Saturday, October 24, 2015

সংক্ষেপে কারবালার ঘটনা

আজ হতে ১৩৭৬ চন্দ্র-বছর আগে ৬১ হিজরির এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনা বা করুন ট্র্যাজেডি ।
ইরাকের কারবালায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রায় ১০০ জন সঙ্গী মৃত্যু ও রক্তের সাগরে ভেসে ইসলামকে দিয়ে গেছেন পরমাণু শক্তির চেয়েও লক্ষ কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী বিপ্লবের তথা শাহাদতের সংস্কৃতির বাস্তব শিক্ষা ।
কারবালার এ বিপ্লব আধুনিক যুগে সংঘটিত ইরানের ইসলামী বিপ্লবসহ যুগে যুগে সব মহতী বিপ্লবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে ।

জালিম ও দুরাচারী পাপিষ্ঠ ইয়াযীদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করায় হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) ও তাঁর পরিবারের সব পুরুষ সদস্যসহ (কেবল ইমাম যইনুল আবিদিন (আঃ) ছাড়া) ইমামের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং নবী-পরিবারের প্রেমিক একদল মুমিন মুসলমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল কারবালায় ।

ইয়াযীদের আনুগত্য করতে ইমাম (আঃ) এর অস্বীকৃতির খবর জানার পর কুফার প্রায় এক লাখ নাগরিক চিঠি ও প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল ইমাম (আঃ) কে যাতে তারা প্রকৃত ইসলামী শাসনের স্বাদ পেতে পারে এবং মুক্ত হতে পারে ইয়াযীদের কলঙ্কিত শাসনের নাগপাশ থেকে ।
তাই ইমাম (আঃ) তাঁর আত্মীয় পরিবার পরিজন নিয়ে মক্কা থেকে রওনা হয়েছিলেন কুফার উদ্দেশ্যে যাতে তাদের সহযোগিতায় ইয়াযীদের রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা যায় ।
কিন্ত ইয়াযীদের গভর্নর ও প্রশাসনের নানা ধরনের ভয়-ভীতি এবং প্রলোভনের মুখে কুফায় ইমামপন্থী জনগণ ইমামের প্রতিনিধিকেই সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয় এবং ইমামের প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকিল (আঃ) নির্মমভাবে শহীদ হন ।

এ অবস্থায় ইমাম (আঃ) কুফার জনগণের সহায়তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেলেও প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য কুফার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখেন যাতে কেউ তাকে ভীতু , কাপুরুষ ও আপোসকামী বলে অভিযোগ করতে না পারেন ।
যদিও তিনি জানতেন কুফায় তাঁকে ও তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদেরকে শহীদ করা হতে পারে , তবুও তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মৃতপ্রায় ইসলামকে জীবিত করার স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার তথা শাহাদতের জন্যও প্রস্তুত ছিলেন ।
ইমাম (আঃ) দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে , নবী-পরিবারের রক্তদান বৃথা যাবে না এবং একদিন জনগণ জেগে উঠবে ।
কুফায় পৌঁছার আগেই কারবালায় ইমামকে তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীসহ ঘেরাও করে ইয়াযীদ-বাহিনী ।
হয় ইয়াযীদের আনুগত্য নতুবা মৃত্যু --- এ দুয়ের যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে বলা হয়েছিল তাঁদেরকে ।
কিন্ত তাঁরা বীরোচিতভাবে লড়াই করে শহীদ হওয়ার পথই বেছে নিয়েছিলেন ।
ইমাম (আঃ) যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না ।
আর এ জন্যই তিনি তাঁর পরিবারের শিশু ও নারীদেরও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ।
দশই মহররম যুদ্ধ যখন অনিবার্য তখনও ইমাম (আঃ) ইয়াযীদ বাহিনীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে , তারা এক অন্যায় যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে নবী-পরিবারের নিষ্পাপ সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে ।
কিন্ত অর্থ লোভী ও হারাম খাদ্য খেতে অভ্যস্ত ইয়াজিদ বাহিনীর নেতা-কর্মীদের মনে কোনো উপদেশই প্রভাব ফেলছিল না ।
অবশ্য হোর ইবনে ইয়াজিদ (রাঃ) নামক ইয়াজিদ বাহিনীর একজন কর্মকর্তা তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি তার কয়েকজন আত্মীয় ও সঙ্গীসহ ইমামের শিবিরে যোগ দেন ও শেষ পর্যন্ত বীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন ।
ইমাম (আঃ) এর দিকে সর্ব প্রথম তীর নিক্ষেপ করেছিল ইয়াযীদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ ।
ইমাম (আঃ) এর জন্য জান-কুরবান করতে প্রস্তুত পুরুষ সঙ্গীদের প্রায় সবাই ত্রিশ হাজার মুনাফিক সেনার বিরুদ্ধে মহাবীরের মত লড়াই করেন এবং বহু মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে একে-একে শহীদ হন ।
ইমাম (আঃ) এর প্রায় ১৮ বছর বয়সী সুদর্শন যুবক পুত্র হযরত আলী আকবর (আঃ) , যিনি ছিলেন দেখতে এবং আচার-আচরণে অবিকল রাসূল (সাঃ) সদৃশ । এমনকি তাঁর কণ্ঠও ছিল রাসূল (সাঃ) এর কণ্ঠের অনুরূপ ।
কারবালা ময়দানে তাঁর আজান শুনে অনেক বয়স্ক শত্রুও চমকে উঠেছিল । বহু মুনাফিককে জাহান্নামে পাঠিয়ে শহীদ হন ।
একইভাবে শহীদ হন ইমাম হাসান (আঃ) এর পুত্র হযরত কাসিম (আঃ.) ।
হযরত আলী (আঃ) এর কন্যা যয়নব (সাঃআঃ) দুই কিশোর পুত্রও বীরের মত লড়াই করে শহীদ হন ।
সম্মুখ যুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে কেউই পারছিলেন না । শত্রুরা যখন দেখত যে , ইমাম শিবিরের প্রত্যেক পিপাসার্ত বীর সেনা তাদের বহু সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হচ্ছেন তখন তারা ওই বীর সেনাকে ঘেরাও করে ফেলত এবং দূর থেকে বহু তীর বা বর্শা নিক্ষেপ করে কাবু করে ফেলত ।
ফোরাতের পানি ইমাম শিবিরের জন্য কয়েকদিন ধরে নিষিদ্ধ থাকায় নবী-পরিবারের সদস্যরাসহ ইমাম শিবিরের সবাই ছিলেন পিপাসায় কাতর ।
মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে শিশুদের অবস্থা হয়ে পড়ে প্রচন্ড শোচনীয় ।
এ অবস্থায় ইমাম (আঃ) তাঁর ছয় মাসের দুধের শিশু আলী আসগর (আঃ) এর জন্য শত্রুদের কাছে পানি চাইলে ওই নিষ্পাপ শিশুর গলায় তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে শহীদ করে ।
পিপাসাত শিশুদের জন্য পানি আনতে গিয়ে বীরের মত লড়াই করে ও দুই হাত হারিয়ে নির্মমভাবে শহীদ হন ইমাম (আঃ) এর ভাই হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আঃ) ।
তিনি ছিলেন ইমাম বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি এবং বহু শত্রুকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন । নবী পরিবারের কয়েকজন শিশুও বীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন । নবী (সাঃ) এর পরিবারের সদস্যরা বাহ্যিক ও আত্মিক সৌন্দর্যে ছিলেন অনন্য । অর্থাৎ তারা দেখতে যেমন অপরূপ সুন্দর ছিলেন তেমনি আচার-আচরণেও ছিলেন শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী ।
সন্তান , ভাই , ভাগ্নে , ভাতিজা ও সঙ্গীরা সবাই শহীদ হওয়ার পর যুদ্ধে নামেন আল্লাহর সিংহ হযরত আলী (আঃ) এর পুত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) ।
তাঁর আগে তিনি যদিও জানতেন যে , তাঁর ডাকে সাড়া দেয়ার মত কেউ নেই ।
তবুও তিনি বলেন , কেউ কি আছ আমাকে সাহায্য করার ?
অথবা , আমার সাহায্যের ডাকে কেউ কি সাড়া দেবে ?
এ কথা তিনি চার বার বলেছিলেন ।
অনেকেই মনে করেন , আসলে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি তাঁর আদর্শের পথে সহায়তা করতেই মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ওই আহ্বানের মাধ্যমে ।
যাইহোক , তিনি একাই প্রায় দুই হাজার মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন । তাঁর আঘাতে আহত হয়েছিল আরও বেশি সংখ্যক মুনাফিক ।
কিন্ত এক সময় তিনিও চরম পিপাসায় ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েন । এ সময় তাঁকে ঘিরে ফেলে মুনাফিক সেনারা । পাথর ও অনেক বিষাক্ত তীর মারে তারা বেহেশতী যুবকদের অন্যতম সর্দারের পবিত্র শরীরে ।
একটি তীর ছিল তিন শাখা-বিশিষ্ট । এরপর এক নরাধম মারে একটি বর্শা । ফলে অশ্বারোহী ইমাম (আঃ) ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান ।
এরপর আরেক নরাধম শিমার অথবা সিনান জীবন্ত অবস্থায় ইমামের মস্তক মুবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল । (এই নরাধমদের উপর অনন্তকাল ধরে আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক। )
ইমাম (আঃ) এর শরীরে বর্শা , তীর ও তরবারির অন্তত তিনশ ষাটটি আঘাত ছিল ।
কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী আঘাতের সংখ্যা এক হাজার তিনশ ।
সেদিন ছিল শুক্রবার এবং ইমামের বয়স ছিল ৫৭ বছর ।
ইমাম (আঃ) এর মাথা মুবারক বর্শার আগায় বিদ্ধ করেছিল নরাধমরা । শুধু তাই নয় ইমামের লাশসহ শহীদদের লাশগুলোর ওপর ঘোড়া দাবিয়ে পবিত্র লাশগুলোকে দলিত-মথিত করেছিল নরপশুরা । বলা হয় , শাহাদতের সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল আল্লাহর দিদার ও শাহাদত-প্রেমিক ইমামের চেহারা ততই উজ্জ্বল বা নূরানি হচ্ছিল স্বর্গীয় আনন্দে ।
যোহর ও আসরের নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁকে শহীদ করা হয় ।
এর আগে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে সালাতুল খওফ তথা যুদ্ধ বা ভয়ের সময়কার (সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির) জামায়াতে নামাজ পড়েছিলেন ।
ইয়াযীদ সেনারা ইমাম শিবিরের তাবুগুলোতে আগুন দিয়েছিল এবং নারীদের অলঙ্কার ছিনিয়ে নেয়াসহ লুট-পাট চালায় । তারা ইমামের জিনিসপত্র ও উটগুলো লুট করে । এমনকি নবী-পরিবারের মহিলাদের বোরকাগুলোও লুট করেছিল নরাধমরা । তাঁদেরকে খালি পায়ে হাঁটিয়ে বন্দীদের মত সারি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় কুফা বা দামেস্কের দিকে ।

ইমাম (আঃ) এর শাহাদতের পর বিশ্বনবী (সা্) এর স্ত্রী উম্মে সালামাহ (আঃ) কে কাঁদতে দেখে তাঁকে প্রশ্ন করা হয় এর কারণ সম্পর্কে ।
তিনি বলেন , স্বপ্নে দেখলাম আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে , তাঁর মাথা ও দাড়ি ধুলায় মাখা । এ ব্যাপারে রাসূলকে (সাঃ) প্রশ্ন করায় তিনি বলেন , এইমাত্র আমি আমার হুসাইনের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি ।
আশুরার দিন সূর্য কালো হয়ে গিয়েছিল । লাল আকাশে তারা দেখা যাচ্ছিল দিনের বেলায় । অনেকেই ভয় পাচ্ছিল যে , হয়ত কিয়ামত শুরু হয়েছে ।
যে কোনো পাথর তুললে তার নিচে তাজা রক্ত দেখা যেত ।
বহু অঞ্চলে রক্ত-বৃষ্টি বর্ষিত হয় এবং পানি লাল বর্ণ ধারণ করে ।
এমনকি ঐতিহাসিক সাক্ষ্য অনুযায়ী ব্রিটেনেও রক্ত-বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল ।
দেখুন লিংক: আশুরার দিনে রক্তবৃষ্টি-

ইসলামী বর্ণনায় এসেছে , রাসূল (সাঃ) নিজে অলৌকিকভাবে ইমাম হুসাইন (আঃ) এর পবিত্র খুন সংগ্রহ করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে বিচার দিয়েছেন ।
আশুরার দিন কেঁদেছিল ফেরেশতাকুলও ।  মহান আল্লাহ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়া হবে বলে ফেরেশতাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন । বলা হয় জ্বীন ও ফেরেশতারা ইমাম হুসাইন (অাঃ) কে ইয়াযীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছিল । কিন্ত ইমাম (আঃ) অসহায় অবস্থায় শহীদ হওয়ার জন্য অবিচল ছিলেন । তিনি শুধু সামান্য একটু দোয়া করলে জ্বীন ও ফেরেশতাদের সাহায্য ছাড়াই ইয়াযীদ বাহিনী মাটিতে দেবে ধ্বংস হয়ে যেত ।

কারবালায় নবী-পরিবারের বিরুদ্ধে নৃশংস হত্যাযজ্ঞে ও বর্বরতায় শরিক সবাই কঠিন শাস্তি দুনিয়াতেই পেয়েছিল ।
শীয়ানে আলী মহামতি মুখতার সাকাফি (রহঃ) অধিকাংশ ঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ।
অন্যদিকে ইমাম হুসাইন (আঃ) ও তাঁর মহান সঙ্গীদের জন্য যুগ যুগ ধরে কাঁদছে নবী-পরিবার-প্রেমিক মুসলমানরা এবং এই শোক ইসলামের অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে ।
মানবতার অশ্রুর মহাসাগরে ও মুসলমানদের হৃদয়-রাজ্যে চির-অধিপতি হয়ে আছেন কারবালার বীর শহীদরা ।

ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি

Share This
Previous Post
Next Post

0 comments: