট্যাগ দেয়ার জন্য এই কৌশলটা খুব বেশি ব্যবহার করেন। যে কোন একটা কারামত উল্লেখ করে কাফের-মুশরিক ট্যাগ লাগিয়ে দেন।


আমাদের আজকের আলোচনা কারামত সম্পকের্। আলোচনার পূর্বে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, শরীয়তের পরিপূর্ণ অনুসারী ব্যক্তিই কেবল আল্লাহর ওলী হতে পারে। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণভাবে যারা রাসূল স. এর সুন্নাহের অনুসারী এবং শরীয়তের বিধি-বিধান পুংখানু পুংখরূপে পালন করে কেবল তারাই বুযুর্গ ও ওলী হতে পারে। বে-শরা পীর, ফকির, মাজারপূজারী, কবরপূজারী, গাজাখোর, ও বিভিন্ন মাজারের বাবারা কখনও পীর নয়। এরা ইসলাম ও মুসলমানদের মাঝে ওলীর ছদ্মবেশে শয়তানী কাজ-কমর্ পরিচালনা করছে। সুতরাং এদেরকে ওলী মনে করে নিজের দীনকে জলাঞ্জলি দিবেন না। আমাদের দেশে প্রসিদ্ধ  ভন্ডদের তালিকায় রয়েছে, মাইজভান্ডারী, তরিকত ফেডারেশন, আটরশি, এনায়েতপুরী, চন্দ্রপাড়া, সুরেশ্বরী, রাজারবাগ, কুতুববাগ ও আনাচে-কানাচে গজিয়ে মাজার ব্যবসায়ী বাবারা। এদের অধিকাংশের বিশ্বাস ও কমর্ এতটা জঘণ্য যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা ইসলাম থেকে বের হয়ে মুশরিক হয়ে যায়। সুতরাং এই যামানার ভন্ড, বেশরা পীর ফকিরদের দিয়ে পৃকত ওলীদেরকে মাপবেন না। বরং প্রকৃত আল্লাহর ওলীরা জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে রাসূল স. এর সুন্নত ও শরীয়তের বিধি-বিধান অনুসরণ করে। যে যতো বেশি শরীয়তের অনুসারী করে সে তত বড় পীর। শরীয়তের বাইরে কোন পীর নেই, কোন ওলী। রাসূল স. এর সুন্নাহের বাইরে কোন বুযুর্গী নেই। যারা শরীয়ত ও সুন্নত না মেনে পীর-বুযুর্গ  হওয়ার দাবী করে, তারা কখনও ওলী নয়, ওলী হতেও পারে।
আমাদের এই আহলে হাদীস-সালাফী ভাইয়েরা নিজেদেরকে কুরআন ও সুন্নাহের অনুসারী দাবী করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কুরআন ও সু্ন্নাহের ধারে কাছেও যায় না। কারামত অস্বীকার করা এটা কি কুরআন ও সুন্নাহের নির্দেশনা?
কারামত বিশ্বাস করা যাবে না এটা কোন আয়াতে বা হাদীসে আছে? এদেরকে জিজ্ঞাসা করলে কোন আয়াত বা হাদীস দেখাতে পারবে না। তাহলে এরা কীসের ভিত্তিতে এটা অস্বীকার করে?
আসলে মু’তাজিলাদের মতবাদ হলো, তারা কারামত অস্বীকার করে। আমাদের এই আহলে হাদীস সালাফী বন্ধুরা এক্ষেত্রে কুরআন-হাদীস তো দূরে থাক, সরাসরি মু’তাজিলাদের মতবাদকে গ্রহণ করেছে।
আসুন এবার দেখে নেয়া যাক কারামত অস্বীকার করে কারা।
কারামত অস্বীকার করে কারা?

১. সালাফীদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
فقالت طائفة: لا تخرق العادة إلا لنبي، وكذبوا بما يذكر من خوارق السحرة، والكهان، وبكرامات الصالحين، وهذه طريقة أكثر المعتزلة، وغيرهم كأبي محمد بن حزم، وغيره
একদল বলেছে কোন নবী ব্যতীত অন্যদের হাতে অপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটবে না। তারা যাদুকর, গণক ও নেককার বুযুর্গদের হাতে সংগঠিত সকল অপ্রাকৃতিক ঘটনা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। এটি অধিকাংশ মু’তাজিলা, ইবনে হাজাম যাহেরী ও অন্য কিছু লোকের মতবাদ।
দেখুন, আন-নুবুয়াত, পৃ.৫, মাজমু্উল ফাতাওয়া, খ.১৩, পৃ.৯০
নিচের স্ক্রিন শটটি লক্ষ করুন।


ইমাম আব্দুল গাহের বাগদাদী রহ. বলেন,
وأنكرت القدرية كرامات الأولياء لأنهم لم يجدوا في أهل بدعتهم ذا كرامة
কাদেরিয়া ফেরকা ওলীদের কারামত অস্বীকার করেছে। কেননা এই বেদয়াতীরা নিজেদের মধে্য কারামতের অধিকারী কাউকে দেখেনি।
উসুলুদিদ্দীন, পৃ.১৭৫
আব্দুল কাহের বাগদাদী রহ. এর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে কাদেরিয়া ফেরকার মধ্যে কোন বুযুর্গ ছিল না, এবং তারা কেউ কারামতের অধিকারী হয়নি বলেই তারা এগুলো অস্বীকার করে থাকে। আমাদের আহলে হাদীস ও সালাফী ভাইদেরও বোধ হয় একই অবস্থা। এদের মধ্যে হয়তো কোন দিন কেউ বুযুগের্র স্তরেই উন্নীত হয়নি, এজন্যই এরা কারামতকে অস্বীকার করে। শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. শুরুর দিকে সালাফী মতবাদে প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন আফগান জিহাদে এসে কারামত প্রত্যক্ষ করেন, তিনি রীতিমত কারামতের উপর একটি বই লিখেছেন। আয়াতুর রহমান ফি জিহাদিল আফগান, আফগান মুজাহিদগণের কারামত সম্বলিত একটি কিতাব।
৩. ইবনে হাজার আল-হাইতামী মক্বী রহ. বলেন,
كرامات الأولياء حق عند أهل السنة والجماعة خلافاً للمخاذيل المعتزلة والزيدية
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের নিকট ওলীদের কারামত সত্য। মু’তাজিলা ও যায়দী শিয়াদের মতবাদ হলো এরা কারামত অস্বীকার করে।
আল-ফাতাওয়াল হাদিসিয়্যা, পৃ.১০৭-১০৮। দারুল মা’রেফা, বৈরুত।
এর দ্বারা বোঝা গেল, যায়দী শিয়া, মু’তাজেলা ও কাদেরিয়া ফেরকারা কারামত অস্বীকার করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথাকথিত তাউহীদবাদী আহলে হাদীস ও সালাফী। আসুন এবার জেনে নেই কারামত স্বীকার করে কারা।

কারামতের স্বীকৃতি দেয় কারা?


১. ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
ومن أصول أهل السنة والجماعة التصديق بكرامات الأولياء ، ما يجري الله على أيديهم من خوارق العادات في أنواع العلوم والمكاشفات وأنواع القدرة والتأثيرات كالمأثور عن سائر الأمم في سورة الكهف وغيرها وعن صدر هذ ه الأمة من االصحابة و التابعين وسائر قرون الأمة وهي موجودة فيها إلي يوم القيامة
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের একটি মূলনীতি হলো, তারা ওলীদের কারামত সত্যায়ন করে। এই কারামতগুলো আল্লাহ তায়ালা অস্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ওলীদের মাধ্যমে সংগঠিত করেন। কারামতগুলো বিভিন্নধরনের ইলম, কাশফ, অস্বাভাবিক ক্ষমতা ও প্রভাব ইত্যাদি আকারে প্রকাশিত হয়। এটি পূর্ববর্তী সকল উম্মত  থেকেও বর্ণিত। যেমন সূরা কাহাফ ও অন্যান্য সূরায় বর্ণিত হয়েছে।মুহাম্মাদ স. এর উম্মতের মাঝে যারা প্রথম যুগের রয়েছেন তাদের থেকেও অনেক কারামত বর্ণিত হয়েছেন। সাহাবা, তাবেয়ীন ও পরবর্তী সকল যুগ। এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহের মাঝে কারামত সংগঠিত হতে থাকবে।
মাজমুউল ফাতাওয়া, খ.৩ পৃ.১৫৬
নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,

ইবনে তাইমিয়া রহ. আরও বলেন,

فَأَوْلِيَاءُ اللَّهِ الْمُتَّقُونَ هُمْ الْمُقْتَدُونَ بِمُحَمَّدِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيَفْعَلُونَ مَا أَمَرَ بِهِ وَيَنْتَهُونَ عَمَّا عَنْهُ زَجَرَ ؛ وَيَقْتَدُونَ بِهِ فِيمَا بَيَّنَ لَهُمْ أَنْ يَتَّبِعُوهُ فِيهِ فَيُؤَيِّدُهُمْ بِمَلَائِكَتِهِ وَرُوحٍ مِنْهُ وَيَقْذِفُ اللَّهُ فِي قُلُوبِهِمْ مِنْ أَنْوَارِهِ وَلَهُمْ الْكَرَامَاتُ الَّتِي يُكْرِمُ اللَّهُ بِهَا أَوْلِيَاءَهُ الْمُتَّقِينَ . وَخِيَارُ أَوْلِيَاءِ اللَّهِ كَرَامَاتُهُمْ لِحُجَّةِ فِي الدِّينِ أَوْ لِحَاجَةِ بِالْمُسْلِمِينَ كَمَا كَانَتْ مُعْجِزَاتُ نَبِيِّهِمْ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَذَلِكَ كَرَامَاتُ أَوْلِيَاءِ اللَّهُ إنَّمَا حَصَلَتْ بِبَرَكَةِ اتِّبَاعِ رَسُولِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
“মুত্তাকী ওয়ালী আল্লাহগণ যারা রাসূল (সঃ) এর একনিষ্ঠ অনুসারী, রাসূল (সঃ) যা আদেশ করেছেন, তা পালন করে এবং রাসূল (সঃ) যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকে, এবং তাদেরকে যে সমস্ত বিষয়ে আনুগত্যের আদেশ দিয়েছেন সেসমস্ত বিষয়ে আনুগত্য করে, ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ফেরেশতাদের মাধ্যমে সাহায্য করেন, এবং তাদের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা নূর দান করেন। তাদের বিভিন্ন কারামত রয়েছে, যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর মুত্তাকী ওলীদেরকে সম্মানিত করেন। শ্রেষ্ঠ ওলী আল্লাহদের কারামত দ্বীনের জন্য হুজ্জত কিংবা মুসলমানদের প্রয়োজনে প্রকাশিত হয়, যেমন নবীদের মু’জিযা প্রকাশিত হয়। ওলী আল্লাহদের কারামত মূলতঃ নবী কারীম (সঃ) এর অনুসরণের বরকতে হাসিল হয়”
[মাজমুউল ফাতাওয়া, খ--১১, পৃষ্ঠা-২৭৪]

২. জামালুদ্দিন গজনভী হানাফী রহ. বলেন,
ظهور كرامات الأولياء على طريق نقض العادة وخرقها جائز ، لأنه في قدرة الله تعالى ممكن ، وليس فيه وجه من وجوه الاستحالة ، ويجوز أنْ الله تعالى أكرم ولياً بكل آية يخصه ، بذلك ثبت بالكتاب والسنة
স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে অপ্রাকৃতিক কোন কারামত সংগঠিত হওয়া সম্ভব। এগুলো আল্লাহর ক্ষমতায় সংগঠিত হয় বিধায় তা ঘটা সম্ভব।কারামত সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে অসম্ভব কোন কারণ নেই। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক ওলীকেই স্বতন্ত্র কারামত দ্বারা সম্মানিত করতে পারেন। কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা বিষয়টি এমনই প্রমাণিত হয়েছে।
উসুলুদ্দিন, পৃ.১৬২-১৬৩, দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়া, বয়রুত, লেবানন।
৩. ইমাম শাতবী রহ. আল-মুয়াফাকাতে লিখেছেন,
إنّ جميع ما أعطيته هذه الأمة من المزايا والكرامات والمكاشفات والتأييدات وغيرها من الفضائل ، إنما هي مقتبسة من مشكاة نبينا
আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, কারামত, কাশফ ও অদৃশ্যভাবে সাহায্য ইত্যাদি ফযিলত দান করেছেন। এগুলো সব মূলত: রাসূল স. এর নবুওয়াতের আলো থেকে গৃহীত।
আল-মুয়াফাকাত, খ.২, পৃ.১৯৭, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বয়রুত।
৪. ইমাম নববী রহ. বলেন,
ومنها إثبات كرامات الأولياء وهو مذهب أهل السنة خلافاً للمعتزلة
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্যতম আক্বিদা হলো ওলীদের কারামতের সত্যায়ন করা। এটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মাযহাব। মু’তাজেলারা এর বিপরীত মতবাদ পোষণ করে।
শরহু মুসলিম, খ.১১, পৃ.১০৮

কারামত সম্পর্কে সালাফী আলেমদের বক্তব্য:

বর্তমান সময়ের সালাফীরা কথায় কথায় অন্যদেরকে কাফের মুশরিকের ট্যাগ লাগালেও তাদের অনুসরণীয় আলেমরা কিন্তু কারামত চর্চা করে থাকেন। পরবর্তী আলোচনায় সালাফীদের অনুসরণীয় আলেমদের দু’একটি কারামত উল্লেখ করবো। আসুন এবার দেখা যাক সালাফী আলেমরা কারামত সম্পর্কে কী বলেন।
১. সালাফীদের ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী বলেন,
وأقر بكرامات الأولياء وما لهم من المكاشفات، إلا أنهم لا يستحقون من حق الله - تعالى - شيئاً ولا يطلب منهم ما لا يقدر عليه إلا الله 
আমি ওলীদের কারামত ও কাশফ স্বীকার করি। তবে তারা একমাত্র আল্লাহর কোন হক্বের অধিকারী হবে না। তাদের কাছে এমন কিছু চাওয়া যাবে না যা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার পক্ষে সম্ভব।
মাজমুউ মুয়াল্লাফাতিশ শায়খ, খ.৫, পৃ.১০
তিনি ওলী ও বুযুর্গদের হক আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন,
الواجب عليهم حبهم واتباعهم والإقرار بكرامتهم، ولا يجحد كرامات الأولياء إلا أهل البدع والضلال 
তাদের উপর কর্তব্য হলো তারা নেককার বুযুর্গদের মহব্বত করবে, তাদের অনুসরণ করবে, তাদের কারামতের স্বীকৃতি প্রদান করবে। বেদয়াতী ও পথভ্রষ্টরাই কেবল ওলীদের কারামত অস্বীকার করে।
মাজমুয়াতু মুয়াল্লাফাতিশ শাইখ, খ.৪, পৃ.২৮২।
২. মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ বলেন,
ولا ننكر كرامات الأولياء، ونعترف لهم بالحق وأنهم على هدى من ربهم مهما ساروا على الطريق الشرعية والقوانين المرعية 
আমরা ওলীদের কারামত অস্বীকার করি না। আমরা তাদের কারামতকে সত্য বলে স্বীকার করি। আমরা বিশ্বাস করি তারা যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়তের বিধি-বিধান ও নিয়মের মাঝে থাকবেন, তারা আল্লাহর প্রেরিত হেদায়াতের উপর রয়েছেন।
আদ-দুরারুস সুন্নিয়া, খ.১, পৃ.১২৮।

কারামত আসলে কী?

কারামতের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে ইবনে তাইমিয়া রহ. একটা কিতাব লিখেছেন। কিতাবের নাম হলো, কাইদাতুন ফিল মু’জিযাত ওয়াল কারামত। এখান থেকে কিছু বিষয় উল্লেখ করছি।
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
صفات الكمال ترجع إلى ثلاثة: العلم، والقدرة، والغنى، وإن شئت أن تقول: العلم، والقدرة. والقدرة إما على الفعل وهو التأثير، وإما على الترك وهو الغني، والأول أجود. وهذه الثلاثة لا تصلح على وجه الكمال إلا لله وحده، فإنه الذي أحاط بكل شيء علما، وهو على كل شيء قدير، وهو غني عن العالمين.
পূর্ণতার গুণটি মূলত: তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১. ইলম, ২. কুদরত (ক্ষমতা) ও ৩. অমুখাপেক্ষিতা। বিষয়টিকে এভাবেও বলা যায়, পূর্ণতা ইলম ও কুদরতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কুদরত দুই প্রকার। কোন একটি কাজ করার ক্ষমতাকে তা’সীর বলে। কোন কাজ থেকে বিরত থাকার ক্ষমতাকে অমুখাপেক্ষিতা বলে। তবে প্রথম শ্রেণি বিভাগটি উত্তম। এই তিনটি গুণ পরিপূর্ণভাবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার মাঝেই বিদ্যমান। তিনি তাঁর ইলম দ্বারা সমস্ত সৃষ্টিকে বেষ্টন করেছেন, তিনি সব কিছুর উপর সবর্ ক্ষমতার অধিকারী এবং তিনি সমস্ত সৃষ্টি থেকে অমুখাপেক্ষী।
ক্বাইদাতুন ফিল মু’জিযাত ওয়াল কারামত, পৃ.৮
এখানে পরিপূর্ণ ক্ষমতা, জ্ঞান ও অমুখাপেক্ষিতা আল্লাহ তায়ালার জন্য। যাদের হাতে কারামত প্রকাশিত হয়, তাদের কেউ এই বিষয়গুলোর উপর পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী নয়। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় কেবল ওলীর হাতে কোন কারামাত প্রকাশিত হতে পারে। কারামত ওলীর নিজস্ব ইচ্ছাধীন কোন বিষয় নয়। সে নিজের ক্ষমতায় কারামত দেখায় না, বরং আল্লাহর ইচ্ছায়, আল্লাহর ক্ষমতায় কারাত প্রকাশিত হয়। সুতরাং ওলীদের কারামত কখনও ইলমের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। যেমন, কোন ওলী অদৃশ্য কোন বিষয় সম্পর্কে অবগত হলো। আবার কখনও কারামত ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হতে পারে। যেমন, কোন ওলী অস্বাভাবিক কিছু করলেন, যা অন্যরা করতে পারে না। কারামতের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে তাঁর বক্তব্য উল্লেখ করছি।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন-

فَمَا كَانَ مِنْ الْخَوَارِقِ مِنْ " بَابِ الْعِلْمِ " فَتَارَةً بِأَنْ يُسْمِعَ الْعَبْدَ مَا لَا يَسْمَعُهُ غَيْرُهُ . وَتَارَةً بِأَنْ يَرَى مَا لَا يَرَاهُ غَيْرُهُ يَقَظَةً وَمَنَامًا . وَتَارَةً بِأَنْ يَعْلَمَ مَا لَا يَعْلَمُ غَيْرُهُ وَحْيًا وَإِلْهَامًا أَوْ إنْزَالُ عِلْمٍ ضَرُورِيٍّ أَوْ فِرَاسَةٍ صَادِقَةٍ وَيُسَمَّى كَشْفًا وَمُشَاهَدَاتٍ وَمُكَاشَفَاتٍ وَمُخَاطَبَاتٍ : فَالسَّمَاعُ مُخَاطَبَاتٌ وَالرُّؤْيَةُ مُشَاهَدَاتٌ وَالْعِلْمُ مُكَاشَفَةٌ وَيُسَمَّى ذَلِكَ كُلُّهُ " كَشْفًا " وَ " مُكَاشَفَةً " أَيْ كَشَفَ لَهُ عَنْهُ
“ইলমের সাথে সংশ্লষ্টি কারাম হলো সসেমস্ত  অস্বাভাবিক বিষয় যা বভিন্নি সময় প্রকাশিত হয় যেমন, কখনও কোন কোন বান্দা এমন কিছু শ্রবণ করে যা অন্যরা করে না, কিংবা কখনও স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় এমন জিনিস দেখে, যা অন্যরা দেখে না, অথবা ওহী বা ইলহামের মাধ্যমে কখনও এমন জিনিস অবগত হয়, যা অন্যরা জানে না, অথবা তার উপর আবশকীয় ইলম অবতীর্ণ হয়, অথবা সত্য ফিরাসাত যাকে কাশফ ও মোশাহাদা বলা হয়, সমষ্টিগতভাবে এগুলোকে কাশফ ও মুকাশাফা বলে অর্থাৎ তার নিকট উন্মোচিত করা হয়েছে”
[মাজমুউল ফাতাওয়া, খ--১১, পৃষ্ঠা-৩১৩]

কুদরত বা ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট কারামত সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
وما كان من باب القدرة فهو التأثير، وقد يكون همة وصدقًا ودعوة مجابة، وقد يكون من فعل الله الذي لا تأثير له فيه بحال،
ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারামত হলো, সৃষ্টির মাঝে ক্ষমতা প্রদর্শন। এটি কখনও ওলীর ইচ্ছাপূরণ, কথা সত্য প্রমাণিত হওয়া বা দুয়া কবুলের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কখনও এটি এমনভাবে প্রকাশিত হয় যে, সেখানে ওলীর নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা হাত থাকে না। যেমন, ওলীর শত্রু মারা গেল।
মাজমুউল ফাতাওয়া, খ.১১, পৃ.৩১৩।

আমাদের এই বিস্তারিত আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো, গায়েব সংক্রান্ত বিষয়েও যে কারামত হয় সেটা উল্লেখ করা। ফাযায়েলে দুরুদের ঘটনায় যেহেতু প্রথম অভিযোগ হিসেবে গায়েব জানার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে একারণে এবিষয়টি আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা জরুরি।

কাশফ ও ইলম সংক্রান্ত কারামতের উদাহরণ দিতে গিয়ে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
وأما المعجزات التي لغير الأنبياء من باب الكشف والعلم فمثل قول عمر في قصة سارية، وإخبار أبي بكر بأن ببطن زوجته أنثى، وإخبار عمر بمن يخرج من ولده فيكون عادلًا، وقصة صاحب موسى في علمه بحال الغلام
নবীগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য কাশফ ও ইলমের ক্ষেত্রে কারামতের উদাহরণ হলো, হযরত উমর রা. হযরত যারিয়া ইবনে হাযাম রা. কে দূর থেকে সম্বোধন, হযরত আবু বকর রা. সন্তান জন্মের পূর্বে বলেন যে, তাঁর স্ত্রীর পেটে কন্যা সন্তান, হযরত উমর রা. বলেন, তার পরবর্তী বংশধর একজন ন্যায়পরায়ণ হবে এবং হযরত মুসা আ. এর সঙ্গে হযরত খিযির আ. এর ঘটনা।
ক্বাইদাতুন ফিল মু’জিযাত ওয়াল কারামাত, পৃ.১৯

গায়েব সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কারামত:

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا  وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام
“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।
[মাদারিজুস সালিকিন, খ--২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।
¬
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর ভবিষ্যৎ বাণীঃ

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم
“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”
[মাদারিজুস সালিকিন, খ--২, পৃষ্ঠা-৪৯০]

আমাদের এই আলোচনা থেকে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না যে, এতোদিন শুনেছি, গায়েব সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানেন, এখন দেখছি কারামত হিসেবে ওলীরাও গায়েব জানেন।
এটা আমাদের ইলমের স্বল্পতা। গায়েবের শ্রেণি বিভাগ, কোনটি একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানেন অন্য কেউ নয়, কোনটি মাখলুও জানতে পারে সেসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

যারা ফাযায়েলে দুরুদের উক্ত ঘটনার কারণে কুফুরী-শিরকের ট্যাগ লাগিয়েছেনে, তাদেরকে প্রশ্ন করবো, নাউযুবিল্লাহ আপনারা হযরত আবু বকর রা, হযরত উমর রা. কেও কুফুরীর ট্যাগ লাগাবেন?
আপনাদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. কেও কি কাফের-মুশরিক-বেদয়াতী বলবেন? আপনাদের জওয়াবের অপেক্ষায় রইলাম| এখানে যদি জওয়াব না দিতে পারেন, তবে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য উলামায়ে কেরামের সঙ্গে বেয়াদবি করেন কেন? বড় বড় উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে কুফুরী শিরকের ট্যাগ লাগাতে জিহ্বা আড়ষ্ট হয় না, অথচ আমাদের ছোট্র একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেন না? এভাবে আর কতকাল খেয়ানত করবেন? সাধারণ মানুষকে আর কতো বোকা বানাবেন?

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This

0 comments: