অভিযোগ -
তাবলিগ জামা’আতের মুরুব্বীরা কি রাসুল (সাঃ) ও সাহাবীদের থেকেও বেশি তাকওয়াশীল???
‘’জনৈক বুজুর্গকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, নামাযের মধ্যে কি আপনার কখনও দুনিয়াবী খেয়াল আসে? তিনি বলিলেন, এইরুপ খেয়াল নামাযেও আসে না এবং নামাযের বাহিরেও আসে না’’
ফাজায়েলে আমল; ফাজায়েলে নামাজ; মুহাম্মাদ যাকারিয়া ছাহেব কান্ধলভি; অনুবাদক- মুফতি মুহাম্মাদ উবাইদুল্লাহ; নজরে ছানী ও সম্পাদনা হাফেজ মাওলানা মুহাম্মাদ যুবায়ের ছাহেব ও মাওলানা রবিউল হক ছাহেব; কাকরাইল মসজিদ, ঢাকা। প্রকাশনা- দারুল কিতাব, ৫০ বাংলাবাজার, ঢাকা; অক্টোবর ২০০১ ইং; তৃতীয় অধ্যায়-পৃষ্ঠা নঃ ১৮৭
আজকে আমরা শুধুমাত্র নামাযের মধ্যে কোন কিছু স্মরণ হওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ।
মানুষের ফিতরাত অনুযায়ী সলাতের মধ্যে কোন কিছু মনে আসা স্বাভাবিক বিষয়। যদিও তা থেকে রাসুল (সাঃ)-এর শিক্ষা অনুযায়ী চেষ্টা করতে হবে যেন পূর্ণ মনোযোগ সহকারে খুশু-খুজুর সলাত আদায় করা যায়। কিন্তু কেউ যদি দাবী করে তার সলাতে অথবা সলাতের বাইরে দুনিয়াবী কোন কিছুই স্মরণ হয় না! তাহলে তাকে অতিমানবই বলতে হয়!!! আসুন আমরা রাসুল (সাঃ) হাদীস ও সাহাবীদের বর্ণনা থেকে বিষয়টির যৌক্তিকতা যাচাই করার চেষ্টা করি।
...............
খন্ডণ -
দুটি হাদিস উল্লেখ করে সালাতের মধ্যে দুনিয়াবী খেয়াল ও কথা-বার্তা শুনার জন্য অন্য মনষ্ক হবার স্বপক্ষে উনারা ২টি হাদিস উল্লেখ করেছেন -
উসমান ইবন আবু আস (রাঃ) নাবী (সাঃ)-এর নিকট এসে বললেন- ‘’হে আল্লাহর রাসুল! শয়তান আমার, আমার সলাত ও কিরা’আতের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং সবকিছুতে গোলমাল বাধিয়ে দেয়’’ (মুসলিম ২২০৩)
উমার (রাঃ) বলেছেন, ‘’(জিহাদের সময়) আমি সলাতের মধ্যে আমার সেনাবাহীনির বিন্যাসের চিন্তা করে থাকি’’ (বুখারী ২১/১৮)
আপনাদের নিকট আমার প্রশ্ন নামাযের মধ্যে দুনিয়াবী খেয়াল আনা কি বুযূর্গি ?? আর কেউ নবীর বাতলে দেয়া পন্থায় নামাযে অধীক মনযোগি ও দুনিয়াবী খেয়াল বিমূখ হলে তা কি অনেক বড় অপরাধ ??
নবী এবং সাহাবীদের প্রতিটি ঘটনা কেয়ামত পর্যন্ত আনেয়ালা উম্মতের জন্য শিক্ষনীয় হিসেবে বিবেচীত ! উসমান ইবন আবু আস (রাঃ) নামাযে সয়তান কর্তৃক বিভিন্ন খেয়াল আসার পূর্বে কি জানতেন যে কিভাবে সালাতে সয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে মূক্ত থেকে অধীক ধ্যানের সহীত সালাত আদায় করা যায় ?? না নবীর কাছে উক্ত সমস্যার কথা ব্যাক্ত করার পর নবীজি সাহাবীদেরকে নামাযে মনযোগী ও সয়তানের ওয়সওয়াসা থেকে বাচার পন্থা শিখালেন ??
এর পর যদি সাহাবীরা এবং পরবর্তি সকল মুসলমান ধারাবাহীক ভাবে নবীর কথার উপর আমল করে নামাযে সয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বাচতে পারেন তাহলে সমস্যা কোথায় ??
আলী (রাঃ) নামাযে সেনাবাহীনির বিন্যাসের চিন্তা করতেন ?? তা এক সময়তো নামাযে সালাম আদান-প্রধানেরও অনুমতি ছিল পরে নিষিদ্ধ করা হয়, তো সেই পূর্বেকার উদৃতি দিয়ে নামাযে সালাম এর প্রচলণ বৈধ করতে পারবেন . . ??
মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (রহঃ) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে তিনি নামায রত থাকাবস্থায় সালাম দিতাম এবং তিনি এর জবাব দিতেন। পরবর্তীকালে আমরা যখন হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশীর নিকট হতে ফিরে এসে তাঁকে নামাযের মধ্যে সালাম প্রদান করি, তখন তিনি এর জবাব প্রদান করেন নাই। বরং এসময় তিনি বলেন, অবশ্যই নামাযের মধ্যে (কিরাত, তাসবীহ ইত্যাদি) জরুরী করণীয় কাজ রয়েছে।
(বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ)।
অনুরূপ খায়বর যুদ্ধের পর যাহেলিয়াতের প্রথা মূতাহ বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়,তা খায়বর যুদ্ধের পূর্বের উদৃতি দিয়ে কি মূতা বিবাহ শিয়াদের ন্যায় যায়েজ বানাতে পারবেন ??
মদ হারাম হবার পূর্বে বহু সাহাবী মদ পেটে নিয়েই শহীদ হয়ে গেছেন ! মদ হারাম হবার পর আর কেউ তা পান করেনি,তা মদ হারাম হবার পূর্বের উদৃতি দিয়ে তা হালাল সাব্যস্ত করতে পারবেন ??
তাহলে নামাযের মধ্যে দুনিয়াবি বিষয়ে খেয়াল করা,দুনিয়াবি কথা শুনার জণ্য কান পেতে থাকার জন্য এত উদ্গ্রিব কেন আপনারা ??
## সাহাবীদের নামায কেমন ছিল -
হযরত ওসমান ও আলী (রাঃ)’র নামায -
নামাযে হযরত ওসমান (রাঃ) সমস্ত রাত জেগে থাকতেন এবং এক রাকায়াতে এক খতম কুরআন সম্পূর্ণ করে ফেলতেন। হযরত আলী (রাঃ) এর সর্বদা এ অভ্যাস ছিল যে, যখনই নামাযের সময় হতো তাঁর শরীর কম্পমান হতো; চেহারায় হলুদ বর্ণ ধারণ করত।
আলী (রাঃ)’র নামাযের অবস্থা -
‘একবার কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় শত্রু পক্ষের একটি তীর এসে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলীর পায়ে বিদ্ধ হলো। ক্ষতস্থান দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়া শুরু হলো। তীরটি ছিলো বিষাক্ত। তাই তিনি ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন। দুর থেকে সঙ্গী-সাথীরা হযরত আলীর কাছে ছুটে এলেন। তারা পা থেকে তীরটি বের করার জন্য টান দিতেই তিনি যন্ত্রণায় শিউরে উঠলেন। সাহাবীরা পড়ে গেলেন মহা সমস্যায়। কারণ তীর বের করতে না পারলে রক্ত পড়া বন্ধ হবে না, ব্যথাও যাবে না। মহানবীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সবকিছু দেখছিলেন। তিনি বুঝলেন এভাবে আলীর পা থেকে তীর বের করা যাবে না। তাই তিনি কয়েকজন সাহাবীকে ডাকলেন। একটু দুরে গিয়ে তাদেরকে আস্তে আস্তে বললেন, তোমরা এক কাজ কর। আলী যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন তোমরা তীরটি বের করে নেবে। রাসূলের পরামর্শ সবাই মেনে নিয়ে যার যার কাজে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর নামাযের সময় হলো। সবাই তৈরী হলো নামাযের জন্য। হযরত আলীও বসে নেই। মুযাজ্জিনের আযানের ধ্বনি শোনার সাথে সাথে তিনি নামাযের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সকল ব্যথা ভুলে গিয়ে তিনি জামায়াতে গিয়ে হাজির হলেন। সবাই যখন নামাযে মশগুল তখন কয়েকজন সাহাবী ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন আলীর দিকে। বেশ শক্তভাবেই তীরটা বিঁধেছে আলীর পায়ে। আস্তে টান দিলেও চলবে না। তাই তীরের মাথা ধরে সাহাবীগণ সজোরে টান মারলেন। বেরিয়ে এলো তীর । কিন্তু ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগলো তাজা রক্তের স্রোত। হযরত আলী তখনও নামায পড়ছেন। উহ্ আহ্ কোন শব্দই করলেন না তিনি। নামাযের মধ্যে এতো বড় ঘটনা ঘটল অথচ তিনি কিছুই টের পেলেন না!
নামাযের প্রতি হযরত আলীর একাগ্রতা দেখে সাহাবীগণ বিষ্মিত হয়ে গেলেন। তারা মনে মনে ভাবলেন, এমন অদ্ভুত মানুষও কেউ হতে পারে? একটু আগেও যিনি তীরে হাত দিলেই ব্যথায় শিউরে উঠতেন। অথচ নামাযের সময় সেই একই ব্যক্তি ব্যথা-বেদনার কথা একদম ভুলে গেলেন-এটা কিভাবে সম্ভব? সাহাবীগণ এমনি অনেক কথা ভাবতে ভাবতে নামায শেষ হলো। নামায শেষে হযরত আলী তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে পায়ে তীর নেই। ক্ষতস্থান দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। তিনি একটু অবাক হলেন। পাশে দাঁড়ানো সাহাবীদেরকে এ বিষয়ে জানতে চাইলেন তিনি। সাহাবীরা জানালেন, নামাযের সময় তাঁর পা থেকে তীরটি বের করে নেয়া হয়েছে। হযরত আলী বুঝলেন সমস্ত ঘটনা। তাঁর মুখে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
পাঠক দেখলেন তো নামাযের প্রতি হযরত আলীর আকর্ষণ কেমন ছিলো ?
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, নামাযের সময় তিনি যেন একেবারে অন্য জগতের মানুষ হয়ে যেতেন। ভুলে যেতেন সকল দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা
এই জিজ্ঞাসা যথার্থ হলেও কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করলে নামাযে একাগ্রতা আনা যেতে পারে। নামায পড়ার সময় প্রতিটি সূরা এবং তাসবীহ তাহলীলের অর্থ কি তা মনে মনে চিন্তা করবেন। নামাযে দাঁড়ানোর সময় মনে করবেন যে আপনি এমন এক সত্ত্বার সামনে দাঁড়িয়ে আছো যিনি আপনাকে দেখছেন। এছাড়া প্রতিটি নামাযের সময় চিন্তা করবেন যে, এটাও আপনার শেষ নামায।
‘ইবনে যুবায়ের (রাঃ) এর নামায -
সাবিত(রাঃ) বলেন, ‘ইবনে যুবায়ের যখন সিজদা করতেন; তখন এত দীর্ঘ সময় নিশ্চল হয়ে থাকতেন যে, পাখি এসে তাঁর পিঠের ওপর বসে থাকত। তিনি মাঝেমাঝে এত লম্বা রুকু করতেন যে, সমস্ত রাত এবং ভোর পর্যন্ত রুকুতেই থেকে যেতেন। আবার কোনো কোনো সময় এক সিজদাতেই সারা রাত কাটাতেন’।
আমরা নামায আদায়কালে সারা দুনিয়ার সমস্ত চিন্তা মস্তিষ্কে ঘুরপাক করে। অথচ সাহাবীরা যখন নামায আদায় করতেন, তখন যদি বৈষয়িক কোন বিষয়ে কল্পনা করতেন, নামায শেষে নামাযের প্রতিবন্ধকতাস্ব
সালাতের বিন্দুমাত্র মানহানি করে পার্থিব অত্যধিক মূল্যবান বস্তুকেও তাঁরা রক্ষা করতে রাজি হতেন না।
সাহাবীদের নামাযের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমাদের নামাযকে ইবাদত বলেও মনে হয় না। মুসলমান ও অমুসলমানের পার্থক্য নামাযে। মুসলমান মানে আত্মসমর্পণকারী।
হযরত আবু বকর ও ওমর (রা)-এর নামায -
হযরত আবু বকর যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন মনে হতো মাটিতে একটি লাঠি পুঁতে রাখা হয়েছে; একটুও নড়াচড়া করতেন না। হযরত আবু বকর ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মূর্ত প্রতীক। অর্থাৎ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যেভাবে নামায আদায় করতেন, তদ্রপ তিনিও। রুকু, সিজদায়, ক্বিরআতে অধিক সময় কাটাতেন।
আততায়ীর ছোরার আঘাতে আহত হয়ে হযরত ওমর (রাঃ) শয্যাশায়ী। তখন তাঁর যখম হতে প্রায়ই রক্ত প্রবাহিত হতো এবং তিনি সালাত আদায়ে প্রায়ই অক্ষম ও অপারগ হয়ে পড়তেন। কিন্তু ঐ অবস্থাতেও তিনি সালাত আদায় করে বলতেন, ‘ যে সালাত আদায় করে না সে ইসলামে শরিক হতে পারে না।’
এখন তালীগি নিসাব এর কিতাবে বর্ণীত জনৈক বুযূর্গের নামাযে একাগ্রতা নিয়ে যারা কটুক্তি করেন তাকে নবী থেকেও বেশি পরেজগার বলে ঠট্টা করেন তাদের নিকট আমার প্রশ্ন - সাহাবীরাও কি তাহলে আপনাদের খোড়া যুক্তি অনুযায়ী নবী থেকে বেশি পরহেযগার ছিলেন কারণ তারা নামাযে দুনিয়াবী চিন্তা করতেন না ????????!!
তাহলেকি আপনাদের অপব্যাখ্যা অনুযায়ী সাহাবীরা রাসুল (সাঃ) থেকেও বেশি তাকওয়াশীল??? (নায়ুযূবিল্লাহ)
ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি
0 comments: