Tuesday, September 1, 2015

ফাযায়েলে দুরুদের একটি ঘটনার ব্যাপারে আহলে হাদীসদের চরম মিথ্যাচার Part 3

শায়খ যাকারিয়া রহ. এর নিজস্ব বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, তিনি  মুহাদ্দিসগণের অনুসরণে ফাযায়েলে দুরুদে কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আসুন এবার দেখে নেই, কোন কোন কিতাবে ফাযায়েলে দুরুদের উক্ত ঘটনাটি রয়েছে। কোন কোন কিতাবে ঘটনাটি আছে,  সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সকল কিতাব পাঠ করা প্রয়োজন। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে যেগুলো আমার দৃষ্টিতে পড়েছে এখানে সেগুলো উল্লেখ করছি। একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন, উক্ত ঘটনা উল্লেখের কারণে যদি শায়খ যাকারিয়া রহ. কে কুফুরী-শিরকের অপবাদ দেয়া হয়, তাহলে তার পূর্বে যারা ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও একই অপবাদ প্রযোগ করা উচিৎ।
যেসমস্ত কিতাবে উক্ত ঘটনা রয়েছে:
  1. আবুল কাসেম খালাফ ইবনে আব্দুল মালেক ইবন বাশকুয়াল রহ. তার আল-কুরবাতু ইলা রাব্বিল আলামানি, বিস সালাতি আলা মুহাম্মাদিন সাইয়্যিদিল মুরসালিন নামক কিতাবে উক্ত ঘটনাটি সুফিয়ান সাউরী রহ. থেকে সনদ সহ উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি উল্লেখের পূর্বে ইবনে বাশকুয়াল রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনা করবো। এর দ্বারা পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন, এই ঘটনার কারণে শিরকে অপবাদ দিলে কাদেরকে শিরকের অপবাদ দেয়া হবে। এই ঘটনার সাথে কুফুরী-শিরকের সামান্যতম কোন সম্পর্ক নেই, এই বিষয়টি পরবর্তী আলোচনায় ইনশাআল্লাহ আলোচনা করবো।
ইবনে বাশকুয়াল রহ. এর জীবনী জানতে দেখুন,
১.  ইমাম যাহাবী রহ. কৃত তারিখুল ইসলাম, খ.১, পৃ.৪০৭৩
২.     আল্লামা সাফদী কৃত আল-ওয়াফী বিল ওফায়াত, খ.১, পৃ.১৮৭৯
৩. ইমাম যাহাবী কৃত তাযকেরাতুল হুফফায, খ.৪, পৃ.১৩৩৯।
৪.  ইবনে কাসীর রহ. কৃত আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.১২, পৃ.৩১২
৫.  আল্লামা বাগদাদী রচিত হাদয়াতুল আরেফীন, খ.১, পৃ.১৮৪।
ইবনে বাশকুয়াল রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:
ইবনে বাশকুয়াল রহ. তৎকালীন উন্দুলুস বা স্পেনের বিখ্যাত মুহাদ্দিস, হাফেজে হাদিস, উসুলবিদ ও ঐতিহাসিক ছিলেন। তার নাম ছিলো, আবুল কাসেম খালাফ ইবনে আব্দুল মালেক ইবনে বাশকুয়াল। তিনি ৪৯৪ হি: তে স্পেনে জন্মগ্রহণ করেন। তার বিখ্যাত উস্তাদগণের মধ্যে কয়েকজন হলেন, আবুল ওয়ালীদ ইবনে রুশদ, আবুল ওয়ালীদ ইবনে ত্বরীফ, আবু বাহার ইবনুল আস। তার বিখ্যাত অনেক ছাত্র রয়েছে, যেমন, আহমাদ ইবনে আব্দুল মাজিদ আল-মালেকী, আবুল কাসেম আহমাদ ইবনে ইয়াযিদ ইবনে বাকী, আহমাদ ইবনে আয়্যাশ, সাবেত ইবনে মুহাম্মাদ।
ইবনে বাশকুয়াল রহ. এর ইলমী মর্যাদা:
আবু আব্দুল্লাহ আল-আবার তার সম্পর্কে বলেন,
তিনি হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ব্যাপকভাবে  অবগত ছিলেন, বর্ণনার ক্ষেত্রে সীমাহীন সতর্ক ছিলেন, বর্ণনা পম্পরা সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন, সমকালীনদের দলিল ও মর্যাদার ক্ষেত্রে তাদের শীর্ষে ছিলেন। অনেক বড় হাফেজে হাদীস ছিলেন। সাথে সাথে তিনি ছিলেন একজন ঐতিহাসিক। স্পেনের প্রাচীন ও সমকালীন ইতিহাস সম্পর্কে অবগত ছিলেন। অনেক মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শ্রবণ করেছেন। তার উস্তাদদের থেকে ছোট-বড় চার শ এর বেশি কিতাব সনদ সহ বর্ণনা করেছেন। মানুষ ইলম অন্বেষণের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে তার নিকট আসতো এবং ইলম অর্জন করতো। ...বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পঞ্চাশের অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
ইমাম যাহাবী রহ. ইবনুয যুবায়েরের সূত্রে তার সম্পর্কে অনেক প্রশংসাপূর্ণ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন।
ইবনে বাশকুয়াল রহ. ৫৭৮ হি: তে মৃত্যুবরণ করেন।

ইবনে বাশকুয়াল রহ. এর কিতাবে ফাযায়েলে দুরুদের ঘটনা:


ইবনে বাশকুয়াল রহ. ফাযায়েলে দুরুদের উক্ত ঘটনাটি সনদসহ সুফিয়ান সাউরী রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন। কিতাবের সনদটি হলো,  তিনি আহমাদ ইবনে জুদী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমার নিকট আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আল-মুনকীরি ( যিনি আন-নাক্কাশ নামে পরিচিত ) বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট মুহাম্মাদ ইবনে শাযান আল-মাতুয়ী নিশাপুরে  বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট জাফার ইবনে মুহাম্মাদ বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শাকের বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট আবু নুয়াইম বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট সুফিয়ান সাউরী বর্ণনা করেছেন। পরবর্তী ঘটনা প্রথম নোটে ফাযায়েলে দুরুদ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। নিচের স্ক্রিনশটটি লক্ষ্য করুন।

আল-কুরবা, পৃ.৯৫। তাহকীক, সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ সায়্যিদ, খালাফ মাহুমুদ আব্দুস সামী, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বয়রুত, লেবানন। প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৪ সাল।
২.
মালেকী মাযহাবের বিখ্যাত ইমাম ছিলেন, তাজুদ্দিন আল-ফাকিহানী রহ.। বর্তমানে সালাফী আলেমরা তাজুদ্দিন আল-ফাকিহানী রহ. এর কিতাব সমূহের উপর যার পর নেই গুরুত্ব দিচে্ছ। তাদের কাছে তাজুদ্দিন আল-ফাকিহানীর কিতাব কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরছি। তাজুদ্দিন আল-ফাকিহানী রহ. এর বিখ্যাত একটি কিতাব হলো, রিয়াজুল আফহাম। যা উমদাতুল আহকামের ব্যাখ্যা। কিতাবটি ড.শরীফা উমরীর তাহকীকে দারু ইবনে হাযাম থেকে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে। সউদী আরবের উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটির ছাত্র বদর বিন নাসে বিন সুলাইমান আল-উমর এই কিতাব তাহকীক করে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছে।

তাজুদ্দিন আল-ফাকিহানী রহ. তার আল-ফজরুল মুনীর ফিস সালাতি আলাল বাশিরিন নাজির গ্রন্থে ফাযায়েলে দুরুদের উক্ত ঘটনাটি ইবনে বাশকুয়াল ও আবু নুয়াইম রহ. এর সূত্রে হুবহু উল্লেখ করেছেন। ঘটনা উল্লেখের পূর্বে তাজুদ্দিন আল-ফাকিহানী রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনা করবো। যারা অবলীলায় কুফুরী-শিরকের অপবাদ দিতে অভ্যস্ত তারা বিখ্যাত কতো আলেম সম্পর্কে এই স্পর্ধা দেখাতে পারে, সেটা যাচাই করার জন্যই আমাদের এই প্রয়াস। নতুবা মূল চারটি প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনা করলেই উক্ত ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা শেষ হয়ে যেত।

তাজুদ্দিন ফাকিহানী রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:
তাজুদ্দিন ফাকিহানী রহ. এর বিস্তারিত জীবনী জানতে দেখুন,
১.    তারীখে ইবনুল জাওযী, খ.৩, পৃ.৭০৪।
২.    মু’জামুল মুহাদ্দিসীন, পৃ.১৮৩।
৩.    আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.১৪, পৃ.১৬৮
৪.    আদ-দিবাজুল মাযহাব, পৃ.১৮৬।
৫.    আদ-দুরারুল কামিনা, খ.৩, পৃ.১৭৮।
৬.    কাশফুয জুনন, খ.২, পৃ. ১৮৮৩।
তিনি ৬৫৪ হি: তে ইস্কান্দারিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার সম্পর্কে ইবনুল জাওযী রহ. লিখেছেন,
الشيخ الإمام ، العلامة، الزاهد، بقية السلف...وهو شيخ فاضل صالح بشوش الوجه كثير الفضائل وله مصنفات و فوائد و فيه زهد و عفاف
“ তিনি ছিলেন, শায়খ, ইমাম , আল্লামা, দুনিয়াবিরাগী, সালাফে-সালেহীনের নমুনা...তিনি সৎ ও মহান শায়খ, সদা হাস্যোজ্জল, গুণী। তার অনেক উপকারী রচনা ও কর্ম রয়েছে। দিনি দুনিয়াত্যাগী ও পুত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।” সূত্র: আল্লামা ইবনুল জাওযী রহ. কৃত তারিখু হাদিসিজ জামান, খ.২,পৃ.৪৬৮। এছাড়াও যারা তার জীবনী রচনা করেছেন সকলেই তাকে শায়খ, ইমাম, আল্লামা, যাহেদ ইত্যাদিতে ভূষিত করেছেন। আল্লামা তাজুদ্দিন ফাকিহানী রহ. তার আল-ফাজরুল মুনির কিতাবে ফাযায়েলে দুরুদের উক্ত ঘটনাটি হুবহু উল্লেখ করেছেন।
নিচের লিংক থেকে আল-ফজরুল মুনির ডাউন লোড করুন।
http://www.almeshkat.net/books/open.php?cat=14&book=2421#.UoBHhyeBzIU

৩.

হাদীস শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা সাখাভী রহ. তার আল-কাউলুল বাদী গ্রন্থে উক্ত ঘটনাটি হুবহু উল্লেখ করেছেন। ইমাম সাখাভী রহ. এর মতো বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না এরপরও তার সম্পর্কে কাযী শাওকানীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করছি। কাযী শাওকানী রহ. তার আল-বদরুত তালে গ্রন্থে ইমাম সাখাভী রহ. সম্পর্কে লিখেছেন, ‍তিনি অনেক বড় ইমাম ছিলেন। এমনকি তার সম্পর্কে তার ছাত্র জারুল্লাহ ইবনে ফাহাদ বলেছেন, আল্লাহর শপথ, পরবর্তী হাফেজে হাদীসগণের মাঝে তার মতো কাউকে দেখিনি। তার কিতাব সম্পর্কে যারা অবগত রয়েছে কিংবা তাকে দেখেছে তারা বিষয়টি খুব ভালোভাবে জানে…। সূত্র: আল-বদরুত তালে, কাযী শাওকানী, খ.২, পৃ.১৮৫।
ইমাম সাখাভী রহ. তার বিখ্যাত কিতাব আল-কাউলুল বাদী ফিস সালাতি আলাল-হাবিবিশ শাফী গ্রন্থে ফাযায়েলে দুরুদের উল্লেখিত ঘটনাটি হুবহু উল্লেখ করেছেন। নিচের স্ক্রিনশট দেখুন।

আল-কাউলুল বাদী, পৃ.৩৪২।

এছাড়াও শরফুল মুস্তফা কিতাবটি বর্তমানে সাইয়্যেদ আবু হাশেম নাবিল ইবনে আসেম আল-গুমারী এর তাহকীকে ছয় খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ইমাম খারকুশী রহ. (মৃত: ৪০৬ হি:) শরফুল মুস্তফা কিতাবে ফাযায়েলে দুরুদের অনুরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। শরফুল মুস্তাফা এর টীকায় এর মুহাক্কিক আবু হাশেম নাবিল ইমাম সাখাভীর সূত্রে ফাযায়েলে দুরুদের ঘটনাটি হুবহু উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও আরও অনেক কিতাবে উক্ত ঘটনা থাকতে পারে। যেমন শায়খ যাকারিয়া রহ. নোজহাত কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। আমার পক্ষে ফাযায়েলে দুরুদ বিষয়ের অন্যান্য কিতাব মোতায়ালা করা সম্ভব হয়নি।একারণে অন্যান্য কিতাবে যাচাই করার সুযোগ হয়নি।উপরে যাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে, তাদের কারও সম্পর্কে আমাদের তথাকথিত সালাফী-আহলে হাদীস ভাইগণ কুফুরী-শিরকের অপবাদ দিবেন কি না জানতে আগ্রহী। সালাফী-আহলে হাদীসদের নিকট তারা মুশরিক হয়ে থাকেন, তাহলে তাদেরকে যারা আল্লামা, ইমাম, শায়খ, ইত্যাদি উপাধি দিয়েছেন, যেমন ইবনে কাসীর রহ, ইবনুল জাওযী রহ, ইমাম যাহাবী… এদের সম্পর্কে কী বলা হবে? সালাফী ও আহলে হাদীস ভাইয়েরা যদি বিষয়টি আলোচনা করেন, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো। আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারতাম। তাদের বক্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম। পরবর্তী আলোচনাগুলোতে উক্ত ঘটনার উপর যে অভিযোগ আরোপ করেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হবে।

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This
Previous Post
Next Post

0 comments: