Sunday, October 18, 2015

কারবালা বিপ্লব-৩

মরুর বুকে ঘোড়াগুলো দৌড়াচ্ছে ৷ আকাশজুড়ে কালোমেঘের আনাগোনা ৷ কারবালার বুকে এতো জনসমাগম বোধ হয় আর কখনো হয় নি ৷ দিনের প্রতিটি প্রহরেই নতুন নতুন সেনা এসে জড়ো হচ্ছে ৷

উমন ইবনে সাদ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে হোসাইন ( আ ) কে বাইয়াত গ্রহণ করতে বলে ৷

কয়েক ঘণ্টা পর শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরো বহু নতুন সৈন্য এসে তার সাথে যোগ দেয়৷ লৌহবর্ম পরিহিত অবস্থায় শিমার ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলো ৷ তার চোখেমুখে নির্দয়-নির্মমতার ছাপ৷ অহঙ্কারের সাথে সে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে যেয়াদের একটি চিঠি ওমরের হাতে দেয় ৷

ঐ চিঠিতে লেখা ছিলঃ 'হে সাআদের পুত্র ! হোসাইনের সাথে নম্র ব্যবহার করার জন্যে তোমাকে পাঠাই নি ৷ হোসাইন যদি আত্মসমর্পন না করে , তার ওপর এবং তার সঙ্গী- সাথীদের ওপর হামলা করবে৷ সবাইকে হত্যা করে তাদের লাশের ওপর দিয়ে ঘোড়া চালাবে ৷ এ কাজের জন্যে তুমি আমার কাছ থেকে উত্তম পুরস্কার পাবে ৷ আর যদি তুমি এ দায়িত্ব পালন করতে না পারো , তাহলে সেনাপতির দায়িত্ব শিমারকে দেবে ৷'

চিঠি পড়ে ওমর সাআদ শিমারের দিকে তাকিয়ে বললোঃ' তোর ওপরে খোদার লা'নত ৷ তুই একটা প্রতারক ৷' বলতে না বলতেই শিমার হুঙ্কার মেরে বললো যে ইয়াযিদের আদেশ পালন না করা পর্যন্ত সে শান্ত হবে না ৷ অবশেষে মুহররমের ষষ্ঠ দিনে বিশ সহস্রাধিক সশস্ত্র সৈন্যকে রাসূলে খোদা ( সা ) এর সন্তানের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে কারবালায় প্রেরণ করা হলো ৷

কারবালা দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেল ৷ একদিকে কেবল তাঁবু আর তাঁবু , অস্ত্র-শস্ত্র আর ঘোড়া ৷ অপরদিকে ছোটো ছোটো কয়েকটি তাঁবু ৷ যেগুলোর মাঝে সবুজ রঙের বড়ো চাদর দেখতে পাওয়া যায় ৷ একদিকে দুনিয়াপুজারী বলদর্পী সেনাদের আনন্দ-উল্লাস , অপরদিকে নবীজীর সন্তানের প্রতিরক্ষায় সত্যপূজারী একদল খোদাপ্রেমিক মানুষের দোয়া-দরুদের গুঞ্জরণ ৷ সেনাপতিরা একের পর এক কুফার গভর্নরের কাছ থেকে চিঠি পাচ্ছে ৷ চিঠির ভাষ্য হলো-'হোসাইন ইবনে আলীকে বলো,তাকে এবং তার সঙ্গী-সাথীদেরকে অবশ্যই ইয়াযিদের বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে,অন্যথায় তার গর্দান নেবে ৷' আরেকটি পত্রে বলা হয়েছে, ‘হোসাইনের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করবে ৷ এমনকি তার সাথীদেরকে এক ফোঁটা জলও নিতে দেবে না ৷'

ইমাম হোসাইন ( আ ) এর নূরানী চেহারায় সত্যের প্রতি ভালোবাসার ছাপ সুস্পষ্ট ৷ কিন্তু কুফাবাসীর গোমরাহী তাঁর অন্তরমনকে আহত করেছে ৷ তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের সেনাদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ 'দুনিয়াপূজারী মানুষ যখন আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকে , ধর্ম তখন তাদের কাছে খেলনা বস্তু বলে মনে হয় , অর্থাত্‍ তখন তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে ৷ তবে যখন তারা কোনো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন খুব কম লোককেই সত্য ও দ্বীনের ওপর অটল থাকতে দেখা যায় ৷'

রাতের বেলা মরুভূমিতে নেমে এলো রহস্যময় নীরবতা ৷ হঠাত্‍ শত্রুসেনাদের মাঝ থেকে একটা আনন্দধ্বনি ভেসে উঠলো ৷ ইমামের সঙ্গীরা তাঁদের তাঁবুগুলোকে কাছাকাছি নিয়ে এলো এবং পরিখা খনন করে শত্রুদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলো ৷ নামায শেষে ইমাম তাঁর সাথীদের মাঝে গেলেন ৷ গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাদের দিকে তাকালেন ৷ তারপর তাঁর কণ্ঠধ্বনি রাতের নিরবতা ভেদ করলো ৷ 'আমি তোমাদের মতো বন্ধু এবং নিজের পরিবারের মতো পরিবার আর দেখি নি ৷ আমার সাথে তোমরা যে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছো , আমি সেই বন্ধন তুলে নিলাম এবং তোমরা যে আমার হাতে বাইয়াত হয়েছো তার দায় থেকেও আমি তোমাদের মুক্ত করে দিলাম ৷ এখন তোমাদের সবাইকে আমি অনুমতি দিচ্ছি তোমরা যে পথ দিয়ে এসেছো , সেপথে পুনরায় চলে যেতে পারো ৷ রাতের আঁধারে তোমরা চলে যাও ৷ যেসব সৈন্য এখানে এসেছে , তারা কেবল আমাকেই চায় তোমাদরকে নয় ৷'

বীরত্ব ও সাহসিকতার অনন্য পরাকাষ্ঠা ইমাম হোসাইন ( আ ) এর ভাই আব্বাস সবার আগে এগিয়ে এসে বললেন ,
'আমরা তোমাকে একা রেখে নিজ নিজ শহরে ফিরে যাবো-এরকম কোনো দিন যেন না আসে ৷'

মুসলিম ইবনে আওসাজা উঠে বললেন , ' হে নবীর সন্তান ! চারদিক দিক থেকে যখন শত্রুরা তোমাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে , তখন আমরা তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো ? আল্লাহর দরবারে আমরা এর কি জবাব দেবো ? আমরা শহীদ না হওয়া পর্যন্ত তোমার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে যাবো এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবো ৷'

সাআদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফি বললেন , হে নবীর সন্তান ! আমরা তোমাকে একা ছেড়ে যাবো না ৷ আমরা আল্লাহর দরবারে এ বার্তা পৌঁছাতে চাই যে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) এর পর তোমার সহযোগিতায় থেকে প্রকারান্তরে তাঁকেই আমরা সাহায্য করেছি ৷'

যাহির ইবনে কায়েন বললেন, 'খোদার শপথ , ইচ্ছে করে একবার মরে আবার জীবিত হই , আবার মরে আবার জীবিত হই-এভাবে হাজারবার মরে বেঁচেও চাই নবীজীর খান্দান এবং এই যুবকদের জীবন সকল প্রকার বালা-মুসিবত্‍ থেকে রক্ষা পাক ৷'

কাসেম নামের তেরো বছরের একটি শিশু ইমামের পাশে চীত্কার করে বললো,চাচাজান ! আমিও কি এই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাবো ? ইমাম তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন , মৃত্যুকে তুমি কীভাবে চিন্তা করো ? কাসেম বললো, 'চাচাজান! আল্লাহর দ্বীনের সহযোগিতা করতে গিয়ে এবং জুলুম-অত্যাচার দূর করতে গিয়ে যেই মৃত্যু তাকে আমি মধুর চেয়ে মিষ্টি বলে মনে করি ৷' ইমাম এবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন ,হ্যাঁ , ভাতিজা আমার,তুমিও শহীদ হবে ৷ একথা শুনে এই কিশোর অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হবার জন্যে গেল ৷ আর ইমাম হোসাইন ( আ ) চাঁদের রূপালি জ্যোত্স্নাুয় তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জন্যে দোয়া করলেন ৷ অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি শত্রুদের শিবিরগুলোর দিকে তাকিয়ে পবিত্র কোরআনের সূরা আল-ইমরানের ১৭৮ এবং ১৭৯ নম্বর আয়াতদুটি তিলাওয়াত করলেনঃ ‘কাফেররা যেন এই চিন্তা না করে যে ,তাদের আমরা যে অবকাশ দিয়েছি তা তাদের মঙ্গলের জন্যে ৷ আমরা তাদেরকে অবকাশ দেই এইজন্যে যে,যাতে তারা তাদের গুনাহের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তোলে,তাদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি ৷ এটা সম্ভব নয় যে , আল্লাহ মুমিনদেরকে তাদের অবস্থার মধ্যে ফেলে রাখবেন , তবে যে পর্যন্ত না ভালো থেকে মন্দ আলাদা হয় ৷

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This
Previous Post
Next Post

0 comments: